মোহাম্মদ হিযবুল্লাহ আরেফিন

রাজনৈতিক দলগুলোর দুর্বৃত্তায়নের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙে দিতে হবে

মোহাম্মদ হিযবুল্লাহ আরেফিন ইউনাইটেড পিপলস (আপ) বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব। এর আগে তিনি জাতীয় নাগরিক কমিটির সহ-মুখপাত্র ছিলেন।

আতাউর রহমান

Location :

Dhaka City
মোহাম্মদ হিযবুল্লাহ আরেফিন
মোহাম্মদ হিযবুল্লাহ আরেফিন

ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশের (আপ) কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব মোহাম্মদ হিযবুল্লাহ আরেফিন বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর দুর্বৃত্তায়নের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙে দিতে হবে।

তিনি বলেন, চাঁদাবাজের ব্যাপারে ‘জিরো টলারেন্স’ থাকতে হবে। এটা প্রথমত সরকারের দায়িত্ব। জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পরে এদেশের মানুষ চেয়েছিল একটা নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি শুরু হোক। চাঁদাবাজিগুলো কেন হয়? কারণ আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, এটা টিকে আছে চাঁদাবাজি এবং দুর্নীতির ‍ওপরে। ফলে ইউপিবি বার বার বলেছে এই রাজনৈতিক দলগুলোর, এই দুর্বৃত্তায়নের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙে দিতে হবে।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে সম্প্রতি নয়া দিগন্ত অনলাইনকে দেয়া একান্ত সাকক্ষাৎকারে হিযবুল্লাহ আরেফিন এসব বলেন।

মোহাম্মদ হিযবুল্লাহ আরেফিন ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশের (আপ) কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব। এর আগে তিনি জাতীয় নাগরিক কমিটির সহ-মুখপাত্র হিসেবেও পরিচিতি লাভ করেন।

নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের এক ঐতিহ্যবাহী পরিবারে জন্ম ও বেড়ে ওঠা হিযবুল্লাহ আরেফিনের। স্কুলজীবন থেকেই রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন। গত দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি রাজপথে এবং অনলাইন মাধ্যমে একজন সোচ্চার ও পরিচিত মুখ হিসেবে ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন।

বিশেষ করে, আওয়ামী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে তার দৃঢ় অবস্থান ও সংগ্রামী ভূমিকা রাজনীতির অঙ্গনে আলাদা পরিচিতি এনে দিয়েছে।

নয়া দিগন্ত : বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি (চাঁদাবাজ ও মব সৃষ্টি) আপনাদের দল কিভাবে দেখছে এবং আপনি কিভাবে দেখছেন?

মোহাম্মদ হিযবুল্লাহ : চাঁদাবাজের ব্যাপারে আমাদের পজিশন হচ্ছে এ ব্যাপারে ‘জিরো টলারেন্স’ থাকতে হবে। এটা প্রথমত সরকারের দায়িত্ব। দেখেন, জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পরে এদেশের মানুষ চেয়েছিল একটা নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি শুরু হোক। বিশেষ করে, চাঁদাবাজিগুলো কেন হয়? কারণ আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, এটা টিকে আছে চাঁদাবাজি এবং দুর্নীতির ‍ওপরে। ফলে আমরা (ইউপিবি) বার বার বলছি রাজনৈতিক দলগুলোর এই দুর্বৃত্তায়নের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙে দিতে হবে। এটা যদি না ভাঙা যায়, তাহলে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নেতাকর্মীদের বাঁচিয়ে রাখার জন্যই চাঁদাবাজি চালু রাখবে এবং নিজেদের রাজনৈতিক দলকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এই নেতাকর্মীরাই দুর্নীতির সাথে জড়িত হবে। ফলে আমাদের চ্যালেঞ্জটা হচ্ছে, এই রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের যে অর্থনীতি আছে, এটাকে ভেঙে ফেলতে হবে। আমরা মনে করি, এটা জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা।

কিন্তু আমরা দুর্ভাগ্যবশত দেখছি, ৫ আগস্টের পর থেকে এক বছর হয়ে গেছে এখন পর্যন্ত এই সংস্কৃতির পরিবর্তন হয়নি। এমনকি জুলাইয়ে যারা সক্রিয় অংশগ্রহণকারী ছিলেন, ব্যক্তি হোক, রাজনৈতিক দল হোক তারাও এখনো নানানভাবে এই চাঁদাবাজি এবং এর সাথে জড়িয়ে পড়ছেন। এটা পড়ছেন কারণ জুলাইয়ের আগের যেই সংস্কৃতি সেই সংস্কৃতিতেই তারা এখনো জারি রাখতে চাচ্ছেন। আমরা মনে করি, এটা জুলাইয়ের স্পিরিটের সাথে সাংঘর্ষিক। ফলে জুলাইকে যদি আমরা জিন্দা রাখতে চাই এবং জুলাইয়ে এত মানুষের আত্মত্যাগকে যদি আমরা সঠিক মূল্যায়ন করতে চাই, তাহলে যে সব ব্যক্তি কিংবা দল এই চাঁদাবাজির সাথে সম্পৃক্ত আছে, তাদের গণপ্রতিরোধ করতে হবে। এটাই হচ্ছে একমাত্র পথ যেভাবে আমরা জুলাইয়ে হাসিনাকে প্রতিরোধ করেছি, একইভাবে চাঁদাবাজিকে গণপ্রতিরোধ করতে হবে এবং আমরা আপ বাংলাদেশ এটার জন্যই কাজ করছি। আমরা বলছি দেখেন যে শুধু চাঁদাবাজিকেই গণপ্রতিরোধ করলে হবে না, আপনি যে স্বচ্ছ একটা রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে এর প্রমাণও আপনাকে দিতে হবে। যেমন আমরা এখন পর্যন্ত আমাদের যত টাকা আয় হইছে, যত টাকা ব্যয় হইছে সব আয়-ব্যয়ের হিসাব আমরা আমাদের ওয়েবসাইটেই দিয়ে দিছি। আমরাই বাংলাদেশের একমাত্র রাজনৈতিক অ্যান্টিটি, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বা রাজনৈতিক উদ্যোগ যাদের আয়-ব্যয়ের হিসাব তাদের ওয়েবসাইটে দেয়া আছে।

বাংলাদেশে আর কোনো পলিটিক্যাল পার্টি, পলিটিক্যাল অ্যান্টিটি কেউ নিজের আয়-ব্যয় প্রকাশ করে না। আমরা তিন মাসের আয়-ব্যয় দিয়েছি। আমরা বলেছি, আমরা এখন থেকে প্রতি বছর চারবার আয়-ব্যয়ের হিসাব দিবো ত্রৈমাসিক, যাতে আমাদের স্বচ্ছতা থাকে। আমাদের ফাইন্যান্স পলিসিতে বলা আছে, ২০ হাজার টাকার অধিক কোনো টাকা যদি কোনো স্থানীয় সংগঠন আয় করতে চায়, আমাদের ফাইন্যান্স কমিটিকে জানাতে হবে। অর্থ্যাৎ কোনোভাবেই কোনো দলের সদস্য চাঁদাবাজিতে না জড়াতে পারে, এ ব্যাপারে আমরা খুব সজাগ। আমরা মনে করি, রাজনৈতিক দলগুলো এতে সজাগ থাকা ও সোচ্চার হওয়া উচিত। তাদের আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছ হিসাব থাকা উচিত। তাহলে এটা বন্ধ হবে, নয়তো বন্ধ হবে না।

নয়া দিগন্ত : অনেক বড় রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ আসছে। বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখছেন?

মোহাম্মদ হিযবুল্লাহ : বিএনপি এ মুহূর্তে বাংলাদেশের একটি বড় রাজনৈতিক দল। বড় রাজনৈতিক দলের প্রতি দেশের মানুষের প্রত্যাশা বড় থাকে। আমরা মনে করি, বিএনপি এই প্রত্যাশাটা মিট করতে পারছে না। কারণ হচ্ছে, এখন পর্যন্ত বিএনপির স্থানীয় সংগঠনের কমপক্ষে দুই হাজার লোককে বহিষ্কার করেছে এক বছরে। কেন বহিষ্কার করছে? দুই হাজার নেতাকর্মী চাঁদাবাজির সাথে জড়িত। এটা ভালো যে দল থেকে বহিষ্কার করছে। কিন্তু একটা দলের যদি দুই হাজার লোককে বহিষ্কার করতে হয় চাঁদাবাজির দায়ে, তার মানে দলটার কী পরিমাণ নেতাকর্মী চাঁদাবাজির সাথে সম্পৃক্ত হয়ে গেছে!

এটাও একটা সাইন, ফলে বিএনপিকে আমরা বলব যে স্বচ্ছ ধারার রাজনীতি নিশ্চিত করার জন্যই দলের ভেতর শুদ্ধি অভিযান চালানো উচিত। যে চাঁদাবাজি করার আগেই ইতোপূর্বের রেকর্ড দেখে, গত ১৫-১৬ বছরের রাজনীতিক সংগ্রাম তো ভালো জিনিস যারা করছে, ফ্যাসিবাদী যে আন্দোলন করছে এটা ভালো। কিন্তু সংগ্রামের পাশাপাশি তার অতীত রেকর্ডও দেখা উচিত। এই সংগ্রামের সাথে তারা যেন চাঁদাবাজি করার লাইসেন্স না পেয়ে যায় তাদের সেই সেক্রিফাইসের কারণে। এটা এনসিউর করে বিএনপির দলের ভেতর শুদ্ধি অভিযান চালানো এবং দলের ভেতর যারা চাঁদাবাজির সাথে সম্পৃক্ত হচ্ছেন, এর সাথে জড়িত হচ্ছেন, চাঁদার জন্য কাউকে খুন করে ফেলছেন, এদেরকে শুধুমাত্র দল থেকে বহিষ্কার না। দলের উদ্যোগে তাদের আইনের আওতায় তুলে দেয়া উচিত।

এটা বিএনপির করা উচিত এবং আমরা মনে করি, চাঁদাবাজি বন্ধের দায়িত্ব তো শুধু রাজনৈতিক দলের না, এটা বিএনপির রাজনৈতিক দলের সেকেন্ডারি দায়িত্ব, প্রাইমারিলি এই দায়িত্ব বর্তায় সরকারের ওপরে। সরকারকে শক্তিশালীভাবে এগুলো দমন করতে ভূমিকা রাখা উচিত।

এখন গণঅভ্যুত্থানের পরের সরকার যদি মনে করে যে সে কাজ করতে পারছে না, তাকে বাধা দিচ্ছে, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলুক যে আমি চাঁদাবাজদের ধরতে পারছি না, আমাকে বিএনপি বাধা দিচ্ছে, আমাকে এনসিপি বাধা দিচ্ছে, আমাকে জামায়াত বাধা দিচ্ছে বলুক। কোন নেতা বাধা দিচ্ছে বলুক, জনগণ তাদের প্রতিরোধ করবে। কিন্তু সরকার নিজের কাজ না করে যদি আবার বিএনপিকে বলে যে আপনি আপনার দলের লোকজন ঠেকান, তাহলে হবে না। সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে চাঁদাবাজি বন্ধ করা আর বিএনপির দায়িত্ব হচ্ছে দায়িত্বশীল জায়গা থেকে দলের ভেতর যেন কোনো চাঁদাবাজ স্থান না পায় সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। কিন্তু এটার প্রাথমিক দায় সরকারের। এই দায় সরকারের দায় নিতে হবে।

নয়া দিগন্ত : সম্প্রতি আমরা এনসিপি নেতা হাসনাত আবদুল্লাহর একটি ফেসবুক পোস্ট দেখলাম, সেখানে তিনি লিখেছেন ‘ছাত্ররা ঘরে ফিরে যায়নি, জুলাই শেষ হয়নি’। তার এই ফেসবুক পোস্টটি আপনার দল বা আপনি কিভাবে দেখছেন?

মোহাম্মদ হিযবুল্লাহ : দেখেন হাসনাত যে পোস্ট দিয়েছে ছাত্ররা প্রয়োজনে তার সাথে আবার পথে নামবে, এটা তো কারোর সাথে নামার বিষয় না। আমরা মনে করি যে প্রত্যেকেই যার যার নীতিগত জায়গা থেকে রাজপথে আছে, হাসনাতরা তার মতো রাজপথে আছে, আমরা আপ বাংলাদেশ আমাদের মতো করে রাজপথে আছি। জুলাইয়ের পরে অসংখ্য সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠক রয়েছে, তারা তাদের মতো করে রাজপথে আছে। ফলে প্রত্যেকের দাবি আছে যে এই জিনিসগুলো হইতে পারবে না। এখন এই এই জিনিসগুলো যদি হাসনাতের দল করে, তার বিরুদ্ধেও আমরা থাকব।

আমরা চাঁদাবাজ মানে তো বিএনপি বুঝি না, আমরা চাঁদাবাজ মানে চাঁদাবাজ বুঝি। তাহলে চাঁদাবাজের সাথে যারাই জড়িত থাকবে, তাদের বিরুদ্ধে আমরা সোচ্চার থাকব। আবার আমাদের দলের কেউ যদি চাঁদাবাজি করে আমরা বলব যে এনসিপির লোকজনও একই স্টেটমেন্ট আমাদের বিরুদ্ধে দেক যে আপ বাংলাদেশের যদি কেউ চাঁদাবাজি করলে আমরাও তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াব। একইভাবে আমরাও বলি এনসিপির কেউ করলে আমরা রুখে দাঁড়াব। এজন্য প্রত্যেককে প্রত্যেককে চেক দিতে হবে। যাতে কোনো সংগঠন এ ধরনের কাজে জড়িত না হয়।

নয়া দিগন্ত : আপনার দল দেশের বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলো (চাঁদাবাজ, নির্বাচন, সংস্কার) কিভাবে দেখছেন?

মোহাম্মদ হিযবুল্লাহ : সংস্কারের ব্যাপারে আমাদের পজিশন খুব ক্লিয়ারলি বলছি যে আমাদের মৌলিক সংস্কারগুলো এনসিউর করতে হবে। এক বছর হয়ে গেছে এখনো মৌলিক সংস্কার হয় নাই। ফলে সরকার কি সংস্কারকে বেশি দিন ক্ষমতায় থাকার জন্য ডিলে করছে? না কি অ্যাকচুয়ালি সংস্কার নিয়ে সরকার চ্যালেঞ্জ ফেস করতেছে, এটা আমরা সিউর না। কারণ দেখেন এখনো পর্যন্ত পুলিশ প্রশাসনে সংস্কার হয় নাই, এটা তো এক বছর লাগার কথা না। এই জুলাইয়ের ১৪ তারিখ থেকে ৩৬ জুলাই ৫ আগস্ট পর্যন্ত কত লাখ রাউন্ড গুলি হয়েছে এই হিসাবটা সরকারের কাছে নাই কেন? এটা তো প্রত্যেক থানা থেকে নেয়া তার প্রথম দায়িত্ব ছিল। সরকারের কাছে এই হিসাবটাও নাই। কোন কোন পুলিশ সদস্য গুলি করলেন, তাদের কতজন গ্রেফতার হলেন এই ডাটাটা সরকার পাবলিস করছে না কেন? আমরা জানছি না কেন?

যে কতজন পুলিশের বিচার কার্যক্রম শুরু হয়েছে এবং পুলিশ সদস্যদের যারা মানুষের বুকে এভাবে গুলি চালাতে পারছেন, তাদেরকে তাদের চিন্তায়, তাদের মননে তাদের পরিবর্তনের জন্য সরকার কী কী উদ্যোগ নিয়েছে? একই পুলিশ যদি আবার এক্সিস্ট করে তাহলে তো আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগব। এই পুলিশ আবারো আমাকে হেলিকাপ্টার থেকে গুলি করতে পারে। ফলে পুলিশের সংস্কারে সরকারের ভূমিকা কী? আমরা জানি না।

বিচার বিভাগের সংস্কারে সরকারের ভূমিকা কী? আমরা জানি না। জনপ্রশাসন সংস্কারে সরকার কী কী উদ্যোগ নিয়েছে যে যেই আমলারা ২০১৪, ১৮ সাল এবং ২৪ সালের তিনটি ভোটের মাধ্যমে আমাদের অধিকার কেড়ে নিলো ভোটাধিকার তাদের বিরুদ্ধে সরকার কী ব্যবস্থা নিছে আমরা জানি না। আমরা বলতেছি, এই সংস্কারগুলো সরকারের খুব দ্রুত করা উচিত এবং সেটা কবের মধ্যে করবে রোডম্যাপ কী? সেটা বাস্তবায়নে সরকারের পরিকল্পনা কিছুই সরকার দেয় নাই। এগুলো দিতে হবে, এটা সরকারের দায়িত্ব আমরা মনে করি, এই ইন্টারিম সরকার এই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে।

সেকেন্ডলি সংস্কারগুলো করার পরে এই সরকারের একটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হচ্ছে জনগণের মধ্যে ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেয়া। একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেয়া। সেই গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য যেই গ্রাউন্ড লাগবে, সেই গ্রাউন্ড কি সরকার তৈরি করতে পারছে? এই যে আজকে আমরা যেই পরিমাণ খুন খারাবি, চাঁদাবাজি দেখছি, এগুলোকে যদি এ সরকার নিয়ন্ত্রণ না করতে পারে তাহলে আমরা কিভাবে বুঝবো যে ভোটকেন্দ্রগুলোতে খুন খারাবি হবে না, ব্যালট বাক্স নিয়ে দৌঁড় মারবে না। তাহলে এটা সরকারকে এনসিউর করার জন্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করতে হবে, ওই কনফিডেন্সে আমাদের আনতে হবে। তারপরে জনগণের ভোটাধিকার খুব দ্রুতই জনগণের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে। কিন্তু তার আগে এই সংস্কারগুলো করতে হবে। এগুলো মৌলিক সংস্কার, এ ব্যাপারে কোনো ছাড় দেয়া যাবে না।

নয়া দিগন্ত : নির্বাচন নিয়ে আপনার দলের চিন্তা ভাবনা কী?

মোহাম্মদ হিযবুল্লাহ : নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে আমাদের চিন্তা ভাবনা হচ্ছে, আমরা যেহেতু রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন নেইনি। সেহেতু দল হিসেবে আমরা অংশগ্রহণে আমাদের কোনো সুযোগ নাই। কিন্তু আমাদের মধ্য থেকে ক্যান্ডিডেট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে যার যার ব্যক্তিগত সামর্থ্য অনুযায়ী। সেক্ষেত্রে আমরা সামষ্টিকভাবে এ রকম কোনো ক্যন্ডিডেট থাকলে তাদের সমর্থন দিবো। কিন্তু আমরা মনে করি যে, নির্বাচনের চেয়েও আমাদের ফোকাস হচ্ছে সংস্কার, বিচার, দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচার এবং নির্বাচনের পরিবেশ ঠিক করা। এগুলোতে আমরা বেশি ফোকাস দিচ্ছি।

নয়া দিগন্ত : জুলাই আন্দোলনের এক বছর পূর্ণ হচ্ছে। সেই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সাধারণ জনগণের মাঝে গণতন্ত্র, সুশাসন, জবাবদিহিতা এবং একটি পরিবর্তনের ব্যাপক প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল। এই এক বছরে আপনার দল সেই গণআকাঙ্ক্ষা পূরণে কতটা অগ্রগতি অর্জন করতে পেরেছে বলে আপনি মনে করেন?

মোহাম্মদ হিযবুল্লাহ : আমরা মনে করি, জুলাইয়ের যে প্রত্যাশা ছিল আমরা দল হিসাবে সেই প্রত্যাশা পূরণ করতে পারিনি। জুলাইয়ের প্রত্যাশা ছিল যে জুলাইয়ের ঘোষণাপত্র, জুলাইয়ের সনদ এগুলো হবে। এগুলো এখনো আমরা আদায় করতে পারি নাই, এগুলো নিয়ে এখনো আমরা মাঠে আছি। কিন্তু আমাদের এই মাঠে থাকা তো প্রমাণ করে না যে আমরা প্রত্যাশা পূরণ করতে পেরেছি। প্রত্যাশা পূরণ করতে হলে, এগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। আমরা সরকারের কাছ থেকে যেদিন এগুলো আদায় করতে পারব, যে সরকার ঘোষণাপত্র দিতে বাধ্য হবে, সনদ দিতে বাধ্য হবে, ঘোষণাপত্র সংবিধানের প্রস্তাবনায় রাখতে বাধ্য হবে।

সকল শহীদদের মধ্যে এখন পর্যন্ত ৮৪৪ জনের গেজেট হয়েছে। তবে শহীদ হয়েছে ১৪০০ থেকে ১৫০০ জন। প্রত্যেককের গেজেট হতে হবে, এখনো গেজেট হয় নাই। প্রত্যেক শহীদ পরিবারকে ৩০ লাখ টাকা সঞ্চয়পত্র দেয়ার দরকার। কিন্তু এখনো পর্যন্ত সরকার ১০ লাখ টাকা দিয়েছে। সরকারকে এই ৩৬ জুলাইয়ের মধ্যে ৩০ লাখ টাকা দিতে হবে। আহতদের সবাইকে চিকিৎসার ব্যয়ভার সরকার বহন করছে কি না সেটা নিশ্চিত করতে হবে। অনেকেই আহত হয়েছে নিজের খরচে চিকিৎসা করতে গিয়ে ফকির হয়ে গেছে। এদের প্রত্যেকের যে চিকিৎসা খরচ ব্যক্তিগতভাবে করছে এটাও সরকারের তরফ থেকে দিয়ে দিতে হবে। এই কাজগুলো যেদিন আমরা বাস্তবায়ন করতে পারব, আমরা মনে করবো যে তখন আমরা সফল হয়েছি। জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা কিছুটা বাস্তাবায়ন করতে পারছি। তার আগ পর্যন্ত আমরা বলব যে আমরা এখন পর্যন্ত জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে ব্যর্থ।

নয়া দিগন্ত : আপনারা যে মাসব্যাপী জুলাই গণসংযোগ কর্মসূচি দিয়েছেন, এর প্রধান প্রধান উদ্দেশ্যগুলো কী কী?

মোহাম্মদ হিযবুল্লাহ : আমরা এই গণসংযোগে মোটা দাগে কয়েকটা কথা বলেছি। ১ নম্বর দাবি হচ্ছে যে জুলাইয়ের ঘোষণাপত্র এবং জুলাইয়ের সনদ ৩৬ জুলাইয়ের মধ্যেই দিতে হবে, মানে ৫ আগস্টের মধ্যে অবশ্যই অবশ্যই ঘোষণা দিতে হবে। দুই নম্বর হচ্ছে জুলাইয়ের ঘোষণাপত্র ও জুলাইয়ের সনদকে সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লেখ করতে হবে। আর ৩ নম্বরে বলেছি, দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচার কার্যক্রম শুরু করতে হবে এবং সব গুম, খুন, হত্যাকাণ্ড বিচারিক হত্যাকাণ্ডের সাথে যারা জড়িত, প্রহসনমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে মানুষের ভোটাধিকার হরণের সাথে যারা জড়িত, প্রত্যেককে বিচারের আওতায় আনতে হবে। আমরা বলছি, পাচারের সাথে যারা জড়িত, অর্থ পাচারের সাথে যারা জড়িত দেশের লাখ লাখ কোটি কোটি টাকা পাচার করে, তাদের বিচারের জন্য একটা ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল গঠন করে তাদের বিচার করতে হবে এবং পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনতে হবে।

তারপরে আমরা দাবি জানিয়েছি যে এই সরকারের সময়ে পাঁচটি গণহত্যা হয়েছে, এ প্রত্যেকটি গণহত্যার জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচার করতে হবে। তারপরে আমরা বলেছি যে আমাদের জরুরি যে সংস্কারগুলো আছে পুলিশ প্রশাসন সংস্কার, বিচার বিভাগ সংস্কার এবং জনপ্রশাসন সংস্কার- এই তিনটি সংস্কারকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে সংস্কারের রোডম্যাপ, সংস্কার কিভাবে বাস্তাবায়ন হবে এবং কী কী সংস্কার হবে, তার প্রস্তাবনা অতি দ্রুত হাজির করতে হবে এবং বাস্তাবায়ন কার্যক্রম শুরু করতে হবে।

এই দাবিগুলোকে নিয়েই সারাদেশে গণসংযোগ করছি, মানুষের কাছে যাচ্ছি এবং দেশের আপামর জনতা কৃষক, শ্রমিক, রিকশাচালক, মধ্যবিত্ত, নারী-পুরুষ প্রত্যেকেই আমাদের বলছেন যে এই কথাগুলো আসলে জুলাইয়ের কথা। যে বৈষম্যহীন বাংলাদেশের যে স্বপ্ন জুলাইয়ের কথা, জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা। এগুলো নিয়ে আমরা মাঠে নেমেছি, এজন্য তারা আমাদের পাশে আছেন এবং প্রয়োজনে আবারো বাংলাদেশের মানুষ সকলে এই গণঅভ্যুত্থানের মতো গণবিস্ফোরণ ঘটবে জনগণের মাঝে যে এই দাবিগুলো আদায় করে নিলে।

নয়া দিগন্ত : আপনাদের যে গণসংযোগ করছেন এতে সাধারণ মানুষদের কাছ থেকে কেমন রেসপন্স পাচ্ছেন? এবং এখন পর্যন্ত কয়টি জেলায় বা বিভাগে গণসংযোগ সম্পন্ন হয়েছে?

মোহাম্মদ হিযবুল্লাহ : আমাদের গণসংযোগ হয়েছে রংপুর বিভাগের আটটি জেলায় এবং বরিশাল বিভাগে গণসংযোগ আপাতত সম্পন্ন হয়েছে। আমরা জনগণের কাছ থেকে অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছি। আমরা যে জিনিসটা দেখেছি যে মানুষ এই কথাগুলো কেউ বলুক সেটা চাচ্ছে, এগুলো মানুষের কথা। গত এক বছর রাজনৈতিক দলগুলো এ কথাগুলো বলছে না। এমনকি জুলাই নিয়ে যারা কথা বলছে, তারাও এই কথাগুলো বার বার সামনে আনছে। ফলে মানুষের মধ্যে একটা হতাশা কাজ করছে যে এখনো পর্যন্ত সরকারি অফিসগুলোতে ঘুষ বন্ধ হয় নাই, এখনো পর্যন্ত মানুষের দৈনন্দিন জীবনে যে সেবাটা মানুষ সরকারের বিভিন্ন দফতর থেকে পাওয়ার কথা ছিল, সেই সেবাটা মানুষ পাচ্ছে না। স্বাস্থ্য সেবা হোক, তার হচ্ছে পুলিশের কাছে গিয়ে একটা সেবা হোক, আইনি সহায়তা হোক কিংবা যেকোনো সেবা হোক সরকারি কোনো দফতরে মানুষ যে তার নাগরিক অধিকার এই জিনিসটা সে সঠিকভাবে পাচ্ছে না। এখনো সেই ঘুষ প্রথা রয়ে গেছে। তো যার কারণে মানুষের মাঝে ফ্রাস্ট্রেশন আছে। এজন্য তরুণরা যখন তাদের কাছে যাচ্ছে, আবার গণসংযোগ করতেছে আমরা যখন তাদের সাথে কথা বলছি, তাদের মধ্যে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা এবং আগ্রহ তৈরি হচ্ছে। তারা চাচ্ছেন যে, এই দাবি নিয়ে কেউ না কেউ মাঠে সব সময় থাকুক। আমাদের তারা বলছেন, আমরা যেন সব সময় মাঠে থাকি। আমাদের এই থাকাটাকে তারা আমাদের কাছ থেকে প্রত্যাশা করেন এবং আমাদের দোয়া করেন এই দাবিগুলো যেন বাস্তবায়নে কাজ করি।

নয়া দিগন্ত : সম্প্রতি সারাদেশে আলোড়ন তৈরি করা সোহাগ হত্যাকাণ্ডকে আপনারা কিভাবে দেখতেছেন? এটা চাঁদাবাজ কেন্দ্রীক না কি অন্য কিছু। কিভাবে বিশ্লেষণ করবেন?

মোহাম্মদ হিযবুল্লাহ : প্রথম কথা হচ্ছে, এটার মতো বীভৎস দৃশ্য আমরা খুব কম দেখেছি। আমরা আওয়ামী লীগ সময়ে এগুলো দেখছি। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরে লগি বৈঠা নিয়ে আওয়ামী লীগ যখন ওই জামায়াতের সমাবেশে হামলা করলো, তখন জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের মেরে সেই লাশের উপর নৃত্য করেছিল তারা। তারপরে এ রকম বীভৎস দৃশ্য আমরা থ্রো আউট আমরা আওয়ামী রেজিম, আওয়ামী লীগের সময় বিভিন্ন সময় দেখেছি। আওয়ামী লীগের অনেক হিংস্র হায়নারা এ ধরনের কাজ করেছে। কিন্তু এই আওয়ামী হিংস্র হায়নারা পালিয়ে যাওয়ার পরেও বাংলাদেশের মানুষকে এ ধরনের বীভৎস দৃশ্য দেখতে হবে, এটা জুলাইয়ের পরে আমরা কোনোভাবেই ভাবিনি। ফলে এ দৃশ্যের ব্যাপারে আমাদের একটাই বক্তব্য এদের খুব দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে এবং ই্ন্টেরিম এক্ষেত্রে আমি বলব যে তারা তাদের দায় আছে এবং তারা এই দায় থেকে কোনোভাবেই নিজেদেরকে দায় মুক্তি দিতে পারবে না। একটা দেশের নাগরিককে এভাবে হত্যা করা হয়েছে, সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে নিরাপত্তা দিতে পারেনি। এভাবে নাগরিককে নিরাপত্তাহীন করার অধিকার কোনো সরকারের কখনই থাকে না। ফলে এই দায় প্রাথমিকভাবে অবশ্যই সরকারের।

দ্বিতীয়ত এই দানবকে যারা তৈরি করছে, যে রাজনৈতিক দলগুলো তৈরি করেছে, সেই রাজনৈতিক দলগুলোকে দায় নিতে হবে। এই চাঁদাবাজিকে বন্ধ করতে হবে। বিএনপিকে অবশ্যই দলের ভেতর শক্তিশালী অবস্থান নিতে হবে, যেন তার নেতাকর্মীরা চাঁদাবাজি না করতে পারে এবং অন্যান্য সকল রাজনৈতিক দলকে এটা নিশ্চিত করতে হবে। সরকারের দিক থেকে এবং রাজনৈতিক দলের দিক থেকে যদি শক্তিশালী পদক্ষেপ আমরা না পাই, তাহলে আল্লাহ না করুক এ রকম দৃশ্য আমাদের আবারো দেখতে হতে পারে। ফলে আমরা সরকারের দিক থেকে শক্তিশালী পদক্ষেপ চাই এবং রাজনৈতিক দলের দিক থেকে পরিষ্কার বার্তা চাই, যে তারা কোনোভাবে এ ধরনের ঘটনাকে এন্টারটেইন করবে না। কোনো ধরনের চাঁদাবাজকে এন্টারটেইন করবে না এবং বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবে।