মোবাইল আর্থিক সেবা খাতে ব্যয় ব্যাংকের চেয়ে ১৫ গুণ : টিআইবি

এদেশে মোবাইল আর্থিক সেবা পেতে গ্রাহককে বাণিজ্যিক ব্যাংকের থেকে প্রায় ৭ থেকে ১৫ গুণ বেশি সেবামূল্য পরিশোধ করতে হয়।

নয়া দিগন্ত অনলাইন
টিআইবির সংবাদ সম্মেলন
টিআইবির সংবাদ সম্মেলন |সংগৃহীত

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) জানিয়েছে, এদেশে মোবাইল আর্থিক সেবা পেতে গ্রাহককে বাণিজ্যিক ব্যাংকের থেকে প্রায় ৭ থেকে ১৫ গুণ বেশি সেবামূল্য পরিশোধ করতে হয়। এমনকি প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায়ও এই সেবামূল্যের হার কয়েকগুণ বেশি।

মঙ্গলবার ‘মোবাইল আর্থিক সেবা (এমএফএস) খাতে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণার প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ মন্তব্য করে টিআইবি।

সংস্থাটি বলেছে, এমএফএসপির উদ্যোক্তা, নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি কর্তৃপক্ষ এবং রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের ত্রিপক্ষীয় আঁতাতের মাধ্যমে নীতি করায়ত্ত, তদারকি ব্যবস্থাকে প্রভাবিত এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে এমএফএস খাতকে কুক্ষিগত করেছে। জনগণকে আর্থিকভাবে শোষণ, রাষ্ট্রের অর্থ আত্মসাতের পাশাপাশি ঘুষ লেনদেন ও অর্থ পাচারের জন্যও এ খাতকে ব্যবহার করা হয়েছে। মোবাইল আর্থিক সেবাখাতে বিদ্যমান সুশাসনের চ্যালেঞ্জ উত্তরণে ১৩ দফা সুপারিশ প্রস্তাব করেছে টিআইবি।

গবেষণায় দেখা যায়, এমএফএস খাতে গ্রাহকদের সেবা পেতে বাণিজ্যিক ব্যাংকের থেকে প্রায় ৭-১৫ গুণ (৬.৯-১৫.৯ গুণ) বেশি সেবামূল্য পরিশোধ করতে হচ্ছে। ২০২৪ সালে সাড়ে পাঁচ লাখ কোটি টাকা ‘ক্যাশআউটের’ ক্ষেত্রে গ্রাহকদের থেকে প্রাক্কলিতভাবে কমপক্ষে চার হাজার ৪১০ কোটি টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১০ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা পর্যন্ত সেবামূল্য আদায় করা হয়েছে, যেখানে সমপরিমাণ নগদ উত্তোলনে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সেবামূল্য আদায় করেছে মাত্র ৬৩৯ কোটি টাকা। এমনকি প্রতিবেশি কয়েকটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশে এমএফএস সেবামূল্য সর্বোচ্চ। দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত মোবাইল আর্থিক সেবা প্রদানকারীর (এমএফএসপি) সেবামূল্য তুলনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশে (বিকাশ) ২৫ হাজার টাকা নগদ উত্তোলনে ৩৭২.৫ থেকে ৪৬২.৫ টাকা আদায় করা হয়, যেখানে সমপরিমাণ টাকা উত্তোলনে পাকিস্তানে (ইজি প্যায়সা) ৩৫৫.৭ টাকা এবং মিয়ানমারে (ওয়েভ পে) ২৩১.৩ টাকা সেবামূল্য হিসেবে আদায় করা হয়। ভারতে (ফোন পে) এ ধরনের সেবার ক্ষেত্রে কোনো সেবামূল্য আদায় করা হয় না।

গবেষণায় আরো দেখা যায়, এমএফএস খাতে গ্রাহক স্বার্থ অনেকাংশে উপেক্ষিত হয়েছে এবং পাশাপাশি প্রতারণার হার আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। পূর্ণাঙ্গ আইনি কাঠামোর অনুপস্থিতি, প্রতিষ্ঠানভেদে বৈষম্যমূলক মডেল ও শর্তারোপ, সেবামূল্য নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপের সুযোগ না থাকা এবং বিদ্যমান আইনি সীমাবদ্ধতার কারণে এমএফএস খাতে একচেটিয়া বাজার তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে বিকাশ ও নগদ বাজারের বেশিভাগ (ব্যক্তিগত হিসাবধারীদের ৮৪.৪ ভাগ বিকাশ, ৩০.৯ ভাগ নগদ) নিয়ন্ত্রণ করছে।

টিআইবির গবেষণায় দেখা যায়, এমএফএস খাতের উন্নয়ন ও বিকাশে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে। এ খাতে ‘অ্যাডহক’ সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রবণতা, নীতি দুর্বলতা, বিদ্যমান আইনের ঘাটতি এবং রাজনৈতিক ও স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে। এমএফএসপির উদ্যোক্তা, নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি কর্তৃপক্ষ এবং রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের একটি অংশ ত্রিপক্ষীয় আঁতাতের মাধ্যমে নীতি করায়ত্ত, তদারকি ব্যবস্থাকে প্রভাবিত এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে এমএফএস খাতকে কুক্ষিগত করেছে। এমএফএস খাতকে করায়ত্ত করা এবং বিদ্যমান সুশাসনের ঘাটতির ফলে এই খাতে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র সংকুচিত এবং এ খাতের সুষ্ঠু বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। একইসাথে জনগণকে আর্থিকভাবে শোষণের ও রাষ্ট্রের অর্থ আত্মসাতের সুযোগ তৈরি হয়েছে। এমএফএস ব্যবহার করে জালিয়াতি, প্রতারণা, ঘুষের অর্থ লেনদেন, অনলাইন জুয়ার অর্থ লেনদেন ও পাচারের উদ্বেগজনক চিত্র গবেষণায় উঠে এসেছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থাসমূহ বিভিন্ন সময়ে জুয়া ও বেটিং সংক্রান্ত ওয়েবসাইট, অ্যাপ, ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেল বন্ধ করার উদ্যোগ নিলেও এমএফএসপিসমূহ এই ধরনের লেনদেন রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে। শুধুমাত্র ২০২২ সালেই প্রায় ৭ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার বা ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার করা হয়েছে এমএফএস ব্যবহার করে। অপরদিকে সন্দেহজনক লেনদেন ও হুন্ডি কার্যক্রম শনাক্ত এবং প্রতিরোধে এমএফএসপিসমূহের সক্ষমতাও আশানুরূপ নয়।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এমএফএস খাত করায়ত্ত করার জন্য রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় নীতিকাঠামো ও আইনি দুর্বলতার অপব্যবহার করা হয়েছে, নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে ব্যবহার করা হয়েছে। বিশেষ করে নগদকে অনৈতিক সুযোগ দেয়ার এবং তার মাধ্যমে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী স্বার্থান্বেষী মহলের সুবিধা অর্জনের জন্য এ গুরুত্বপূর্ণ খাতের উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র বিনষ্ট করা হয়েছে। আবার নীতিকাঠামোর দুর্বলতার কারণে এ খাতে আমরা একদিকে যেমন একটি প্রতিষ্ঠানে একচেটিয়া বাজার দেখছি অন্যদিকে নারী এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্তির নামে এ অন্তর্ভুক্তি সুফল থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। সেবামূল্য নির্ধারণের এখতিয়ার এককভাবে এমএফএসপির হাতে ন্যস্ত থাকায় স্বাভাবিক ব্যাংকিং খাতের তুলনায় অনেক বেশি সেবামূল্য দিতে হচ্ছে গ্রাহকদের, যার বোঝা বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, নারী এবং অন্যান্য সুবিধাবঞ্চিতদের তুলনামূলক বেশি বইতে হচ্ছে। সেবামূল্যের এই উচ্চ হার, যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডেও অস্বাভাবিক, এ বিষয়ে অনুসন্ধানের জন্য আমরা কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানাই। গ্রাহকের ন্যায্য অধিকার রক্ষায় পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা ও আইনি কাঠামোর মাধ্যমে পুরো খাতকে ঢেলে সাজাতে হবে।’

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতনের পর ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আমাদের বৈদেশিক রেমিট্যান্সের যে রেকর্ড বৃদ্ধি হয়েছে তার অন্যতম কারণ এমএফএস ব্যবহার করে অবৈধ হুন্ডি লেনদেন নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। যদিও সুনির্দিষ্ট নীতিমালার কারণে নয়, এ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়েছে এমএফএস ব্যবহার করে অর্থপাচারে জড়িত অপশক্তির পতনের ফলে। এ দৃষ্টান্ত থেকে শিক্ষাগ্রহণ করে অন্তর্বর্তী সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এই পরিবর্তনকে স্থায়ীত্ব দিতে উদ্যোগী হবে বলে আমরা আশা করি। পাশাপাশি, আগে যে সরাসরি ঘুষ নেয়ার প্রবণতা ছিল, এখন তা এমএফএস-এর মাধ্যমে করার সুযোগ হয়েছে। তাই এমএফএস খাতকে আয়করের আওতায় আনতে হবে। এর ফলে বৈধ আয়ের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ আয়, কর ফাঁকি এবং ঘুষ লেনদেনের বিষয়সমূহ চিহ্নিত করা যাবে।’

গবেষণার প্রাপ্ত ফলাফলের আলোকে টিআইবির ১৩ দফা সুপারিশের মধ্যে রয়েছে এমএফএস খাতের জন্য স্বতন্ত্র আইন প্রণয়ন করা, যেখানে সবার জন্য সমান প্রতিযোগিতা, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিসহ সুশাসন নিশ্চিত কল্পে সংশ্লিষ্ট সকল অংশীজনের ভূমিকা সুনির্দিষ্ট করা, আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চার আলোকে এমএফএস পরিচালন ও ব্যবস্থাপনা কাঠামো নিশ্চিত করা, সেবামূল্য এবং এজেন্ট ও পরিবেশকদের কমিশনের সীমা নির্ধারণ এবং এর তদারকি নিশ্চিত করা; মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ বিধিমালা, ২০১৯ সংশোধন করে বিএফআইইউর গোয়েন্দা প্রতিবেদন সাক্ষ্য প্রমাণ হিসেবে আদালতে উপস্থাপনের বিধান করা; গ্রাহক স্বার্থ বিবেচনা করে সেবামূল্য উল্লেখযোগ্য হারে কমানো এবং সকল আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাথে আন্তঃলেনদেন ব্যবস্থা সহজ ও সাশ্রয়ী করা; এমএফএস খাতে সংঘটিত সকল অনিয়ম ও দুর্নীতির সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নির্বিশেষে অনিয়ম-দুর্নীতির সাথে সম্পৃক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা ইত্যাদি।

সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মুহাম্মদ বদিউজ্জামান। প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন টিআইবির রিসার্চ ফেলো মোহাম্মদ নূরে আলম এবং রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট কাজী আমিনুল হাসান। টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলনটি সঞ্চালনা করেন। বিজ্ঞপ্তি