পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশ সম্প্রতি ‘কার্যকর বাজেট পরিকল্পনার মাধ্যমে বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিতকরণ : বাজেট ২০২৫-২৬ এর অগ্রাধিকার’ শীর্ষক একটি গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করেছে। বৈঠকে সরকার, বেসরকারি শিল্প ও চেম্বার অব কমার্সের প্রতিনিধি ও থিংক ট্যাংকসসহ গুরুত্বপূর্ণ স্টেকহোল্ডাররা একত্রিত হন এবং ২০২৫–২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটকে সামনে রেখে অর্থ বরাদ্দে মূল বিবেচ্য বিষয় ও উন্নয়ন লক্ষ্যবস্তু নিয়ে আলোচনা করেন।
বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও সিইও ড. এম. মাসরুর রিয়াজ। বৈঠকে এনবিআর, বিডা, এফএমসিজি, তামাক, আরএমজি, কৃষি, টেলিকম, ফরেইন চেম্বারের বিভিন্ন প্রতিনিধি এবং অর্থনীতিবিদ ও কর বিশ্লেষকরা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে বক্তারা বলেন, এবারের জাতীয় বাজেট দেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ, যা দেশীয় সম্পদ সংগ্রহ জোরদার, অর্থ বরাদ্দে মূল বিবেচ্য বিষয়সমূহ পুনর্গঠন এবং টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য সম্পদের কার্যকর বণ্টন নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে। আলোচনায় কৌশলগত পরিকল্পনা ও কার্যকর বাস্তবায়নের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়, যাতে দেশে ব্যাপক পরিমাণ উন্নয়ন নিশ্চিত করা যায়।
বৈঠকে এনবিআরের ভ্যাট ইমপ্লিমেন্টেশন ও আইটি বিভাগের সদস্য মোহাম্মদ বেলাল হোসেন চৌধুরী বলেন, “আমরা হয়রানি কমাতে ও অনুমোদন ব্যবস্থা উন্নত করতে অটোমেশন নিয়ে কাজ করছি। আমাদের সহযোগিতা প্রয়োজন এবং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমাদেরকে অবৈধ বাণিজ্য সম্পর্কে যথাযথ তথ্য জানাতে হবে। আর্থিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সহযোগিতামূলক পদ্ধতি প্রয়োজনীয় ভূমিকা রাখবে।”
কর ব্যবস্থার কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ প্রসঙ্গে এনবিআরের সাবেক সদস্য ও এনবিআরের সংশোধনী কমিটির সদস্য ফরিদ উদ্দিন বলেন, “আমাদের করের ৮০ শতাংশই পরোক্ষভাবে আসে এবং এই সিস্টেমটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী উন্নয়নশীল অর্থনীতির জন্য উপযুক্ত নয়। পর্যায়ক্রমে পরিবর্তন না করে মৌলিক সংস্কার প্রয়োজন। উচ্চ টিডিএস ও বহুস্তর ভ্যাট হারের মতো সমস্যা দূর করতে রাজনৈতিক অঙ্গীকার অপরিহার্য। আমি একটি ন্যায়সঙ্গত কর ব্যবস্থা গঠনে প্রয়োজনীয় সংস্কারের আহ্বান জানাচ্ছি।”
বিডা’র ডিরেক্টর জেনারেল আরিফুল হক বলেন, “রাজস্ব ও বিনিয়োগ একই মুদ্রার দু’টি দিক। আমরা অটোমেশনের পাশাপাশি নীতিমালা যেন সংগতিপূর্ণ হয় সে জন্য চাপ দিচ্ছি, কিন্তু আমলাতান্ত্রিক মানসিকতার রূপান্তরও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। ভূমি, শক্তি ও কর নীতিমালা একত্রিত করে সংস্কার করতে হবে এবং নীতি সংস্কারে একটি সামগ্রিক পদ্ধতি প্রয়োজন।”
জেটি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স ও কমিউনিকেশন বিভাগের ডিরেক্টর গিনতাউতাস দিরগেলা বলেন, “এ বছর জানুয়ারিতে অফ-সাইকেল কর বৃদ্ধির পর কর্তৃপক্ষের সাথে আমাদের খোলামেলা আলোচনা হয়েছে। একটি দায়িত্বশীল সংস্থা হিসেবে আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রাজস্ব সংগ্রহের প্রচেষ্টাকে সম্পূর্ণরূপে সমর্থন করি, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে পুনরায় শক্তিশালী করতে ও সামাজিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে সহায়তা করবে। আমরা ধারাবাহিক কর বৃদ্ধির আন্তর্জাতিক সেরা অনুশীলনগুলো শেয়ার করেছি, যা কালোবাজারের সুযোগ বৃদ্ধি না করেই রাজস্ব বৃদ্ধি করবে। তামাক খাত থেকে আগত রাজস্বকে সময়ের সাথে সাথে দৃঢ়, পূর্বানুমানযোগ্য এবং টেকসই বা স্থিতিশীল হতে হবে।”
খাত-নির্দিষ্ট ঝুঁকি ইঙ্গিত করে ডিবিএল গ্রুপের চিফ সাস্টেইনেবিলিটি অফিসার মোহাম্মদ জাহিদুল্লাহ বলেন, “পোশাক শিল্প জ্বালানি সংকট ও কার্বন কর থেকে অস্তিত্বগত হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। নবায়নযোগ্য শক্তি অংশীদারিত্ব ও পরিবেশ-বান্ধব কারখানার জন্য কর প্রণোদনা ছাড়া অর্ডারগুলো ভিয়েতনাম বা ভারতে স্থানান্তরিত হয়ে যাবে।”
গ্রামীণফোন লিমিটেডের কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স বিভাগের সিনিয়র ডিরেক্টর হোসেন সাদাত বলেন, “একজন ভোক্তা ১০০ টাকা রিচার্জ করলে ৩৯ টাকা কর দেয়, যা ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তিকে বাধাগ্রস্ত করছে। তাই খাতের প্রবৃদ্ধি ও রাজস্ব স্থিতিশীলতার জন্য ভ্যাট ও এসডি যুক্তিসঙ্গত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তিকে উৎসাহিত করতে আরো ভারসাম্যপূর্ণ কর নীতি চালু করা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।”
নেসলে বাংলাদেশের সিনিয়র ম্যানেজার ও হেড অব ট্যাক্সেশন রেজাউল করিম বলেন, “মুদ্রাস্ফীতি ভোক্তা চাহিদা কমিয়ে দিয়েছে। ভ্যাট রিটার্ন সহজকরণ ও কর্পোরেট করের হার কমিয়ে আনলে তা ব্যবসার খরচ কমাতে, ভোক্তার ব্যয় উৎসাহিত করতে এবং রাজস্ব বাড়াতে সহায়তা করতে পারে।”
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. আশিকুর রহমান বলেন, “বিগত দশক ধরে আমরা কম-কর নেট, পরোক্ষ করের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করে আসছি। সাহসী সংস্কার ছাড়া আমাদের আর্থিক ঘাটতি বেসরকারি বিনিয়োগকে ক্রমাগতভাবে বাধাগ্রস্ত করবে।”
এসএমএসির ম্যানেজিং পার্টনার স্নেহাশিস বড়ূয়া বলেন, “এসএমই ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে একই কর-কোড প্রযোজ্য হওয়া উচিত নয়। আমাদের পৃথক এসএমই কর ব্যবস্থা এবং কম টিডিএস হার প্রয়োজন, যাতে কমপ্লায়েন্ট করদাতাদের শাস্তি দেওয়া বন্ধ করা যায়।”
এফআইসিসিআইর এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর টি.আই.এম. নূরুল কবির বলেন, “বিনিয়োগকারীদের অনুমানযোগ্যতা প্রয়োজন। তাৎক্ষণিক লক্ষ্য দ্বারা নয়, বরং প্রভাব মূল্যায়ন করে বাজেটগুলো পরিচালিত হতে হবে। এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন সামনে রেখে বাংলাদেশ অসামঞ্জস্যপূর্ণ নীতি গ্রহণ করতে পারে না। আমরা চাই সঙ্গত ও সঠিক তথ্যভিত্তিক নীতি চালু হোক।”
ড. এম. মাসরুর রিয়াজের সংক্ষিপ্তসার দিয়ে গোলটেবিল বৈঠকটি শেষ হয়। তিনি বলেন, “এই সংলাপের মাধ্যমে নতুন দিনের সূচনা হচ্ছে। আমরা এনবিআর ও বিডা’র জন্য প্রস্তাবনাগুলো সংকলন করবো এবং আজকের আলোচ্য বিষয়গুলো ২০২৫-২৬ বাজেটে উত্থাপিত করার চেষ্টা করবো।” তিনি গোলটেবিলের অন্তর্দৃষ্টিগুলোকে কার্যকর নীতি সুপারিশে অনুবাদ করার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন।
শীর্ষ ভূমিকা পালনকারী খাতগুলোর জন্য মূল সুপারিশ:
কৃষি-বাণিজ্য ও এফএমসিজি: কৌশলগত নীতিগুলো প্রচার করুন, অ-সম্মতি মোকাবেলা করুন ও অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্য চ্যানেলগুলিকে আনুষ্ঠানিক কর ব্যবস্থায় একীভূত করা।
টেলিযোগাযোগ: বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে করের হার কমান, দীর্ঘমেয়াদী প্রবৃদ্ধি ও রাজস্ব সংগ্রহ বৃদ্ধি করা।
তামাক: অবৈধ বাণিজ্য সম্প্রসারণ এড়াতে বিদ্যমান করের স্তর ও মূল্য বজায় রাখা। কর সংগ্রহকে অনুকূল করতে কর কাঠামো সংস্কার করা, যাতে কর ফাঁকি দেওয়ার উৎসাহ না দেওয়া হয়।
বৈঠকের সমাপনী অংশে সবাই একমত হন যে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও সামাজিক উন্নয়ন প্রতিশ্রুতিগুলোকে কার্যকরভাবে সমর্থন করতে সরকার, বেসরকারি খাত ও নাগরিক সমাজের মধ্যকার বৃহত্তর সহযোগিতা অপরিহার্য।



