বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে দীর্ঘদিনের আলোচিত সংস্কার পরিকল্পনার বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক দুর্বল পাঁচ শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক— সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংককে একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে। সদ্য প্রণীত ব্যাংক রেজুলেশন অধ্যাদেশ ২০২৫ এর অধীনে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হচ্ছে। আগামী অক্টোবরের মধ্যেই প্রক্রিয়া শুরু করার লক্ষ্য নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, এই পদক্ষেপের উদ্দেশ্য হলো দুর্বল ব্যাংকগুলোকে ভেঙে একটি নতুন, টেকসই ও নিয়ন্ত্রিত আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর পরিচালক, গ্রাহক ও বিশেষজ্ঞদের মধ্যে এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
খেলাপি ঋণ ও আর্থিক দুর্বলতা
বৈশ্বিক অডিট প্রতিষ্ঠান কেপিএমজি ও আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়ং পরিচালিত ফরেনসিক অডিটে দেখা গেছে, এই ব্যাংকগুলোর ঘোষিত খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রকৃত অবস্থার তুলনায় অনেক কম দেখানো হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী—
ইউনিয়ন ব্যাংক: ৯৭.৮০% খেলাপি ঋণ
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক: ৯৬.৩৭%
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক: ৯৫%
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক: ৬২.৩০%
এক্সিম ব্যাংক: ৪৮.২০%
এমন পরিস্থিতি ব্যাংকিং খাতের সামগ্রিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি। ফলে একীভূতকরণ ছাড়া বিকল্প পথ নেই বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
অর্থনৈতিক মূল্য বনাম ব্র্যান্ড ভ্যালু
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাথমিক অনুমান অনুযায়ী, এই প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হতে পারে। অর্থের বড় অংশ ব্যয় হবে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে।
তবে সমালোচকরা বলছেন, এভাবে ব্যাংকগুলো বিলুপ্ত করলে কমপক্ষে ৫ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্ট হবে। শাখা ভাড়া চুক্তি, ব্যাংক ভল্ট, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, বৈদেশিক বাণিজ্য চুক্তি ও রেমিট্যান্স চ্যানেলসহ অনেক অবকাঠামো বাতিল হয়ে যাবে। এতে দীর্ঘদিনে গড়ে ওঠা ব্র্যান্ড ভ্যালু পুরোপুরি হারিয়ে যাবে।
রাজনৈতিক ও নীতি-সংক্রান্ত দিক
এ সিদ্ধান্ত এমন এক সময় এলো, যখন সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্বাচনের আগে ব্যাংক খাতে আস্থা ফিরিয়ে আনার চাপে রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর আগেই ঘোষণা দিয়েছিলেন, নির্বাচনের আগেই একীভূতকরণ সম্পন্ন করা হবে।
এখানে রাজনৈতিক বাস্তবতাও গুরুত্বপূর্ণ। দুর্বল ইসলামী ব্যাংকগুলো বহু বছর ধরেই রাজনৈতিক প্রভাব ও কেলেঙ্কারির সাথে জড়িত ছিল। ফলে একীভূতকরণ শুধুমাত্র অর্থনৈতিক নয়; বরং রাজনৈতিক সংস্কারের অংশ বলেও দেখা হচ্ছে।
সামাজিক প্রভাব : গ্রাহক ও কর্মী
এই পাঁচ ব্যাংকের সম্মিলিত গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ৯২ লাখ। আমানত রয়েছে ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা, শাখা ৭৭৯টি এবং কর্মী ১৫ হাজারের বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংক আশ্বাস দিয়েছে— কোনো কর্মীর চাকরি যাবে না এবং আমানতকারীরাও সব অর্থ ফেরত পাবেন। তবুও বাজারে উদ্বেগ রয়ে গেছে। অনেক গ্রাহক ইতোমধ্যেই বিকল্প ব্যাংকের দিকে ঝুঁকছেন, যা সাময়িক তারল্য সঙ্কট বাড়াতে পারে।
সম্ভাব্য সঙ্কট
১. অর্থনৈতিক ব্যয়বহুলতা– একীভূতকরণে যে বিপুল অর্থ ব্যয় হবে, তা দিয়ে যদি সরাসরি তারল্য সহায়তা দেয়া হতো, তবে ব্যাংকগুলো হয়তো পুনরুদ্ধার করতে পারত।
২. সম্পদ ধ্বংস– একীভূত প্রক্রিয়ায় হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ অকার্যকর হয়ে যাবে।
৩. বাজার আস্থা সঙ্কট– গ্রাহক ও আমানতকারীদের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লে সামগ্রিক ব্যাংক খাত অস্থির হতে পারে।
৪. নীতি প্রশ্ন– কেন এত দেরি করে ব্যবস্থা নেয়া হলো এবং কেন অন্যান্য শক্তিশালী ব্যাংকের তুলনায় শুধু শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোকে টার্গেট করা হলো—এ নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
সম্ভাবনা ও ইতিবাচক দিক
তবে একীভূতকরণ সফল হলে—একটি শক্তিশালী ইসলামী ব্যাংক গড়ে উঠবে, খেলাপি ঋণ ব্যবস্থাপনায় নতুন অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি ভূমিকা রাখতে পারবে, নিয়ন্ত্রক সংস্থার তদারকি জোরদার হবে এবং আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের বিশ্বাসযোগ্যতা কিছুটা পুনরুদ্ধার হতে পারে।
উপসংহার
বাংলাদেশ ব্যাংকের এই একীভূতকরণ পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে সাহসী ও প্রয়োজনীয়। তবে এর অর্থনৈতিক ব্যয়, সামাজিক প্রভাব এবং রাজনৈতিক তাৎপর্য সব মিলিয়ে এটি দেশের ব্যাংক খাতের জন্য একটি টার্নিং পয়েন্ট হয়ে দাঁড়াতে পারে। সঠিক বাস্তবায়ন হলে এটি ব্যাংকিং খাতকে দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীল করবে, আর ব্যর্থ হলে নতুন আর্থিক সঙ্কট ও আস্থা সঙ্কট সৃষ্টি করবে।