বিবিএস-ইউএন’র তথ্য

নারীর অবৈতনিক শ্রমের মূল্য ৬ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো’র (বিবিএস) এক জরিপে এ তথ্য ওঠে এসেছে।

বিশেষ সংবাদদাতা
নয়া দিগন্ত

বাংলাদেশে নারীরা যে অবৈতনিক (গৃহস্থালি ও যত্নমূলক কাজ) শ্রম প্রতিদিন করে যাচ্ছে, ২০২১ সালের হিসাব অনুযায়ী তার আর্থিক মূল্য ৬.৭ ট্রিলিয়ন বা ৬ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। দেশের মোট জিডিপির প্রায় ১৮.৯ শতাংশের সমান এই অবদানের ৮৫.৩৭ শতাংশই এসেছে নারীদের কাছ থেকে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো’র (বিবিএস) এক জরিপে এ তথ্য ওঠে এসেছে।

বিবিএস বলছে, দৈনিক একজন নারী ৫ দশমিক ৯ ঘণ্টা অবৈতনিক কাজ করে। যা পুরুষের তুলনায় ৭ দশমিক ৩ গুণ বেশি।

রাজধানীর আগারগাঁওস্থ বিবিএস অডিটরিয়ামে মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) প্রকাশিত আনপেইড হাউজহোল্ড প্রোডাকশন স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্ট (এইচপিএসএ) অব বাংলাদেশ এ তথ্য জানানো হয়।

ব্যুরোর মহাপরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমিন এস. মুর্শিদ। বিশেষ অতিথি ছিলেন সিনিয়র সচিব, নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় মমতাজ আহমেদ এনডিসি, সচিব পরিসংখ্যান ও তথ্যব্যবস্থাপনা বিভাগ আলেয়া আক্তার ও ইউএন উইমেন বাংলাদেশের প্রতিনিধি গীতাঞ্জলি সিংহ।

প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন বিবিএসের উপপরিচালক আসমা আখতার। ইউএন উইমেনের নুবাইরা জেহেন ‘কেয়ার ক্যালকুলেটর’ নামের সরঞ্জাম ব্যবহার করে দেখান। একজন মানুষ প্রতিদিন কতটা সময় অবৈতনিক কাজে ব্যয় করেন।

উপপরিচালক আসমা আখতার জানান, সময় ব্যবহার জরিপ ২০২১ এবং শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২-এর তথ্য বিশ্লেষণ করে এই হিসাব তৈরি হয়েছে। অবৈতনিক গৃহস্থালি এবং যত্নের কাজ— যেমন রান্না, পরিষ্কার, লন্ড্রি, গৃহস্থালি ব্যবস্থাপনা এবং শিশু, বয়স্ক ব্যক্তি, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি এবং স্বাস্থ্যগত সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের যত্ন নেওয়া— অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু অদৃশ্য চালিকাশক্তি। এই কাজের বেশির ভাগই নারীরা সম্পাদন করেন যা অপরিহার্য। কিন্তু প্রচলিত অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান থেকে বাদ দেয়া হয়েছে।

আসমা জানান, ২০২১ সালে অবৈতনিক গৃহস্থালি ও যত্নের কাজ ৬.৭ ট্রিলিয়ন টাকা অবদান রেখেছে, যা জিডিপি’র ১৮.৯ শতাংশ। এই অবদানের ৮৫.৩৭ শতাংশ নারীর। বিশ্বব্যাপী মোট তিন-চতুর্থাংশের বেশি অবৈতনিক কাজ বা গৃহস্থালি কাজ এবং দুই-তৃতীয়াংশ যত্ন বা সেবামূলক কাজ নারীরা করে থাকে। প্রতিদিন নারীরা প্রায় ১২.৫ বিলিয়ন ঘণ্টা অবৈতনিক কাজ করেন। যার বার্ষিক সর্বনিম্ন মূল্য প্রায় ১০.৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। অথচ এতবড় অবদান রাখা সত্ত্বেও এ কাজকে অর্থনীতিতে যথাযথভাবে গণনা করা হয় না। জাতীয় বাজেটেও এর কোনো কিছু প্রতিফলিত হয় না। ফলে নারীর এ অবদানকে সমাজ ও নীতি নির্ধারণে অবমূল্যায়ন করা হয়।

বিবিএস বলছে, বাংলাদেশে বছরে নারী ও পুরুষের গড়ে প্রায় ২ হাজার ৪৩৫ ঘণ্টা অবৈতনিক গৃহস্থালি ও যত্নমূলক কাজে ব্যয় হয়। যার মধ্যে ৭৯ শতাংশ সময় অবৈতনিক গৃহস্থালি কাজে এবং বাকিটা অবৈতনিক যত্নমূলক কাজে ব্যয় করে থাকে। অবৈতনিক গৃহস্থালি ও যত্নমূলক কাজের মোট সময়ের মধ্যে ৮৮ শতাংশ সময় (২ হাজার ১৪৬ ঘণ্টা) নারীরা ব্যয় করে থাকে। এক্ষেত্রে, অবৈতনিক গৃহস্থালি কাজের মধ্যে ৮৯ শতাংশ এবং যত্নমূলক কাজের ৮৬ শতাংশ সময় নারীরা ব্যয় করে থাকে।

আলোচনায় উঠে আসে, আইন ও নীতিমালার মধ্যে অবৈতনিক কাজকে একীভূত করার জন্য একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। জাতীয় বাজেট এবং উন্নয়ন কৌশলগুলোতে যত্নকে অগ্রাধিকার দেয়া। উপযুক্ত যত্নের কাজ এবং পরিবার-বান্ধব কর্মক্ষেত্র নীতিমালা প্রচারে বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করা। অবৈতনিক কাজের উপর টেকসই অর্থায়ন এবং নিয়মিত তথ্য সংগ্রহ নিশ্চিত করা। পুরুষ ও ছেলেদের যত্নের দায়িত্ব ভাগাভাগি করে সামাজিক রীতিনীতিকে চ্যালেঞ্জ করা।

মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমিন এস. মুরশিদ বলেন, ‘আমরা এই সার্ভে নীতিগতভাবে সরকারের কাছে উপস্থাপন করবো। যাতে করে সরকার এটাকে পলিসিতে নিতে পারেন।’

তিনি বলেন, ‘বিশ্বের নারীদের বহুদিনের যন্ত্রণা ও প্রতিবাদের ফসল। ই্উএন এটাকে গুরুত্ব দিল। ৬০ দশক থেকে এই বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছে। আমাদের সমাজে এটা নিয়ে আমরা এখন ভাবনা ও গবেষণা করার কাজ শুরু করেছি।’

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নারীর অদেখা শ্রমের এই পরিসংখ্যান শুধু সংখ্যার হিসাব নয়, বরং নীতি ও বাজেটে লিঙ্গ-সংবেদনশীলতা বাড়ানোর জন্য এক বড় ভিত্তি। বাংলাদেশের অর্থনীতি ও উন্নয়ন পরিকল্পনায় নারীর অমূল্য অবদানকে দৃশ্যমান করার মাধ্যমে দেশ এক নতুন দিগন্তে প্রবেশ করল।