জামায়াত ক্ষমতায় গেলে দুর্নীতি সন্ত্রাস চাঁদাবাজমুক্ত একটি ন্যায়ভিত্তিক নতুন বাংলাদেশ উপহার দেবো- মন্তব্য করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডাঃ শফিকুর রহমান বলেছেন, প্রতিশোধ প্রতিহিংসার জন্ম দেয়। আর প্রতিহিংসা সমাজকে ধ্বংস করে দেয়। ২৪ এর ৫ আগস্ট রাতে আমরা কী করেছিলাম, সকল ব্যথা বেদনা বুক থেকে ঝেড়ে ফেলেছিলাম। বলেছিলাম, আমরা ব্যক্তিগতভাবে কারো ওপর থেকে প্রতিশোধ নেবো না। সেই রাতে যদি শুধু বলে দিতাম, যে যার ক্ষতি করেছে তার সাথে একটু মোলাকাত করে আসো, তা হলে বাংলাদেশ একটি বধ্যভূমিতে পরিণত হতো।
তিনি বলেন, পলাতক এক আওয়ামী লীগ নেতা বলতেন কোনো কারণে আমাদের সরকারের পতন হলে ২ দিনের ভেতর আমাদের ৫ লাখ লোক মারা যাবেন।
ডাঃ শফিক বলেন, শুধু দলীয় কর্মী নয়, সেই কঠিন সময়ে আমরা সকলকে বললাম, প্লিজ কেউ কারো ক্ষতি করবেন না। আওয়ামী লীগ দায়িত্বজ্ঞানহীন দল হলেও এ জাতি সেদিন দেশকে রক্ষা করেছে। তারা সরকারবিহীন একটি দেশে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে দেয়নি। ৫ লাখ নয়, ৫ হাজার নয়, ৫০০ জনও মরেনি। সেই সময়ের হিসাবে মাত্র ২৩ জন লোক মারা গেছেন।
জামায়াত আমির বৃহস্পতিবার রাতে নগরীর আমান উল্লাহ কনভেশন হলে সিলেট মহানগর জামায়াত আয়োজিত সুধী সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন।
সিলেটের বিভিন্ন স্তরের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ,বন্ধুপ্রতিম ও সমমনা রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, পেশাজীবী ও সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দসহ ৫ সহস্রাধিক সুধীজনের উপস্থিতিতে জামায়াত আমির ডা: শফিকুর রহমান পৌনে এক ঘণ্টা ধরে দিক নির্দেশনামূলক বক্তব্য দেন।
জামায়াতে ইসলামীর আমির বলেন, দেশ পুনর্গঠনের এক অপূর্ব সুযোগ এবার এসেছে। এমন সুযোগ বার বার আসবে না। তাই এই সুযোগকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজে লাগাতে হবে।
সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত আমরা থামবো না- মন্তব্য করে জামায়াত আমির বলেন, মানুষ পরিবর্তন চায়। আর আমরা সবাইকে নিয়ে বাংলাদেশ গঠন করতে চাই। একটি দল বলেছে তারা জামায়াতে ইসলামী বাদে বাকি সব দল নিয়ে কাজ করবে। আমরা বলছি, আল্লাহ যদি আমাদের সরকারে বসায়, তাহলে তাদেরসহ সবাইকে নিয়েই আমরা দেশ গড়বো। দেশের চিত্র পাল্টে দেবো। দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজিমুক্ত সমাজ উপহার দেবো। সরকার গঠনের পর কেউ যদি আমাদের ওপর আগের মতো অবিচার চালানোর চেষ্টা করে- তাহলে আমরাও বসে থাকবো না। দোয়া করুন, সতর্ক থাকুন, বাংলাদেশ যেনো আর কোন ফ্যাসিবাদের মুখে না পড়ে।
ডা: শফিকুর রহমান বলেন, একদল লুটপাট করবে, বিদেশের মাটিতে বেগমপাড়া করবে, মানুষ অত্যাচারের শিকার হবে। এটা আমরা চাই না। এজন্য জনগণের কথা এবার আমরা পরিবর্তন চাই। সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত আমাদের কেউ থামাতে পারবে না। আর সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হলে মানুষ আর ব্যাংক লুটপাট করবে না, মানুষ খুন করবে না, মানুষের জিনিসপত্র আত্মসাৎ করবে না। আমরা শিক্ষার উন্নয়ন করতে চাই, মানুষের কল্যাণ করতে চাই, দুর্নীতি বন্ধ করতে চাই। সমাজ নষ্ট করা ইঁদুরদের আমরা তাড়াতে চাই। আপনারা আপনাদের হাত আমাদের জন্য বাড়িয়ে দিন।"
জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও সিলেট মহানগরী আমির মুহাম্মদ ফখরুল ইসলামের সভাপতিত্বে এবং মহানগর নায়েবে আমির ড. নূরুল ইসলাম বাবুলের পরিচালনায় সমাবেশে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন, জামায়াতের কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ অধ্যাপক ফজলুর রহমান, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য, ঢাকা মহানগরী উত্তরের আমির ও সিলেট-৬ আসনে জামায়াত মনোনীত সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিন এবং কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা সদস্য, সিলেট জেলা আমির ও সিলেট-১ আসনে জামায়াত মনোনীত সংসদ সদস্য প্রার্থী মাওলানা হাবিবুর রহমান।
স্বাগত বক্তব্য রাখেন সিলেট-১ আসনের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক ও সিলেট অঞ্চল টীম সদস্য হাফিজ আব্দুল হাই হারুন।
এসময় সিলেট -৪ আসনে জামায়াত মনোনীত সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী ও জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি, সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মুহাম্মদ জয়নাল আবেদীন, হবিগঞ্জ -১ আসনে জামায়াতে ইসলামী মনোনীত সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী ও সিলেট মহানগর জামায়াতের সেক্রেটারি মুহাম্মদ শাহজাহান আলী, সিলেট -২ আসনে জামায়াতে ইসলামী মনোনীত সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী অধ্যাপক আবদুল হান্নান,সিলেট -৫ আসনে জামায়াতে ইসলামী মনোনীত সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী হাফিজ মাওলানা আনোয়ার হোসাইন খান ও সিলেট -৩ আসনে জামায়াতে ইসলামী মনোনীত সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী, সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মাওলানা লোকমান আহমদসহ সিলেটের অন্যান্য জামায়াতে ইসলামী নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
জামায়াত আমির বলেন, গণ অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে পুলিশ তাদের পুলিশ স্টেশন ছেড়ে পালিয়েছে। আমরা তাদের বলেছি আপনারা দায়িত্ব পালন করেন, তারা বলছেন তারা আতঙ্কে আছে। আমরা বাংলাদেশের ৩২২টি থানায় পাহারা দিয়েছি। তাদেরকেই পাহারা দিয়েছি, যারা আমাদের বড় ক্ষতি করেছে। আমাদের ওপর তারা মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করেছে, মেরেছে, তবুও তাদের আমরা পাহারা দিয়েছি। নির্বাচনের আগে জনসভাকে এবাদত মনে করে আর পরে সেটাকে খাজনা নেওয়ার সভায় পরিণত করে। পরে বলে আপনি কিছু করলে আমাকে খাজনা দিয়ে ব্যবসা করেন। কোনো একটা জায়গায় মানুষ শান্তিতে নাই। এমনকি মসজিদের ইমাম নিয়েও এখন সন্দিহান। দেশের শতকরা ৬২ ভাগ মানুষ চরম দরিদ্রসীমায় রয়েছে। এর ২২ ভাগ ছাত্র আর বাকিরা শ্রমিক।
সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন,আপনারা রাস্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। আপনাদের অনেক গুরু দায়িত্ব পালন করতে হয়।চতুর্থ স্তম্ভ ভেঙে গেলে উপরের গুলোও আর সঠিক থাকে না। স্বচ্ছ সাংবাদিকতা, দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা দেশকে এগিয়ে নেবে। আমরা সাদাকে সাদা বলবো, কালোকে কালো বলবো।
প্রবাসীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, প্রবাসে ১৪ দিন কাটিয়ে এসেছি, প্রবাসীদের সাথে কথা বলেছি। আপনাদের ভোটের অধিকার ছিল না, আমরা লড়াই করেছি। আমরা বিশ্বাস করি প্রবাসীদের একটি অধিকার প্রতিষ্ঠা হলে বাকি অধিকারও প্রতিষ্ঠিত হবে। সিলেট প্রবাসী অধ্যুষিত এলাকা। প্রবাসীরা তাদের আগ্রহের কথা আমাকে জানিয়েছেন। সকলকে ভোটের আওতায় নিয়ে আসা হোক। এখন যতটুকু পারা যায়, ততটুকু অন্তত করা হোক। আমরা ক্ষমতায় গেলে দেশগড়ার কাজে আমরা প্রবাসীদের শতভাগ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবো ইনশাআল্লাহ।
জামায়াতের আমির ডা: শফিকুর রহমান তার অসুস্থতা, চিকিৎসা ও বিদেশে সফর শেষে সিলেটে দুদিনের সফরে আসেন গত বুধবার সকালে। ওই দিন ওসমানী বিমানবন্দরে তাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। বিমান বন্দর থেকে চার কিলোমিটার জুড়ে হাজার হাজার মোটরসাইকেল ও গাড়ি দিয়ে অভ্যর্থনা জানিয়ে নগরে নিয়ে আসা হয় ।
বিমান বন্দরে এক জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি নির্বাচনের আগে গণভোটের দাবি পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, জুলাই সনদের সাংবিধানিক ভিত্তি দিয়ে অবশ্যই ফেব্রুয়ারীতে নির্বাচন দিতে হবে । তিনি পিআর পদ্ধতির দাবিকে উচ্চকিত করে বলেন, জনগণের এই দাবি মেনে নিতে হবে সরকারকে।
বুধ ও বৃহস্পতিবার দুই দিন ব্যাপি গুরুত্বপূর্ণ দুটো সুধী সমাবেশ ছাড়াও তিনি সিলেটের ৬ টি সংসদীয় আসনের কেন্দ্র পরিচালনার সাথে সম্পর্কিত নেতাকর্মীদের সাথে পৃথক মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন।
এসময় আগামী নির্বাচনকে জেহাদের সাথে তুলনা করে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহবান জানান জামায়াত প্রধান।তিনি এই নির্বাচনকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয়ার আহবান জানান।
বৃহস্পতিবার সিলেটে জামায়াতের দায়িত্বশীল মহিলা সমাবেশেও বক্তব্য রাখেন জামায়াতে ইসলামীর আমির।
এছাড়া তিনি তার মালিকানাধীন সিলেট উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পরিদর্শন করেন এবং সেখানে মতবিনিময় সভায় অংশগ্রহন করেন।



