বাংলাদেশে কারিগরি শিক্ষার হার তুলনামূলকভাবে নগণ্য

বিশ্ব যুব দক্ষতা দিবস ২০২৫ উপলক্ষে ইউসেপ বাংলাদেশের গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা

‘আজকাল অনেকেই এআই বলতে শুধু ছবি বদলানো বোঝে। কিন্তু বিশ্বের বাস্তবতায় এআই এখন কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নিরাপত্তা—সবখানেই ব্যবহৃত হচ্ছে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় কারিকুলামকেন্দ্রিক বড় পরিবর্তন দরকার, যেখানে থাকবে মানবিকতা, আচরণগত শিক্ষা ও পরিবেশ সচেতনতা।’

নয়া দিগন্ত অনলাইন
ইউসেপ বাংলাদেশের গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা
ইউসেপ বাংলাদেশের গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা |সংগৃহীত

ইউসেপ বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক মুখ্য সচিব ড. মো. আবদুল করিম বলেছেন, ‘বাংলাদেশে প্রায় ১১ কোটি কর্মক্ষম যুবতী রয়েছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাবে এই বিশাল জনশক্তি অর্থনৈতিকভাবে কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে না।’

তিনি আরো বলেন, ‘যদিও সাম্প্রতিক সময়ে কারিগরি শিক্ষার প্রতি আগ্রহ কিছুটা বেড়েছে, তবে তা এখনো আশানুরূপ নয়। যেখানে উন্নত বিশ্বে কারিগরি শিক্ষায় গুরুত্ব দিয়ে উন্নয়ন ঘটছে, সেখানে আমাদের দেশে সাধারণ শিক্ষার হার ৮০ শতাংশ হলেও কারিগরি শিক্ষার হার তুলনামূলকভাবে নগণ্য। ইউসেপ বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে মানসম্পন্ন প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে আসছে। এই উদ্যোগকে আরো জোরদার করতে সরকারের সক্রিয় সহায়তা প্রয়োজন।’

সোমবার (১৪ জুলাই) জাতীয় প্রেস ক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে ইউসেপ বাংলাদেশের উদ্যোগে ‘এআই ও ডিজিটাল দক্ষতার মাধ্যমে যুব ক্ষমতায়ন’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এসব কথা বলেন তিনি।

বিশ্ব যুব দক্ষতা দিবস ২০২৫ উপলক্ষে এই আয়োজনে সভাপতিত্ব করেন ইউসেপ বোর্ড অব গভর্নর্সের চেয়ারপারসন ড. ওবায়দুর রব। বৈঠকের মডারেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন জনপ্রিয় টকশো উপস্থাপিকা দীপ্তি চৌধুরী।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সচিব মো: রেজাউল মাকছুদ জাহেদী বলেন, ‘যুবদের ক্ষমতায়নে শুধু প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জন নয়, সেটি ধরে রাখতে মানসিকতা, মনিটরিং ও মেন্টরশিপও অত্যন্ত জরুরি। আজকের তরুণেরা যদি আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) ও ডিজিটাল দক্ষতায় পারদর্শী হয়, তবে তারাই আগামী বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেবে।’

তিনি বলেন, ‘আজকাল অনেকেই এআই বলতে শুধু ছবি বদলানো বোঝে। কিন্তু বিশ্বের বাস্তবতায় এআই এখন কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নিরাপত্তা—সবখানেই ব্যবহৃত হচ্ছে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় কারিকুলামকেন্দ্রিক বড় পরিবর্তন দরকার, যেখানে থাকবে মানবিকতা, আচরণগত শিক্ষা ও পরিবেশ সচেতনতা।’

নারী শ্রমিক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ময়মনসিংহ থেকে আসা বহু নারী ঢাকায় এসে খুবই কম পারিশ্রমিকে গৃহকর্মীর কাজ করেন। অথচ তাদের একটি কেয়ারগিভার প্রশিক্ষণ, কিছু ভাষা শিক্ষা ও আত্মবিশ্বাস দিয়ে আমরা তাদের বিদেশে উপার্জনক্ষম রফতানিযোগ্য মানবসম্পদে পরিণত করতে পারি।’

সভাপতির বক্তব্যে ড. ওবায়দুর রব বলেন, ‘যুব দক্ষতা দিবস বছরে এক দিন পালন করলেই চলবে না। প্রতিটি দিন হোক দক্ষতা উন্নয়নের দিন। আমাদের তরুণেরা বিদেশে গিয়ে প্রায়শই অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে, যেখানে পার্শ্ববর্তী দেশের কর্মীরা দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে সুপারভাইজার পর্যায়ে পৌঁছাচ্ছে এবং ভালো পারিশ্রমিক পাচ্ছে। দক্ষতার কোনো বিকল্প নেই।’

তিনি জানান, ‘জাপানে কেয়ারগিভার পেশার চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই বাজার ধরতে হলে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন কেয়ারগিভার তৈরি করতে হবে। ইউসেপ বাংলাদেশ ও বিআইএইচএস জেনারেল হাসপাতাল যৌথভাবে একটি আধুনিক কেয়ারগিভার ইনস্টিটিউট গড়ার পরিকল্পনা করেছে।’

সাবেক চেয়ারপারসন জেবা রশিদ চৌধুরী বলেন, ‘দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সার্বিক সংস্কার করতে হবে, আর এই দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। কারিগরি শিক্ষাকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য গণমাধ্যম ও সামাজিক প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি করা জরুরি।’

ড. আলাউদ্দিন বলেন, ‘আমরা এখনো মূলত প্রশিক্ষণকে কেবল টেকনিক্যাল দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখি। অথচ সফট স্কিল—যেমন যোগাযোগ দক্ষতা, নেতৃত্বগুণ, সমস্যা সমাধান—এসবকে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত না করলে কর্মক্ষেত্রে পরিপূর্ণ দক্ষতা অর্জন সম্ভব নয়।’

কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের যুগ্ম সচিব ফাতেমা জাহান বলেন, ‘দেশে বর্তমানে প্রায় ৫০ লাখ শিক্ষার্থী মাদরাসায় অধ্যয়নরত। তবে খুব অল্পসংখ্যক মাদরাসায় ভোকেশনাল ট্রেড চালু হয়েছে। আমরা ভবিষ্যতে আরো এক হাজার মাদরাসায় এই ট্রেড চালু করতে চাই। কিন্তু তার জন্য দরকার মানসিকতার পরিবর্তন। সমাজের প্রতিটি স্তর থেকে দায়িত্ব নিতে হবে।’

তিনি আরো বলেন, ‘আজকের তরুণদের হাতে স্মার্টফোন থাকলেও তারা এর নেতিবাচক ব্যবহারে বেশি আকৃষ্ট। তাই প্রযুক্তি ব্যবহারে নৈতিক শিক্ষার বিকল্প নেই।’

বৈঠকে আরো বক্তব্য দেন ইউসেপ বোর্ডের সদস্য জিতেন্দ্রলাল ভৌমিক, অ্যাসোসিয়েশন সদস্য মো: হাবিবুর রহমান, বিআইএইচএস জেনারেল হাসপাতালের মহাপরিচালক ফজলুর রহমান এবং ঢাকা টেকনিক্যাল টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ ড. মো: সাকাওয়াৎ আলী।

বক্তারা বলেন, ‘এআই, ডিজিটাল লিটারেসি, সফট স্কিল এবং উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যুব সমাজকে প্রস্তুত করতে হবে। টেকসই সমাজ ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম।’