১৩ বছরে পা রাখলো মাস্তুল

প্রতিষ্ঠাতা কাজী রিয়াজ রহমানের পরিশ্রমে গড়ে ওঠা এক মানবিক স্বপ্ন

নয়া দিগন্ত ডিজিটাল

বর্তমানে ফিলিস্তিনের গাঁজায় কাজ করছে এরকম কিছু বাংলাদেশের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মধ্যে মাস্তুল ফাউন্ডেশনের নামটি খুবই পরিচিত। স্বনামধন্য ও স্বেচ্ছাসেবী‌ দাতব্য প্রতিষ্ঠান “মাস্তুল ফাউন্ডেশন’ সফলভাবে ১২ বছর পূর্ণ করে আজ ১৩তম বর্ষে পদার্পণ করলো। দেশের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর পাশাপাশি বর্তমানে ফিলিস্তিনের গাজায় জরুরি মানবিক সহায়তা কার্যক্রমে সরাসরি যুক্ত হয়ে সংগঠনটি বৈশ্বিক সংকটে বাংলাদেশের মানবিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

১৩ বছরের সেবাযাত্রায় মাস্তুল ফাউন্ডেশন

২০১২ সালে তরুণ উদ্যোক্তা ও স্বেচ্ছাসেবী‌ কাজী রিয়াজ রহমানের হাত ধরে যাত্রা শুরু করা মাস্তুল ফাউন্ডেশন গত এক যুগে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান এবং জরুরি ত্রাণ ও পুনর্বাসনসহ বহুমুখী সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।

মাস্তুল ফাউন্ডেশন দেশের অভ্যন্তরে নানা ধরনের মানবিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে।

গাজায় চলমান মানবিক সহায়তা

ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় চলমান ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ে মাস্তুল ফাউন্ডেশন ২০২৪ সাল থেকে সরাসরি মিশরের কায়রোতে অবস্থান করে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সংস্থাটি গাজার যুদ্ধবিধ্বস্ত ও অসহায় পরিবারের কাছে নিয়মিতভাবে খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি, বিশেষ শিশুখাদ্য (বেবি ফুড), দুধ এবং চিকিৎসা সামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছে। বর্তমানে তাদের মিশরে কায়রোতে একটি শাখা অফিস আছে যার মাধ্যমে তারা বাংলাদেশের ও মিশরের ফিলিস্তিনের দূতাবাসের সহযোগিতা নিয়ে গাঁজার অভ্যন্তরীণ মসজিদ, এতিমখানা, হাসপাতাল পূর্ননির্মাণে কাজ করবে। এছাড়াও গাজায় চলমান দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় মাস্তুল ফাউন্ডেশন প্রতিদিন সেখানে মোবাইল কিচেনের মাধ্যমে রান্না করা পুষ্টিকর খাবার এবং শুকনো খাবারের প্যাকেট বিতরণ করছে। বিশেষত, অপুষ্টি ও পানিস্বল্পতায় ভোগা শিশুদের বাঁচানোর জন্য শিশুখাদ্য ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

কাজী রিয়াজ রহমানে

মাস্তুল ফাউন্ডেশনের ১৩ বছরের মানবিক পথচলা ও ভবিষ্যতের অঙ্গীকার নিয়ে কাজী রিয়াজ রহমান বলেন, ‘‘আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু। আলহামদুলিল্লাহ! পরম করুণাময় মহান আল্লাহ তায়ালার অশেষ রহমত ও শুকরিয়া আদায় করছি যে, তাঁরই ইচ্ছায় এবং আপনাদের সকলের অকুণ্ঠ ভালোবাসা ও সহযোগিতায় মাস্তুল ফাউন্ডেশন আজ ১৩টি বসন্ত পেরিয়ে ১৪তম বছরে পদার্পণ করেছে। এই দীর্ঘ পথচলায় প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি হাসি, প্রতিটি সাফল্য একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা'র সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই নিবেদিত।’’

তিনি আরো বলেন, ‘‘যখন মাস্তুলের বীজ বপন করেছিলাম, তখন আমার মনে শুধু একটি স্বপ্নই ছিল – সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির সেবা করা। সেই স্বপ্ন আজ আপনাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একটি মহীরুহে পরিণত হয়েছে, যা হাজারো মানুষের জীবনে আশার আলো দেখাচ্ছে। ১৩টি বছর, যেখানে আমরা অসংখ্য দুস্থ শিশু, অসহায় পরিবার, অভাবী মানুষ এবং সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়িয়েছি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য, আশ্রয় এবং জরুরি ত্রাণ সহায়তা নিয়ে আমরা মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করেছি। এই অর্জন আমার ব্যক্তিগত নয়, এ এক বিশাল কর্মযজ্ঞ, যা মহান আল্লাহ তায়ালার নির্দেশনায় এবং নিবেদিতপ্রাণ স্বেচ্ছাসেবক, কর্মী, শুভাকাঙ্ক্ষী ও দাতাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে সম্ভব হয়েছে।’’

‘‘আমরা বিশ্বাস করি, মানবসেবাই ইবাদত। মহান আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলেছেন, 'তোমরা যদি পৃথিবীতে যা আছে তার প্রতি সদয় হও, তবে আকাশেও যিনি আছেন তিনিও তোমাদের প্রতি সদয় হবেন।' এই পবিত্র নির্দেশনাই আমাদের প্রতিটি কাজের প্রেরণা। আমরা মাস্তুল ফাউন্ডেশনে বিশ্বাস করি যে, কোনো মানুষের ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে তার প্রতি মানবিকতা প্রদর্শন করা আমাদের নৈতিক এবং ধর্মীয় দায়িত্ব। আমাদের প্রতিটি কাজে আমরা সচেষ্ট থাকি যেন সৃষ্টিকর্তার নির্দেশিত পথে চলে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারি।’’

ভবিষ্যতের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

আগামী দিনে মাস্তুল ফাউন্ডেশনের লক্ষ্য আরও সুদূরপ্রসারী।

এ বিষয়ে কাজী রিয়াজ রহমান বলেন, আমরা শুধু তাৎক্ষণিক সাহায্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে চাই না, বরং একটি টেকসই পরিবর্তন আনতে চাই। আমাদের প্রধান লক্ষ্যগুলো হলো:

১. শিক্ষার সম্প্রসারণ: বাংলাদেশের প্রতিটি সুবিধাবঞ্চিত শিশুর জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা। আমরা চাই প্রতিটি শিশু যেন শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে সমাজের সুযোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠে।

২. স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন: প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় আধুনিক ও সহজলভ্য স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া। স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল, এই নীতিতে আমরা অবিচল।

৩. জীবিকানির্বাহ ও ক্ষমতায়ন: প্রশিক্ষণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে মানুষের আত্মনির্ভরশীলতা বৃদ্ধি করা এবং দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখা।

৪. দুর্যোগ মোকাবিলা ও পরিবেশ সুরক্ষা: প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানো এবং পরিবেশ রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

৫. আন্তর্জাতিক মানবিক কার্যক্রম: ফিলিস্তিনসহ বিশ্বের অন্যান্য সংকটময় এলাকায় অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের মানবিক ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করা। সম্প্রতি, 'MASTUL FOUNDATION INTERNATIONAL' এর মাধ্যমে আমরা এই লক্ষ্যেই কাজ শুরু করেছি।

তিনি আরো বলেন, এই বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করতে আমরা আবারও আপনাদের সকলের দোয়া, সমর্থন ও সক্রিয় সহযোগিতা কামনা করছি। আমাদের এই মানবিক পথচলায় আপনারা আমাদের সাথে আছেন, ভবিষ্যতেও থাকবেন – এই বিশ্বাস নিয়েই আমরা সামনে এগিয়ে যেতে চাই। মহান আল্লাহ তায়ালা যেন আমাদের এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টাকে কবুল করেন এবং আমাদের চলার পথকে আরও সুগম করে দেন। আমিন।

মাস্তুল ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ সরকারের নিবন্ধিত একটি স্বনামধন্য ও সেবামূলক জাতীয় প্রতিষ্ঠান। বিগত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে মাস্তুল ফাউন্ডেশন দেশের সুবিধাবঞ্চিত মানুষ ও শিশুদের জীবনমান উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে আসছে।

ফাউন্ডেশনের মানবিক কার্যক্রমের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো

করোনা মহামারির সময় দাফন সেবা প্রদান; ২০২২ ও ২০২৪ সালের ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে জরুরি ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ; এবং ২০২৩ সালের তুরস্কের ভূমিকম্পে বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে মানবিক সহায়তা প্রদান।

মাস্তুল ফাউন্ডেশনের অন্যতম সফল প্রকল্প "যাকাত স্বাবলম্বী" এর মাধ্যমে অসংখ্য অসহায় ব্যক্তি ও যুব সমাজের জন্য স্থায়ী কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে, যা তাদের আত্মনির্ভরশীল করে তুলছে। রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিদিন বিনামূল্যে অসহায় ও সুবিধাবঞ্চিতদের একবেলার খাবার পৌঁছে দিচ্ছে। এছাড়াও, ঢাকার হাজারীবাগ বারইখালি এলাকায় নিজস্ব মাদরাসা, সেল্টারহোম, এতিমখানা ও মেহমানখানা রয়েছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আইন অনুসারে মাস্তুল ফাউন্ডেশনকে প্রদত্ত যেকোনো পরিমাণ যাকাত, দান বা সাদাকা আয়করমুক্ত। অর্থাৎ মাস্তুল ফাউন্ডেশনে দান করা অর্থ; দাতাদের জন্য আয়কর রেয়াত হিসেবে গণ্য হবে।

মাস্তুল ফাউন্ডেশন এই শুভক্ষণে দেশ ও বিদেশের সকল সহযোগী, শুভাকাঙ্ক্ষী ও দাতাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে এবং ভবিষ্যতেও তাদের পাশে থাকার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছে।