দুর্নীতি প্রসঙ্গ টেনে মির্জা ফখরুল

বেগুন গাছে বেগুন হয়, কমলা না

ছাত্র-জনতার গণঅভুত্থানের মধ্য দিয়ে একটা নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, ৫৩ বছরে আমরা একটা নিয়মিতভাবে, শান্তিপূর্ণভাবে, ক্ষমতা হস্তান্তরের বা ক্ষমতা পরিবর্তনের বিধানই তৈরি করতে পারিনি।

অনলাইন প্রতিবেদক
আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর
আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর |নয়া দিগন্ত

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, কথাগুলো খুব জোরে বলছি, আমার মনে হয়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক যে সঙ্কট, এই সঙ্কটের আরেকটা কারণ হচ্ছে দুর্নীতি। ধীরে ধীরে এটা আরো খারাপের দিকে গেছে। উপজেলা ইলেকশন হয়েছে, উপজেলা চেয়ারম্যান একজন হয়েছেন। উপজেলার চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান- এদের দায়িত্ব যে কাজগুলোর সেটা সংসদ সদস্য নিয়ে নিয়েছেন। যেটা তার কাজ নয়, অর্থাৎ সিস্টেমটাই এমন হয়েছে রাষ্ট্রের। যেটা সে দখল করে নিয়েছে। বিচ্ছিন্নভাবে সুরক্ষার বিষয়ে আলোচনা করে সমাধান করা যাবে বলে আমার মনে হয় না। আমরা মনে করি, বিশ্বাস করি আসলে কাঠামোটা সংস্কার।

একজন শিক্ষকের উদ্ধৃতি টেনে তিনি বলেন, ‘তুমি যদি বেগুন গাছ লাগাও সেখান থেকে আমরা বেগুন আশা করব, কমলা তো হয় না।’ আমাদের এই সিস্টেমটাকে পরিবর্তন করতে হবে। বৈষম্য আমাদের এই সমাজে, একটা শ্রেণীকে আরেকটা শ্রেণী শোষণ করছে। বর্তমান সুযোগ কাজে লাগিয়ে বৈষম্যহীন একটা সমাজের কাছাকাছিও নিয়ে যেতে পারি, তাহলে হয়তোবা আমাদের গণঅভ্যুত্থানের কিছুটা মূল্য হয়তো পাব। আমাদের ছেলেরা প্রাণ দিলো সেটারও কিছুটা হয়তো মূল্যায়ন করতে পারব।

আজ শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের মানিক মিয়া হলে ‘তারুণ্যের সংলাপ-সামাজিক সুরক্ষা কতটা সু-রক্ষিত?’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন। এ সভার আয়োজন করে অর্পণ আলোক সংঘ। সভায় দেশের বিভিন্ন পর্যায়ে সংগঠক, অর্থনীতিবিদ এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বক্তব্য রাখেন।

মির্জা ফখরুল বলেন, গোটা জাতি যে বিষয়টা নিয়ে অত্যন্ত বেশি চিন্তিত, আলোচনা করছে, কনসার্ন হচ্ছে, সেটা হলো সংস্কার, রাষ্ট্র কাঠামোর সংস্কারের চূড়ান্ত পর্যায়ে আমরা এখন আসতে পারিনি। আবার নির্বাচন নিয়েও একই ব্যাপার। জাতি এখন ওই দিকেই কিছুটা মনোনিবেশ করেছে।

এই সমস্যাগুলো ও বিষয়গুলো নিয়ে দীর্ঘদিন কথা বলেছি, সংগ্রাম-লড়াই করেছি জানিয়ে তিনি বলেন, এটা মুহূর্তের মধ্যে সমাধান হয়ে যাবে- এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। এবং আমরা এখন যে সংস্কার, রাষ্ট্র কাঠামো সংস্কারের কথা বলছি। একই সাথে অনেকে অর্থনৈতিক কাঠামোর কথাও বলছি। দীর্ঘদিনের অনাচার, নৈরাজ্য, দুর্নীতিগুলোকে কাটিয়ে একদিনেই সুন্দর করে একটা রাষ্ট্র তৈরি করব, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই।

তিনি বলেন, ছাত্র-জনতার গণঅভুত্থানের মধ্য দিয়ে একটা নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, ৫৩ বছরে আমরা একটা নিয়মিতভাবে, শান্তিপূর্ণভাবে, ক্ষমতা হস্তান্তরের বা ক্ষমতা পরিবর্তনের বিধানই তৈরি করতে পারিনি। সেখানে আজকে এসে হঠাৎ করে এই মুহূর্তের মধ্যে আমরা সবকিছু ঠিক করে ফেলব, এটা মনে করার কারণ নেই। ৫৩ বছর ধরেই চেষ্টা করছি, ব্যক্তিগতভাবে যেটা মনে করি বিচ্ছিন্নভাবে কোনো কিছুই করা যায় না। এবং জোড়াতালি দিয়েও কোনো কিছু করা যায় না। এটার সুনির্দিষ্ট চিন্তাভাবনা প্রয়োজন। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য প্রয়োজন। সুনির্দিষ্ট চিন্তা প্রয়োজন। এবং রাজনৈতিক দল এবং রাজনৈতিক নেতা বা কর্মী তাদের অত্যন্ত সততা ও আন্তরিকতা প্রয়োজন।

মির্জা ফখরুল বলেন, আওয়ামী লীগ গত ১৫ বছরে এই দেশকে সর্বশান্ত করে দিয়েছে। একেবারে বলা যায় যে ভূমিধস করে দিয়েছে। সেই জায়গায় এখান থেকে আবার এক বছরে দেড় বছরের মধ্যে সবকিছু ঠিক করে ফেলবেন, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। আর সামাজিক সুরক্ষা কার? নাগরিকের তো, মানুষের তো, সেটা আপনার বিধবাই হোক আর সেটা আপনার কম পয়সার বয়স্কই হোক সবকিছু নির্ভর করত তার কাঠামোর ওপরে। তার ব্যবস্থার ওপরে। আজকে আমাদের সবকিছুই নির্ধারণ করে আমলারা। আমলারাই নির্ধারণ করে সবকিছু। এবং সেখান থেকে সবকিছু নেমে আসে। আপনি খেয়াল করে দেখবেন, আমার কাছে অবাক লাগে, একজন স্কুল শিক্ষককে তার সমস্যার সমাধান করতে হলে ঢাকায় আসতে হয়। সেন্টারে আসতে হয়। যেটার তো কোনো প্রয়োজন নেই। আমার মনে হয় যে জেলাতেই সেটা যথেষ্ট তা সমাধানে। কিন্তু ওই যে সিস্টেম, ওই সিস্টেম যদি সেন্ট্রালে না আসে তাহলে ঘুষ আসবে কোত্থেকে? এগুলো হচ্ছে বাস্তবতা, শুনে খারাপ লাগবে। বাট দ্যাটস ট্রুথ।

তিনি বলেন, ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকদের নিয়োগ হয় ঘুষ দিয়ে, স্কুলের শিক্ষকদের নিয়োগ হয় ঘুষ দিয়ে, নার্সদের নিয়োগ হয় ঘুষ দিয়ে, ব্যবস্থাতে এই ধরনের অনিয়ম চলতে থাকে, যে ধরনের বৈষম্য চলতে থাকে, সেখানে সব দুর করে ফেলতে পারবেন, এটা খুব ডিফিকাল্ট।

হতাশাবাদী নই আমি এমন মন্তব্য করে মির্জা ফখরুল বলেন, হতাশা আসে, আমি হতাশাবাদী কখনোই ছিলাম না। আমি হতাশাবাদী হতেও চাই না। কিন্তু এটা সত্য কথা, আমি যখন একটা প্রগতিবাদী সমাজ দেখতে চাই। আমি যখন একটা মানুষের অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করবার জন্য একটা ব্যবস্থা চাই। যখন জনগণের যে বৈষম্য কমিয়ে আনতে চাই। তার আর্থিক বৈষম্য সব কমিয়ে আনতে চাই। তখন যদি আমি দেখি যে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে ভিন্ন চেষ্টা করছে। এবং একটা উগ্রবাদ ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। তখন তো হতাশা আসবেই।

তিনি বলেন, যদি একটা সুষ্ঠ নির্বাচন করতে পারি, সুষ্ঠু নির্বাচন করে যদি ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পার্লামেন্ট গঠন করতে পারি। তাহলে সেখানে জনগণের কাছে জবাবদিহিতা মূলক একটা ব্যবস্থা তৈরি করতে পারব। মনে করি, আপাতত কিছুটা সমস্যার সমাধান করতে পারব।

বিএনপি মহাসচিব বলেন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য শেষ হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ শেষ করে দিয়ে গেছে। সেগুলোকে আবার নতুন করে গড়তে হবে। সেজন্য তো মানুষগুলো তৈরি করতে হবে ।

‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, সচিবালয়ে যাবেন, যারা বসে আছে তারাই সবকিছু নির্ধারণ করে। আমাদের উপদেষ্টারা যারা দায়িত্ব পালন করছেন, এখন অনেক ক্ষেত্রে তারা অসহায়। তারপরেও আশা করি, তারা এতদিন চেষ্টা করেছেন, চেষ্টাটা নিয়ে যারা সংস্কারের কমিশনগুলো আছে। তারা সবাই মিলে শুরু করতে পারি, শুরু করতে পারলেই আমরা একটা ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ, যেটা বৈষম্যহীননের দিকে এগিয়ে যেতে পারব।’

ব্যাটারিচালিত এক রিকশাচালক কিছুদিন আগে বলেছিলেন, ‘স্যার আপনার তো আমাদের মতো গরিব মানুষের লগে পারেন, অন্য কারো লগে পারেন না’- এমন মন্তব্য ছুঁড়ে দিল মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বিচ্ছিন্ন বা জোড়াতালি দিয়ে করা যায় না, এটা আমি আগেও বলেছি। লাভ নেই তো। একজন কৃষক তো আপনার পুরোপুরিভাবে তার পণ্যের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ঢাকা শহরে ব্যাটারিচালিত রিকশায় ভরে গিয়েছে, কেন? কারণ তার কর্ম নেই, কর্মসংস্থান নেই, তাকে বেঁচে থাকতে হলে রিকশাটা চালিয়ে বেঁচে থাকতে হবে। সুতরাং গভমেন্টকে সেই পলিসি আনতে হবে, যে পলিসিতে তার বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা তৈরি হবে। এবং একইসাথে এই রাস্তাগুলোকে ঠিক করা সম্ভব হবে। এটাই হচ্ছে মূল কথা।’

তিনি বলেন, সবশেষ কথা, ঐক্যবদ্ধ থেকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে, দুর্নীতির ঊর্ধ্বে উঠে ভবিষ্যৎ তৈরি করার জন্য কাজ করতে হবে। বাংলাদেশ মানুষ পারে, ’৫২ তে পেরেছে, ’৬৯ এ পেরেছে , ’৭০ এ পেরেছে, ’৭১ এ পেরেছে। সুতরাং না পারার কোনো কারণ নেই। আর সবশেষে (চব্বিশের জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান) যেটা পেরেছে, এটা তো অভাবনীয় অসাধারণ, সেই ক্ষেত্রে আমার মনে হয়, আমরা পারব।