শাহরিন সুলতান ইরা

আমি এসেছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে

শিক্ষাজীবন শেষে একটি এডুকেশন অ্যাজেন্সিতে এডমিশন অফিসার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও, ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনের সময় মিরপুর এলাকায় সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন শাহরিন সুলতান ইরা। আন্দোলনের দিনগুলোতে রাজপথে তার উপস্থিতি ছিল দৃঢ় ও স্পষ্ট।

আতাউর রহমান

Location :

Dhaka City
শাহরিন সুলতান ইরা
শাহরিন সুলতান ইরা |নয়া দিগন্ত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করা শাহরিন সুলতান ইরা বর্তমানে আপ বাংলাদেশের মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১৫-১৬ সেশনের শিক্ষার্থী ইরা ছাত্রজীবন থেকেই নেতৃত্বের গুণে পরিচিত। বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলের সাহিত্য সম্পাদক পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হয়ে তিনি প্রমাণ করেছেন- সংগঠনের বাইরে থেকেও সাহসী নেতৃত্ব সম্ভব।

শিক্ষাজীবন শেষে একটি এডুকেশন অ্যাজেন্সিতে এডমিশন অফিসার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও, ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনের সময় তিনি মিরপুর এলাকায় সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। আন্দোলনের দিনগুলোতে রাজপথে তার উপস্থিতি ছিল দৃঢ় ও স্পষ্ট।

রাজনীতিতে তার পদচারণা শুধু আদর্শগত নয়, বরং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত। খুলনা বিভাগের অন্যতম শীর্ষ ব্যবসায়ীদের একজন তার বাবা, যিনি গত ১৫ বছর ধরে ফ্যাসিবাদী সরকারের নানা হামলা, মামলা ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। অর্থনৈতিক নিরাপত্তা থাকা সত্ত্বেও, এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর তাগিদ থেকেই ইরার রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ।

তিনি বলেন, ‘রাজনীতি থেকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আদায়ের লক্ষ্য আমার নয়। কারণ সেই ব্যাকআপ আমার পরিবার থেকেই আছে। আমি এসেছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে।’

সম্প্রতি নয়া দিগন্ত অনলাইনকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেছেন।

নয়া দিগন্ত : আপনার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু কিভাবে?

শাহরিন সুলতানা ইরা : রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরুই হয়েছে আপ বাংলাদেশ থেকে। এর আগে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার বলতে, আমি ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলন করছিলাম। সেখানে একদম ফ্রন্টেই ছিলাম। ওই সময় সবচেয়ে বড় যে মিছিল হয়েছিল, একটাই মিছিল হয়েছিল সবচেয়ে বড়, কোটা সংস্কারের, শাহবাগে। ওই মিছিলের একদম ফ্রন্টে, মিডল সাইটে যে ফাস্টে ছিল সেটা আমিই ছিলাম, ছবিও আছে। ওইখান থেকেই আসলে শুরু, কোটার সময়। এরপর যথাক্রমে সড়ক আন্দোলন করছি এবং ২০১৯ সালে ডাকসু নির্বাচন করছি।

নয়া দিগন্ত : ডাকসু’তে কি কোনো প্যানেল থেকে অংশগ্রহণ করেছিলেন?

শাহরিন সুলতানা ইরা : কোনো প্যানেল না স্বতন্ত্রভাবে বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হলের সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে নির্বাচন করি এবং সর্বোচ্চ ভোট (৪২০) পেয়ে নির্বাচিত হই।

নয়া দিগন্ত : আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী নির্বাচনে কেমন ভোট পেয়েছিলেন?

শাহরিন সুলতানা ইরা : প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন মূলত দু’জন। একজন ছিলেন আওয়ামী লীগের মানে ছাত্রলীগের। উনারা তো ভোট ব্যাংক ভর্তি করে রেখেছিলেন। তার প্রার্থীতা অটোমেটিক্যালি বাতিল হয়েছিল। আরেকজন অনেক ভালো ক্যান্ডিডেট ছিলেন। কিন্তু তিনি পারেন নাই।

নয়া দিগন্ত : নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার ফলে হল বা বাইরে থেকে কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল কি না?

শাহরিন সুলতানা ইরা : ডাকসু নির্বাচন করার ফলে আমরা আসলে অনেক প্রেসারে ছিলাম। প্রেসার বলতে তখন তো পুরাই আওয়ামী লীগের আমল। তো স্বতন্ত্রভাবে ভোট করার ফলে তারা বুঝেছিল, হয় আমরা জামায়াত/শিবির। তবে বিএনপি না এটা তারা বুঝেছিল। বিএনপি হবে না। কিন্তু জামায়াত/শিবির বা ছাত্রী সংস্থা এইরকম হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। তো এটা নিয়ে তৎকালীন হলের যে সভাপতি ফরিদা আপু ম্যান্টালি টর্চার থেকে শুরু করে হুমকি ধামকি প্রচুর দিয়েছে। আমরা ডাকসু যেন সুষ্ঠুভাবে হয়, এটার জন্য আন্দোলন করছিলাম হলের সামনে। ওই সময় এমনও হয়েছে আমরা আন্দোলন সাধারণ শিক্ষার্থীরা করছি, তিনি মোটামুটি লীগের লোকজন নিয়ে এসে একদম লাঠিসোঁটা নিয়ে দাঁড়ায় আছে।

নয়া দিগন্ত : প্রচারণায় আপনাকে কী কোনো বাধা দিয়েছিল?

শাহরিন সুলতানা ইরা : প্রচারণায় কোনো বাধা দেয় নাই। বাধা দিতে পারে নাই, কারণ ওই সময় আমরা একটা ব্যাকআপ পেয়েছিলাম সাংবাদিক সমিতি থেকে। ঢাকা ইউনিভার্সিটির সাংবাদিক সমিতির সভাপতি তখন ছিল আসিফ তাহসিন ভাই। তিনিও ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন ভিপি পদেই। আমাদের প্রচুর হেল্প করেছিলেন। তখন আমরা যারা স্বতন্ত্র হিসেবে দাঁড়িয়ে ছিলাম, তিনি সবার নম্বর সংগ্রহ করেছিলেন। তিনি আমাদের সবাইকে ডেকে ছিলেন যে আপনারা নির্বাচন করেন যে যত হেল্প লাগে মানে প্রশাসনিক, প্রেসার ক্রিয়েট করার জন্য যত হেল্প লাগে আমরা করব। কিছু হলেই, কোনো ইনসিডেন্ট হলে আমাদের জানাবেন, আপনাদের যদি কেউ গুমও করে ফেলে ওইটা উদ্ধার করে নিয়ে আসব আমরা। তো এটা করতো কি করতো না, এটা জানি না, কিন্তু ওই সাহসটা পাইছি। এটার জন্যই আসলে আমরা লাস্ট পর্যন্ত টিকে ছিলাম। তবে নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন প্রচুর ঝামেলা করতো। যেমন- হলের সামনে এসে হুমকি দেয়া, তারপরে এমনও হয়েছে যে ডেকে নিয়ে গেছে, ডেকে নিয়ে গিয়ে হুমকি দিয়েছে, এ রকম হয়েছে। তারপরও লাস্ট পর্যন্ত পারে নাই।

নয়া দিগন্ত : আমরা যতটুকু জানি হলে থাকা ছাত্রদের তুলনায় ছাত্রীদের হলে বেশি টর্চার করা হয়, তো সেক্ষেত্রে আপনি কী টর্চারের শিকার হয়েছিলেন?

শাহরিন সুলতানা ইরা : হ্যাঁ, ডেকে নিয়ে টর্চার করা হয়। আমরা একটা রুম থেকে সাতজন ভোট করছিলাম। মানে আমরা গণরুমে ছিলাম, ১১০ নম্বর রুম। ওই রুমে থেকেই আমরা সবাই চিন্তা করছিলাম, না আমরা ভোট করব। আমরা যে কয়েকজন ওই সময় আন্দোলনগুলোতে ছিলাম কোটাতে বা সড়কে, আমরা চিন্তা করছিলাম যে ডাকসু নির্বাচন করা যায় এবং সবাই স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করছি।

Shahrin-Sultana-Era-02

নয়া দিগন্ত : সবার মধ্যে কী আপনিই নির্বাচিত হয়েছিলেন? না কি আপনার সাথে যারা ছিল তারাও নির্বাচিত হয়েছিলেন?

শাহরিন সুলতানা ইরা : না, আমি নির্বাচিত হয়েছিলাম, এর সাথে যে এনসিপিতে আছে এখন সাগুফতা বুশরা মিশমা, সে জিএস পদে নির্বাচন করে জিতছিল। এরপরে আমরা আরো পাঁচটা পদ পেয়েছিলাম। ওইখান থেকেই আসলে রাজনীতির পিরিয়ড শুরু, ওইটাকে আসলে ছাত্র রাজনীতিও বলে না, মানে লিডারশিপ ওই জায়গা থেকেই শুরু।

নয়া দিগন্ত : জুলাই আন্দোলনে নারীদের নেতৃত্বকে আপনি কিভাবে দেখছেন?

শাহরিন সুলতানা ইরা : আমি জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেইনি, তাই সেই ক্রেডিট আমি নিতে চাই না। ২০২২ সালে আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ হয়, এরপর আমি কর্মজীবনে যুক্ত হই এবং আন্দোলনের সময় মিরপুরে অফিস করছিলাম। তখন আমার ভার্সিটির সাথে কোনো সম্পর্ক ছিল না। প্রথমদিকে মনে করেছিলাম, এটি কোটা সংস্কার আন্দোলনের মতো ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক হবে। কিন্তু ঢাবিতে সংঘর্ষের পর বুঝি, এটি একটি বৃহত্তর গণআন্দোলনে রূপ নিচ্ছে। তখন থেকেই আমি ব্যক্তিগতভাবে, আমার বন্ধুদের সাথে আন্দোলনে যুক্ত হই।

আমি কোনো নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ছিলাম না, আন্দোলনের পরিকল্পনা বা নেতৃত্ব সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। শুধু দেখেছি, মানুষ মরছে, তবুও কেউ রাস্তা ছাড়ছে না- এই দায়বদ্ধতা থেকেই আমি মাঠে নেমেছি। মিরপুর ২ ও ১০ নম্বরে আমি সরাসরি আন্দোলনে অংশ নিই।

আমরা ছবি তোলা বা প্রচারমূলক কিছু করিনি, শুধু আন্দোলনের ফ্লোতে ছিলাম। আমার বন্ধুদের মধ্যে কেউ কেউ কোটা সংস্কার আন্দোলন ও ডাকসু নির্বাচনে যুক্ত ছিলেন, তাদের সাথে রাস্তায় ছিলাম। অফিস শেষ করে প্রতিদিন রাত ১০টা পর্যন্ত স্লোগান চলত।

৫ জুলাই সকাল ৮টায় হোস্টেল থেকে বের হয়েছি। সাথে সাথে পুলিশ আমাকে আটক করে, মোবাইল ফোন নিয়ে বসায় রাখে থানায়। আমরা তো আগে থেকেই মোবাইলের সব ডিলিট করে বাসা থেকে বের হতাম। তখন পুলিশ মোবাইল দেখে কিছু না পেয়ে বসিয়ে রেখেছে।

ওই সময় বান্ধবীরা অপেক্ষা করছে আমার জন্য। একজন সাভার থেকে আসছিল, তাকে গাবতলীতে আটকে রাখে। আরেক বান্ধবী মোহাম্মদপুরে আটক হয়।

দুই ঘণ্টা আমাকে আটকে রাখার পর পুলিশের কাছে থাকা আমার ফোনে বান্ধবী ফোন দেয় যে ঢাকা মেডিক্যালে আমার বোন ভর্তি। তখন পুলিশ বিশ্বাস করে, আমাকে ছেড়ে দেয়। পরে আমার বান্ধবীর কাছে গাবতলী যাই। সেখান থেকে ওকে নিয়ে যাই মোহাম্মদপুরে আরেক বান্ধবীর কাছে। ওকে ছাড়িয়ে আনি।

এরপর মোহাম্মদপুরে এক কোচিং সেন্টারের কাছে আমরা ২৫ থেকে ২৬ জন মেয়ে একত্রে অবস্থান করি। ওদের সাথে আন্দোলনের সময়ই পরিচয় হয়। এসময় ছাত্রলীগ আমাদের ধাওয়া দেয়, রাম দা হাতে। আমরা একটি বাসায় আশ্রয় নিই, তারা বাসা ভাঙচুর করে কিন্তু প্রবেশ করতে পারেনি। দুপুর ২টা পর্যন্ত আমরা সেখানে আটকে ছিলাম। সেখান থেকে বের হয়ে শুনতে পাই হাসিনা চলে গেছে। পরে গণভবনের দিকে যাই, আনন্দ করি।

সেখান থেকে ফেরার পথে শ্যামলীতে টিয়ারশেল পড়ে, গুলিতে দু’জন ছেলে পড়ে যায়। আমার বান্ধবী আমাকে টেনে হাসপাতালে ঢুকায়, গুলিটা আমারো লাগতে পারতো। বিকেলের ঘটনা। রাত ১০টা পর্যন্ত হাসপাতালে ছিলাম, পরে সহকর্মীরা এসে উদ্ধার করে।

সত্যি বলতে, আমি নীতি নির্ধারণে আমি ছিলাম না। এবং জানতামও না যে আন্দোলন কিভাবে চলছে? এ সম্পর্কে কোনো আইডিয়াও ছিল না। আন্দোলন হচ্ছে, কর্মসূচি দিচ্ছে, যাইতে হবে।

এরপর ভাইয়েরা তো এনসিপি গঠন করল। জানতাম এরা এ কাজই করবে। ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় থেকেই চিনি। জানতাম ওরা মোরালিটি ধরে রাখতে পারবে না। যদি কেউ মোরালিটি ধরে রাখতে পারে, তো সে আখতার (এনসিপি’র সদস্যসচিব আখতার হোসেন)। আখতার আমার সেশনের। তাই জানতাম ওর সম্পর্কে। হাসনাতের সাথে আমার পরিচয় নেই।

নয়া দিগন্ত : আন্দোলনের গতিপথ নির্ধারণে বা জনমত গঠনে নারী নেতৃত্বের কোনো বিশেষ প্রভাব ছিল কি? থাকলে, তার প্রকৃতি কেমন ছিল?

শাহরিন সুলতানা ইরা : সত্যি বলতে, আন্দোলনের গতিপথ নির্ধারণে নারীদের কোনো উল্লেখযোগ্য প্রভাব ছিল না। আমি ‘আপ বাংলাদেশ’-এ যোগ দেয়ার পর আন্দোলনের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো যতটুকু শুনেছি, তাতে স্পষ্ট হয়েছে—নীতি নির্ধারণে শুধু নারীরা নয়, বিএনপির পক্ষ থেকেও তেমন কোনো প্রভাব ছিল না।

বিএনপির কয়েকজন সক্রিয় ছিলেন, যাদের মাঝে মাঝে জানানো হতো পরবর্তী কর্মসূচি কী হতে পারে। কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর্যায়ে তারা ছিলেন না। একইভাবে, নারীরাও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ছিলেন না। অংশগ্রহণে নারীরা দৃশ্যমান ছিলেন, কিন্তু পরবর্তী দিনের পরিকল্পনা, কর্মসূচির ব্যর্থতা বা বিকল্প কৌশল—এসব বিষয়ে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না।

আপনি যদি নুসরাতের মতো একজন সক্রিয় অংশগ্রহণকারীর কাছে জিজ্ঞেস করেন, “পরের দিনের কর্মসূচি কী হবে?”—তিনি বলবেন, “আমি জানি না।” এটাই বাস্তবতা। নেতৃত্বের কাঠামোতে নারীদের ভূমিকা ছিল সীমিত, যদিও মাঠে তাদের উপস্থিতি ছিল সাহসী ও গুরুত্বপূর্ণ।

নয়া দিগন্ত : জুলাই আন্দোলনের অভিজ্ঞতা কি ভবিষ্যতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বা সামাজিক আন্দোলনে নারী অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করবে? এই আন্দোলন থেকে নারী নেতৃত্বের জন্য কী শিক্ষা নেয়া যেতে পারে?

শাহরিন সুলতানা ইরা : আমার বিশ্বাস, জুলাই আন্দোলন নারী নেতৃত্বে নতুন মাত্রা যোগ করেছে এবং ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা রেখে গেছে। তবে নেতৃত্ব বলতে আমি শুধু সমঅধিকার বুঝি না—আমি বিশ্বাস করি ন্যায্যতায়। নারী-পুরুষ সমান নয়, সেটা আমি বায়োলজিক্যাল বা সক্ষমতার দিক থেকেই দেখি। তাই নেতৃত্বের প্রশ্নে আমি সমতা নয়, ন্যায্যতা ও যোগ্যতাকে গুরুত্ব দিই।

বাংলাদেশে গত ১৫ বছরে যারা নারী সমাজকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন, তারা মূলত একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির—শাহবাগপন্থী বা বামপন্থী। তারা সংস্কার কমিশন বা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে প্রতিনিধিত্ব করলেও সাধারণ নারীদের বাস্তবতা তুলে ধরতে পারেননি। ইসলামিক বা অন্যান্য ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও নারীদের প্রতিনিধিত্ব ছিল অনুপস্থিত।

জুলাই আন্দোলনের বড় অর্জন হলো—এখানে হিজাবী, ধর্মীয়, সংস্কৃতিমনা, বামপন্থী—সব শ্রেণির নারীর নেতৃত্ব দেখা গেছে। সবাই একে অপরের প্রতি সহনশীল থেকেছেন, এবং নেতৃত্বে বৈচিত্র্য এসেছে। এই মিশ্র নেতৃত্বই ভবিষ্যতের বাংলাদেশে প্রয়োজন, যেখানে নারীরা শুধু একটি শ্রেণির প্রতিনিধি নয়, বরং সমাজের নানা স্তরের বাস্তবতা তুলে ধরতে সক্ষম হবেন।

নয়া দিগন্ত : নতুন বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীদের কেমন অংশগ্রহণ প্রত্যাশা করেন? নারীদের নিয়ে আপনার ভাবনা কী?

শাহরিন সুলতানা ইরা : ৫ আগস্টের পর নারীদের রাজনীতিতে আসার একটি অনুপ্রেরণা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে দেখা গেছে—যেসব নারী আন্দোলনের সামনের সারিতে ছিলেন, তারা নানা ধরনের সাইবার বুলিং ও হুমকির শিকার হচ্ছেন। বিশেষ করে সাইবার বুলিংয়ের মাত্রা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে, যা অত্যন্ত হতাশাজনক।

পরাজিত শক্তি ও একটি বিশেষ গোষ্ঠী নারীদের রাজনৈতিক অগ্রযাত্রাকে পিছন থেকে টেনে ধরছে। তারা নারীদের আন্দোলনে সক্রিয়তা দেখে ভয় পেয়েছে—নারীরা কী করতে পারে, তা তারা উপলব্ধি করেছে। আমার আশপাশের প্রায় প্রতিটি নারী কোনো না কোনো সময় সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়েছেন। কিছু ভুঁইফোড় মিডিয়া মেয়েদের ভিডিও কেটে প্রচার করে, যার ফলে অশালীন মন্তব্য ও অপমানজনক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। এসব কর্মকাণ্ড নারীদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করে, এবং অনেকেই রাজনীতি থেকে সরে যাচ্ছেন।

আমার পরামর্শ হলো—রাজনৈতিক দলগুলো নারীদের জন্য একটি নিরাপদ ও সম্মানজনক জায়গা তৈরি করবে, এবং তাদের আশ্বস্ত করবে যে তারা সুরক্ষিত থাকবেন। পাশাপাশি, নারীদের জন্য একটি নির্ভরযোগ্য হটলাইন চালু করা জরুরি, যাতে তারা কোনো ঘটনার পর দ্রুত প্রতিকার চাইতে পারেন। থানাগুলোতে নারীদের জন্য আলাদা হেল্প ডেস্ক স্থাপন করাও অত্যন্ত প্রয়োজন।

নারীদের সরাসরি নির্বাচনে অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় গেলে নারীরা নিজেদের কথা আরও জোরালোভাবে বলতে পারবেন, এবং নারীর ক্ষমতায়ন বাস্তবায়ন করা সহজ হবে।

যদি আমার প্রত্যাশার কথা বলি, তাহলে এখনো তা পূরণ হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকার কাজ করে যাচ্ছে, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের অনেকটাই এখনো অধরা।

Shahrin-Sultana-Era-03

নয়া দিগন্ত : তরুণদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ নিয়ে আপনার মতামত কী?

শাহরিন সুলতানা ইরা : আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি—রাজনীতিতে তরুণদের অংশগ্রহণ শুধু প্রয়োজন নয়, এটি সময়ের দাবি। তরুণরা সমাজের সবচেয়ে উদ্যমী, চিন্তাশীল এবং পরিবর্তনমুখী অংশ। তাদের নতুন ভাবনা, প্রযুক্তি-জ্ঞান এবং সাহসিকতা রাজনীতিকে আরো গতিশীল ও জনমুখী করে তুলতে পারে।

যদি আমরা ভবিষ্যতের নেতৃত্ব গড়ে তুলতে চাই, তাহলে তরুণদের মতামত, অংশগ্রহণ এবং নেতৃত্বকে গুরুত্ব দিতে হবে। আন্দোলনের মাঠে, নীতি-নির্ধারণে, এমনকি সংসদীয় রাজনীতিতেও তরুণদের জন্য জায়গা তৈরি করতে হবে।

তবে শুধু অংশগ্রহণই যথেষ্ট নয়—তরুণদের প্রস্তুত করাও জরুরি। রাজনৈতিক শিক্ষা, মূল্যবোধ, এবং জনসেবার মানসিকতা গড়ে তোলার মাধ্যমে আমরা একটি সচেতন ও দায়িত্বশীল তরুণ নেতৃত্ব পেতে পারি। আমি নিজেও সেই পথেই হাঁটছি, এবং চাই আরও তরুণরা এগিয়ে আসুক, প্রশ্ন করুক, নেতৃত্ব দিক।

নয়া দিগন্ত : রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ এখনো সীমিত। আপনি কীভাবে দেখেন নারী নেতৃত্বের ভবিষ্যৎ?

শাহরিন সুলতানা ইরা : নারী নেতৃত্ব এখন আর ব্যতিক্রম নয়—এটি সময়ের দাবি। আমাদের সমাজে নারীরা প্রতিনিয়ত বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু রাজনীতিতে সেই অগ্রগতি এখনো কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় পৌঁছায়নি। আমি বিশ্বাস করি, নেতৃত্বের জায়গায় নারীদের উপস্থিতি শুধু প্রয়োজন নয়, বরং অপরিহার্য। নারীরা সিদ্ধান্ত গ্রহণে, জনসম্পৃক্ততায় এবং ন্যায্যতার প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। ভবিষ্যতের রাজনীতি নারীবান্ধব না হলে, তা কখনোই পূর্ণাঙ্গ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে না।

নয়া দিগন্ত : আপনার নিজের অভিজ্ঞতা কী বলছে?

শাহরিন সুলতানা ইরা : ছাত্রজীবনে আমি যখন স্বতন্ত্রভাবে সাহিত্য সম্পাদক নির্বাচিত হই, তখন অনেকেই বলেছিলেন—‘নারী হয়ে সংগঠন ছাড়া জয় অসম্ভব।’ আমি প্রমাণ করেছি, সাহস আর সততা থাকলে নারীও নেতৃত্ব দিতে পারে।

রাজপথে আন্দোলনের সময় আমি দেখেছি—নারীরা শুধু স্লোগান দেয় না, তারা নেতৃত্ব দেয়, সংগঠিত করে, ঝুঁকি নেয়। তারা মাঠে থাকে, সিদ্ধান্ত নেয় এবং পরিস্থিতি মোকাবিলা করে। আমার অভিজ্ঞতা বলছে, নারীরা যদি সুযোগ পায়, তারা নেতৃত্বে সমানভাবে সফল হতে পারে।

নয়া দিগন্ত : আপনি কী বার্তা দিতে চান তরুণ নারীদের?

শাহরিন সুলতানা ইরা : আমি চাই, তরুণ নারীরা রাজনীতিকে ভয় না পেয়ে নেতৃত্বে আসুক। আমাদের সমাজে নারীদের জন্য তথাকথিত ‘নিরাপদ’ পেশা বেছে নেয়ার চাপ থাকে। কিন্তু আমি বলি—রাজনীতি নারীর জন্যও নিরাপদ হতে পারে, যদি আমরা একে নিজেদের জায়গা করে নিতে পারি।

‘আপ বাংলাদেশ’ সেই প্ল্যাটফর্ম তৈরি করছে, যেখানে নারী নেতৃত্বকে সম্মান ও সমর্থন দেয়া হয়। আমি তরুণ নারীদের বলব—সাহস রাখো, প্রশ্ন করো, নেতৃত্বে আসো। কারণ, পরিবর্তন তখনই সম্ভব, যখন নারীরা সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গায় থাকবেন।

নয়া দিগন্ত : সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

শাহরিন সুলতানা ইরা : দৈনিক নয়া দিগন্ত এবং আপনাকেও ধন্যবাদ।