হাসনাত আব্দুল্লাহ

কক্সবাজার যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল ঘোষণাপত্রের প্রতি নীরব প্রতিবাদ

‘যেখানে ঐক্যের পরিবর্তে বিভাজনকে, শহীদ এবং আহতদের পরিবর্তে কিছু মুষ্টিমেয় গোষ্ঠীর কথা এবং মতামতকেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে, সেখানে উপস্থিত থাকার কোনো ইচ্ছা বা প্রয়োজন আমি বোধ করিনি।’

নয়া দিগন্ত অনলাইন
হাসনাত আব্দুল্লাহ
হাসনাত আব্দুল্লাহ |সংগৃহীত

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেছেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবসে ঢাকার বাইরে, অর্থাৎ কক্সবাজার যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল ‘পূর্বে গৃহীত সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা, সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো বোঝার চেষ্টা করা এবং পরবর্তী করণীয় নিয়ে চিন্তা করা। একইসাথে, এটি ছিল একটা অসম্পূর্ণ জুলাই ঘোষণাপত্রের প্রতি আমার নীরব প্রতিবাদ।

বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) বিকেলে তিনি নিজের ফেসবুক পেজে কারণ দর্শানোর নোটিশের জবাব পোস্ট করেন। সেখানে তিনি এই ব্যাখ্যা দেন।

মূলত, ওইসময় হঠাৎ করে কক্সবাজার যাওয়ার কারণ ও প্রেক্ষাপট সম্পর্কে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দলের দু’ শীর্ষ নেতার কাছে হাসনাত আব্দুল্লাহসহ দলের পাঁচজনকে সশরীরে উপস্থিত হয়ে লিখিত ব্যাখ্যা দিতে বলে এনসিপি।

দলের নির্দেশনা মোতাবেকসেই নোটিশের লিখিত ব্যাখ্যা ফেসবুকেও পোস্ট করেন তিনি।

হাসনাত আব্দুল্লাহ তার পোস্টে লেখেন, গত ৪ আগস্ট সন্ধ্যায় তিনি জানতে পারেন যে জুলাই আন্দোলনে আহত এবং নেতৃত্বদানকারী অনেককে জুলাই ঘোষণাপত্র প্রণয়নের অনুষ্ঠান থেকে সম্পূর্ণভাবে বাদ দেয়া হয়েছে।

এই বিষয়টিকে তার কাছে একাধারে রাজনৈতিক ও নৈতিক ব্যর্থতা বলে মনে হয়েছে বলে তিনি ব্যক্তিগতভাবে এই অনুষ্ঠানে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলেও জানান হাসনাত।

তিনি বলেন, ‘যেখানে ঐক্যের পরিবর্তে বিভাজনকে, শহীদ এবং আহতদের পরিবর্তে কিছু মুষ্টিমেয় গোষ্ঠীর কথা এবং মতামতকেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে, সেখানে উপস্থিত থাকার কোনো ইচ্ছা বা প্রয়োজন আমি বোধ করিনি। কাজেই, এর পরদিন ঢাকার বাইরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।’

এরপর তিনি গত ৪ আগস্ট রাতে প্রথমে দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। কিন্তু তাকে না পেয়ে পরবর্তী সময়ে দলের মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীকে হাসনাত আব্দুল্লাহ জানান, তিনি তার স্কুল বন্ধুদের সাথে দু’ দিনের জন্য ভ্রমণে যাচ্ছেন, এমনটাই বলা হয়েছে ওই ব্যাখ্যায়।

‘যেহেতু তিনি (নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী) সে সময় অফিসে আহ্বায়ক মহোদয়ের সাথে ছিলেন, আমি তাকে অনুরোধ করি যাতে তিনি আহ্বায়ক মহোদয়কে বিষয়টি জানান। তিনি (নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী) আমাকে জানান যে তিনি তা করবেন। প্রায় ৩০ মিনিট পর নাসিরউদ্দিন পাটোয়ারী আমাকে নিশ্চিত করেন যে তিনি আহ্বায়ক মহোদয়কে বিষয়টি জানিয়েছেন এবং আহ্বায়ক মহোদয় এতে সম্মতি প্রদান করেছেন। পরবর্তী সময়ে আমার সাথে নাসিরউদ্দিন পাটোয়ারী, সস্ত্রীক সারজিস আলম ও তাসনিম জারা-খালেদ সাইফুল্লাহ দম্পতি যুক্ত হন।’

কিন্তু এর পরের ঘটনাকে দুঃখজনক হিসেবে সঙ্গায়িত করেছেন এই এনসিপি নেতা।

তিনি বলেন, ‘বিমানবন্দর থেকে আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপের ছবি ও ভিডিও করে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা মিডিয়ার হাতে তুলে দিয়েছে। কিছু মিডিয়া সেখানে ক্রাইম মুভির মিউজিক জুড়ে দিয়ে ইচ্ছেমতো মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর অভিযোগসহ সেইসব উপস্থাপন করেছে। কিছু মিডিয়া ও গোয়েন্দা সংস্থার যোগসাজশে আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপকে অপরাধপ্রবণ এবং সন্দেহজনক হিসেবে উপস্থাপন করার অপচেষ্টা চালানো হয়েছে।’

‘এমনকি গুজব ছড়ানো হয়েছে যে আমরা পিটার হাসের সাথে গোপন বৈঠকে যাচ্ছি গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র করতে। অথচ তিনি তখন বাংলাদেশেই ছিলেন না’, যোগ করেন তিনি।

এরপর তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার এই প্রবণতা, যেখানে কাউকে টার্গেট করে রাষ্ট্রদ্রোহী বানিয়ে ফেলা যায়, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে চলতে পারে না। গোয়েন্দা সংস্থা ও মিডিয়ার এই সম্মিলিত ‘ডিমোনাইজেশন’ টেকনিক আজকে আমাদের টার্গেট করেছে। ভবিষ্যতে অন্য যে কাউকে করতে পারে।’

‘সবচেয়ে আশঙ্কাজনক ব্যাপার হলো, গোয়েন্দা সংস্থা এবং কিছু মিডিয়া এই একই প্যাটার্নে হাসিনার আমলেও বিরোধী দলের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের নামে প্রোপাগান্ডা ক্যাম্পেইন পরিচালনা করতো। নতুন বাংলাদেশেও গোয়েন্দা সংস্থা এবং কিছু মিডিয়ার এই পুরনো অপরাধপ্রবণতা আমাকে একইসাথে অবাক এবং ক্ষুব্ধ করে।’

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এনসিপি নেতা তাসনিম জারার বিরুদ্ধে ‘নগ্ন ও কুরুচিপূর্ণ স্লাটশেইমিং’ পরিচালিত হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এটি এই পুরো ঘটনার সবচেয়ে দুঃখজনক ও নিন্দনীয় দিক।’

তিনি বলেন, ‘শুধুমাত্র একজন নারী হওয়ার কারণে তাসনিম জারাকে ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অশালীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচার চালানো হয়। কিছু মিডিয়া চক্রান্তমূলকভাবে তাকে কেন্দ্র করে বিভ্রান্তিকর ও আপত্তিকর শিরোনাম প্রকাশ করতে থাকে। গোয়েন্দা সংস্থা ও কিছু গণমাধ্যমের সমন্বিত এই আক্রমণ একটি নারীকে হেয়প্রতিপন্ন করার সুস্পষ্ট চেষ্টা। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই ন্যক্কারজনক আক্রমণের উদ্দেশ্য ছিল ভবিষ্যতে রাজনীতিতে অংশ নিতে আগ্রহী নারীদের নিরুৎসাহিত করা।’

গোয়েন্দা সংস্থা ও কিছু গণমাধ্যমের যোগসাজশে একজন নারীর বিরুদ্ধে এমন হীন আক্রমণ কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নয় জানিয়ে তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের পার্টির উচিত ছিল এই গোয়েন্দা সংস্থা ও অসৎ মিডিয়ার বিরুদ্ধে দৃঢ় ব্যবস্থা নেয়া। তার পরিবর্তে পার্টি এমন ভাষায় আমাদের বিরুদ্ধে শোকজ প্রকাশ করেছে, যা মিথ্যা অভিযোগ ও ষড়যন্ত্রতত্ত্বকে উসকে দিয়েছে। যেকোনো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে শোকজ করতে হয় গঠনতন্ত্র বা বাই-লজের কোনো নির্দিষ্ট ধারা লঙ্ঘনের কারণে। আমাকে দেয়া শোকজে এমন কিছুর উল্লেখ নেই।’

‘কারণ আমি পার্টির কোনো আইন লঙ্ঘন করিনি। এমন বিধিবহির্ভূত শোকজ দেয়া এবং অতি উৎসাহী হয়ে তা মিডিয়ায় প্রকাশ করা কতটুকু রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচায়ক হয়েছে, সে বিষয়ে গভীরভাবে ভাববার অনুরোধ করব। আমি এনসিপির প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ এবং মনে করি যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও গণতান্ত্রিক সহনশীলতার মাধ্যমেই আমাদের দল রাজনৈতিকভাবে আরো পরিণত হবে’, কারণ দর্শানোর নোটিশের ব্যাখ্যায় এই কথাও জানান তিনি। বিবিসি