২০২৪ সালের বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজন করা হয় ‘জুলাই জাগরণ কালচারাল ফেস্ট’। এই বিশেষ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ‘সাইমুম শিল্পী গোষ্ঠী’।
লিখেছেন মোহাম্মদ ইব্রাহীম।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত চার দিনব্যাপী এই উৎসব যেন হয়ে উঠে ইতিহাসের জীবন্ত পাঠশালা। যেখানে অন্ধকার সময়ের দমন-পীড়নের কাহিনী কেবল পড়া নয়- দেখা, অনুভব ও উপলব্ধির মধ্য দিয়ে হৃদয়ে প্রবেশ করে।

প্রদর্শনীটি সাজানো হয় ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের সেই বিভীষিকাময় ৩৬ দিনের রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের চিত্রকে কেন্দ্র করে। প্রথম অংশে ছিল ‘আয়নাঘর’, যেখানে আলোক-আধারের সংমিশ্রণে তৈরি করা হয় নির্যাতনের নিঃশব্দ সাক্ষ্য। পাথরের মতো স্তব্ধ, রক্তের মতো লালাভ আলো এবং আয়নায় প্রতিফলিত অন্ধকার, দর্শনার্থীদের বাস্তবতার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়।
আয়নাঘর : ভয়ের ভেতর ইতিহাসের সাক্ষাৎ
দর্শনার্থীদের কাছে সবচেয়ে আলোচিত অংশ ছিল ‘আয়নাঘর’-একটি গুম, নির্যাতন ও মৃত্যুর গ্যালারি।

পঞ্চগড় থেকে আসা আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘আয়নাঘর দেখে আমি যেন আন্দোলনের সেই ভয়াবহ দিনগুলোতে ফিরে গেলাম। গুলিবিদ্ধ ছাত্র, রিকশায় লাশ, নির্যাতনের চিত্রগুলো আমাকে আবেগাপ্লুত করেছে।’
নাঈমুর রহমান বললেন, ‘আয়নাঘর শুধু একটি প্রদর্শনী নয়, এটি ইতিহাসের জ্বলন্ত দলিল। শিল্প নয় যেন বাস্তবতা।’
ডেমরা থেকে আসা দর্শনার্থী ইমাম হোসেন বলেন, ‘আয়নাঘরের ‘ইলেকট্রিক চেয়ার’-এর প্রতীকী উপস্থাপন দেখলে বোঝা যায়, এই আন্দোলন কতটা নির্মম ছিল।’
শহীদদের কবর, কাভার ভ্যান ও নিপীড়নের চিত্র : বাস্তবতাই ছিল প্রধান উপাদান
দর্শনার্থীরা নানান উপস্থাপনায় বাস্তবতাকে অনুভব করেন।

ফারজানা ইয়াসমিন বলেন, ‘শহীদদের ছবিতে ভরা দেয়াল আমাকে কাঁদিয়েছে। আয়নাঘরের মানসিক নির্যাতনের চিত্র আমার ভাইয়ের আন্দোলনের স্মৃতি জাগিয়ে তোলে।’
শাকিল আহমেদ নামে একজন মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট বলেন, ‘জীবন্ত মানুষকে গাড়িতে আটকে পুড়িয়ে মারার চিত্র দেখে আমি স্তব্ধ হয়ে যাই।’

শ্যামপুরের বাসিন্দা মোহাম্মদ কাউসার বললেন, ‘আমার সন্তান প্রশ্ন করেছিল ‘তারা (লাশগুলো) বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে না বাবা?’ আমি কোনো উত্তর দিতে পারিনি।’
শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি : প্রতিরোধের রূপান্তর
এই উৎসবে কেবল ছবি নয়, নাটক, গান, আবৃত্তি, ডকু-ফিল্ম এবং ভিজ্যুয়াল আর্ট ছিল বিপ্লবের উদাহরণ।

সহকারী পরিচালক হাদিউজ্জামান বুলবুল জানান, ‘আয়নাঘর, শহীদদের কাটআউট এবং ভাইরাল আলোকচিত্রগুলোকে নাট্যরূপ দেয়া ছিল এই উৎসবের মূল আকর্ষণ। দর্শনার্থীদের আবেগ ছিল এতটাই প্রবল, যে স্বেচ্ছাসেবীরা রাত ১১টা পর্যন্ত কাজ করেছেন।’
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী মোহাম্মদ ইয়ামিন বলেন, ‘শিক্ষিত, সচেতন ছাত্রদের নেতৃত্বে এত নিখুঁত আয়োজন, এত সুন্দরভাবে ইতিহাসকে উপস্থ্পন-এটি ছাত্রশিবির ছাড়া কল্পনা করা কঠিন।’
ইতিহাস রক্ষার প্রয়াস, ভবিষ্যতের অনুপ্রেরণা
এই আয়োজনে দর্শনার্থীদের শুধু শোক বা আবেগ নয়-ছিল জ্ঞান ও সচেতনতার বীজ বপনের এক আন্তরিক চেষ্টা।

তেজগাঁও মদিনাতুল উলুম কামিল মাদরাসার সহকারি অধ্যাপক জয়নুল আবেদিন খান বলেন, ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে আগস্টের দমন-পীড়ন-সবকিছুই এখানে উপস্থাপিত হয়েছে সময়োপযোগী ও ঐতিহাসিক বোধে। এ উৎসব ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অনেক অনুপ্রেরণা দেবে। তবে ছাত্রদের দাবি ছিল ন্যায্যতার জন্য, যা দলীয় রাজনীতির কারণে আজ প্রশ্নবিদ্ধ।’
উৎসবের লক্ষ্য : ইতিহাস রক্ষা ও সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ
অনুষ্ঠানের মূল আয়োজক ও পরিচালক এইচএম আবু মুসা বলেন, ‘এই উৎসবের তিনটি লক্ষ্য:
১. ফ্যাসিবাদী অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ;
২. শহীদদের স্মৃতি রক্ষা;
৩. তরুণদের জুলাই চেতনার সাথে যুক্ত করা।
আয়নাঘর নির্মিত হয়েছে বাস্তব নির্যাতনের প্রতিচ্ছবি হিসেবে, যা দর্শনার্থীদের হৃদয়ে নাড়া দিয়েছে।’

জনতার প্রতিক্রিয়া : ইতিহাস শুধু বইয়ের পাতায় নয়, চোখের সামনে
কবি নজরুল সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী হাসান মামুন বলেন, ‘সোহরাওয়ার্দীতে বাস্তব ইতিহাসকে ছুঁয়ে দেখার অনুভূতি হলো। কাভার ভ্যানে লাশ, শহীদদের প্রতীকী কবর, সবকিছু যেন ইতিহাসের হাত ধরে আমাকে টেনে আনল।’
ফেনি থেকে আগত ওরাকা বিন বাশার বলেন, ‘ড্রোন শটে ধারণকৃত শহীদদের প্রতীকী কবর, মানচিত্র এক অনন্য শ্রদ্ধার নিদর্শন।’

উপসংহার: ৩৬ জুলাই উৎসব-শিল্পের ভাষায় ইতিহাসের প্রতিবাদ
৩৬ জুলাই কালচারাল ফেস্ট-২৫ ছিল ইতিহাসের দগদগে ক্ষতগুলোর চিত্রায়ন, যন্ত্রণা ও প্রতিবাদের এক সম্মিলিত কণ্ঠস্বর। আয়নাঘরের প্রতিটি দেয়াল, শহীদের প্রতিটি ছবির পেছনে লুকিয়ে ছিল একেকটি জীবন, একেকটি সংগ্রামের অধ্যায়।
এই উৎসব প্রমাণ করে-তথ্য ও চেতনার সম্মিলন যখন শিল্পের মাধ্যমে উপস্থাপিত হয়, তখন তা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে জেগে থাকে এক দীপ্ত প্রতিরোধের আলো হয়ে।
লেখক : জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং দৈনিক নয়া দিগন্তে ইন্টার্নি করছেন।