জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) গত কয়েকদিন ধরেই ছিল আলোচনায়। সরকারের এই প্রতিষ্ঠানে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া এবং দুর্নীতির অভিযোগে বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরুর পর সেই আলোচনা আরো ডালপালা মেলেছে।
গত সপ্তাহের শুরুর দিকে শনিবার ও রোববার টানা দু’দিনের কর্মবিরতি পালন করেন এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এতে করে বন্ধ হয়ে যায় সরকারের রাজস্ব আদায়। অন্যদিকে আমদানি-রফতানি স্থবির হয়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরাও পড়েন ক্ষতির মুখে।
একপর্যায়ে সরকার কঠোর অবস্থানে যায়। ফলে গত ২৯ জুন আন্দোলন প্রত্যাহার করে আন্দোলনকারীরা। এতে মধ্যস্থতা করেন ব্যবসায়ী নেতারা।
তবে আন্দোলন প্রত্যাহারের কয়েকদিন পর গত বুধবার এনবিআরের চার কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠায় সরকার। চট্টগ্রামের কাস্টমস কমিশনারকে করা হয় সাময়িক বরখাস্ত।
এই একইসময়ে আবার তৎপর হতে দেখা যায় দুদককে। তারা দু’দফায় এনবিআরের ১১ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরু করে। কিন্তু এনবিআরকে কেন্দ্র করে যে এতকিছু ঘটলো তার কারণ কী? আর এসবের পেছনে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগই বা বারবার কেন সামনে আসছে?
‘দুর্নীতির সুযোগ বন্ধ হওয়ায়’ আন্দোলন?
এনবিআর নিয়ে সমস্যার শুরু মূলত গত মে মাসে যখন সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে এনবিআর বিলুপ্ত করার ঘোষণা দেয়। পাশাপাশি তৈরি করে দু’টি আলাদা বিভাগ।
এর একটির নাম ওতওয়া হয় রাজস্ব নীতি, আরেকটি রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ।
রাজস্ব নীতি বিভাগ কর বসাবে, করের হার বৃদ্ধি বা কমানোর বিষয়টি ঠিক করবে। আর কর আদায় করবে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ।
কর আদায় বাড়ানো, স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা এবং এনবিআর সংস্কারের অংশ হিসেবে এমন আলাদা দু’টি স্বাধীন বিভাগ তৈরির পরামর্শ দীর্ঘদিন ধরেই দিয়ে আসছিলেন ব্যবসায়ী এবং অর্থনীতিবিদরা। কারণ তাদের মতে, একই সংস্থার কাছে নীতি প্রণয়ন ও কর আদায়ের দায়িত্ব থাকায় তাতে কর ব্যবস্থায় জটিলতা দেখা দিয়েছে। এতে করে নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন ব্যবসায়ী ও করদাতারা।
কিন্তু এনবিআর বিলুপ্তির অধ্যাদেশ জারির পরই এটা নিয়ে অসন্তোষ তৈরি হয় এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে। তারা ‘এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের’ ব্যানারে আন্দোলনে নামেন।
এর পেছনে কয়েকটি কারণ উল্লেখ করা হয়-
১। এনবিআর বিলুপ্ত করে নতুন যে দু’টি বিভাগ তৈরি করা হবে সেখানে প্রশাসন ক্যাডার থেকে জনবল নিয়োগের সুযোগ রাখা হয়। আন্দোলনকারীরা এর বিরোধিতা করছেন।
২। এই বিভক্তির ফলে বিভাগীয় প্রধান কিংবা সরকারি চাকরির শীর্ষ কয়েকটি গ্রেডে শুল্ক ক্যাডারের কর্মকর্তারা সুযোগ পাবেন না বলে মনে করেন আন্দোলনকারীরা।
৩। তারা চান এনবিআর হবে দুদকের মতো স্বাধীন ও ক্ষমতাশালী যারা নিজেদের নীতি, সিদ্ধান্ত নিজেরাই প্রণয়ন করতে পারবে।
এনবিআর সংস্কার ঐক্যপরিষদের আন্দোলন থেকে পরে এনবিআর চেয়ারম্যানেরও পদত্যাগ দাবি করা হয়।
তবে গত ২৮ ও ২৯ জুনের আন্দোলনে সারাদেশে শুল্ক আদায় ও আমদানি-রফতানি কার্যক্রম স্থবির হয়ে গেলে সরকার তো বটেই, ক্ষতির মুখে পড়েন ব্যবসায়ীরাও।
আন্দোলনের উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন তোলেন কেউ কেউ। কর্মকর্তাদের ‘দুর্নীতির সুযোগ বন্ধ হওয়ায়’ এমন আন্দোলন কি-না সে প্রশ্নও ওঠে।
ওই সময় এনবিআরের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে দেশের শীর্ষস্থানীয় ১৪টি ব্যবসায়ী সংগঠনের পক্ষ থেকে যৌথভাবে আয়োজিত জরুরি সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন বা বিটিএমএর সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, ব্যবসায়ীরা এনবিআরের কাছে অসহায়।
তিনি বলেন, ‘আসলে প্রকৃতপক্ষে আমরা যারা ব্যবসা করি, আমরা সবসময়ই এনবিআর-কাস্টমসের সাথে সুসম্পর্ক রেখেই ব্যবসা পরিচালনার চেষ্টা করি। কারণ, বাস্তবতা হলো আমরা তাদের কাছে জিম্মি। আজকে যেটা আপনারা লক্ষ্য করছেন, এটা কিছুই নয়।’
তিনি বলেন, ‘এটা অ্যাকচুয়ালি ক্ষমতার একটা বণ্টন নিয়ে ঝগড়া হচ্ছে, টাকা-পয়সার বণ্টন নিয়ে ঝগড়া হচ্ছে। মাঝপথে আমরা হচ্ছি বিপদগ্রস্ত। এরা সারা জীবন আমাদের জ্বালিয়েছে। এখন সরকারকে জ্বালাচ্ছে। এখন পুরো জাতিকে জ্বালাবে।’
‘ঘুসের ওপরে ঘুস’ এনবিআরের দুর্নীতি নিয়ে ক্ষোভ
এনবিআরে দুর্নীতি ছাড়া কাজ হয় না এমন অভিযোগ বহু ব্যবসায়ীর। বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন বা বিকেএমইএ-এর নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামিম এহসান বলেন, ঘুষ ছাড়া এনবিআরে কাজ করাই দায়।
তিনি বলেন, ‘বলতে পারেন ঘুষের ওপরে ঘুষ দিতে হয়। মানে যে ঘুষটা আমাদের দিতে হয়, সেটা তো আমরা অনেক সময় কোম্পানির খরচের হিসাবে কাগজে-কলমে দেখাতে পারি না। ফলে আদার এক্সপেন্স (অন্যান্য খরচ) নামে যে খরচের খাতে এই ঘুষের খরচটা লিখতে হয়, সেটা অ্যাপ্রুভ করতে আবারো ঘুষ দিতে হয়। মানে ঘুষের ওপরে ঘুষ।’
তার মতে, এনবিআরে এমন সব আইন করা হয়েছে যেটা মানা বাস্তবে সম্ভব নয়। ফলে আইনের হাত থেকে বাঁচতে ‘বাধ্য হয়েই ঘুস দিতে হয়’।
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘দেখেন এখানে সিস্টেম হচ্ছে, যখন আপনি রফতানি করবেন তখন আপনি ভ্যাট অফিসে খবর দেবেন। সে আপনাকে একটা ডকুমেন্টস দেবে। প্রতিটা ট্রাকের সাথে সেই ডুকমেন্টসটা চট্টগ্রাম বন্দরে যাবে। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ থেকে তখন সেটাকে অ্যাপ্রুভ করে এনে আবার ভ্যাট অফিসে জমা দেবে।’
ফজলে শামিম এহসান বলেন, ‘এটা তো সম্ভব নয়। আমার যদি রাত ১২টায় শিপমেন্ট হয়, তখন কি ভ্যাট অফিসারকে আমি পাব? শুধু নারায়ণগঞ্জেই যত গার্মেন্টস আছে, এখানে তিন শ’ গার্মেন্টসের যদি একদিনে রফতানি আইটেম থাকে, সেটা অ্যাপ্রুভ করার মতো পর্যাপ্ত অফিসার আছে নারায়ণগঞ্জ? তো এসব আইন বাস্তবায়নযোগ্য না। কিন্তু যখন আমি এটা মানবো না, তখন যদি আমাকে এসে বলা হয় আপনি আইন মানেননি, তখন আমি ঘুষ না দিয়ে কোথায় যাব?’
এনবিআরে দুর্নীতির এমন যত অভিযোগ সেগুলো নতুন নয়। সেবাখাতে দুর্নীতি নিয়ে ২০২৪ সালে প্রকাশিত টিআইবির সর্বশেষ রিপোর্টেও এনবিআরের অনিয়ম-দুর্নীতির কথা উঠে আসে।
যেখানে বলা হয়, এনবিআরে সেবা নিতে যাওয়া খানার মধ্যে ১৭ দশমিক ৯ শতাংশ খানা অনিয়ম-দুর্নীতির শিকার হয়েছে।
জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এনবিআর এমন অবস্থায় পৌঁছে গেছে যে এটা ‘দুর্নীতিবাজদের জন্য একটা স্বর্গ’।
তিনি বলেন, ‘যেসব তথ্য-উপাত্ত এর আগে প্রকাশিত হয়েছে, বিভিন্ন মামলার পরিপ্রেক্ষিতে দুদক এর আগে যেসব কথা বলেছে, তাতে এটা প্রতিষ্ঠিত যে এনবিআরে যারা কর ফাঁকি দিতে চায়, অবৈধ লেনদেন করতে চায়, অর্থপাচার করতে চায়, তাদের জন্য এনবিআর স্বর্গ। কিন্তু যারা আইন মেনে কর দিতে চান তাদেরকে একরকম জিম্মি করে অর্থ আদায় করা হয়। এটা যে শতভাগ হচ্ছে তেমনটা বলব না। তবে সার্বিক চিত্র এমনই।’
তার মতে, রাজস্ব আদায় সুষ্ঠুভাবে না হওয়ায় রাজস্ব ঘাটতি হচ্ছে, রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এখানে এর আগে ছাগলকাণ্ডে অভিযুক্ত ব্যক্তির দুর্নীতির কথা আমরা গণমাধ্যমে দেখেছি। এরকম যারা আছে, তাদের কয়েকজনের ফাইল ট্র্যাক করে তারা কাদের কর ফাঁকি এবং তার মাধ্যমে অর্থ পাচারের সুযোগ করে দিয়েছেন, সেটা যদি বের করা হয় তাহলে পরিষ্কারভাবেই দেখা যাবে যে বাংলাদেশে কেন কর আদায় কম হয়, কেন আমরা রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছি, কেন এখানে কর-জিডিপি দক্ষিণ এশিয়ার সর্বনিম্ন।’
ব্যক্তি স্বার্থ বনাম জাতীয় স্বার্থ
দেখা যাচ্ছে, শুধু ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগ নয়, এনবিআর তার মূল কাজ অর্থাৎ রাজস্ব আহরণেও দুর্বল। বাংলাদেশে কর-জিডিপি অনুপাত আটের নিচে। দেশটি গত ৫০ বছরে কখনই রাজস্ব আদায়ের প্রাথমিক লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি, বরং রাজস্ব ঘাটতি হয়েছে প্রতিবছর।
এছাড়া সুবিধামতো আইন প্রণয়ন এবং আইনের ফাঁদে ফেলে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগও আছে।
সব মিলিয়ে এনবিআরে বড় ধরনের সংস্কার ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না বলেই মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্রাটেজিক স্টাডিজের গবেষণা পরিচালক ড. মাহফুজ কবীর বলেন, যে আন্দোলন হয়েছে সেটা জাতীয় স্বার্থে না হয়ে বরং ব্যক্তিগত স্বার্থে হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘সবার কাছেই একটা প্রশ্ন যে এনবিআরে অস্বচ্ছতা আছে। তারা নিজেরাই নীতি ঠিক করছেন, নিজেরাই বাস্তবায়ন করছেন। ফলে এখানে আলাদা প্রতিষ্ঠান দরকার ছিল। এখন আন্দোলনকারীদের মূল কথা হলো যেই অধ্যাদেশ জারি হয়েছে, সেটার সংশোধন লাগবে। কিন্তু যে কারণে আন্দোলন হচ্ছে, সেটা ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত। এখানে জাতীয় স্বার্থে যে আন্দোলন হয়েছে ব্যাপারটা সেরকম নয়। ক্যাডারের বাইরে থেকে এখানে লোক নিয়োগ হতেই পারে। এটা অস্বাভাবিক নয়।’
এখন কী হবে?
আন্দোলকারীরা গত রোববারই আন্দোলন প্রত্যাহার করেছেন। এরপর গত কয়েকদিনে সরকার বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছে।
দুর্নীতি দমন কমিশনও বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরু করেছে। অন্যদিকে এনবিআরে কী সংস্কার, কিভাবে হবে সেটা নিয়ে সরকার একটি পাঁচ সদস্যের উপদেষ্টা কমিটি গঠন করেছে।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি আলাপ-আলোচনা করে সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে আন্দোলনকারীসহ সবার কথা শুনে সুপারিশ করবে কিভাবে কী করা যায়।’
সূত্র : বিবিসি