আমাদের ঐক্য টিকে থাকলে জুলাই টিকে থাকবে : আকিফ আব্দুল্লাহ

উত্তাল জুলাইয়ের দিনগুলোতে দেশের তরুণ প্রজন্মের সাহসী আন্দোলনে কেঁপে উঠেছিল রাজপথ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরব ছিল এদেশের তারুণ্য, সরব ছিলেন আকিফও। বর্তমানে তিনি জুলাই জাদুঘরের চট্টগ্রাম বিভাগ প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

মিজান ফারাবী
আকিফ আব্দুল্লাহ
আকিফ আব্দুল্লাহ |সংগৃহীত

চট্টগ্রামের জামিয়া ওবাইদিয়া নানুপুরে দ্বীনি শিক্ষায় অধ্যয়নরত আকিফ আব্দুল্লাহ বর্তমানে জুলাই জাদুঘরের চট্টগ্রাম বিভাগ প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। পাশাপাশি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শহীদ, আহত সেলের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সম্পাদক হিসেবেও কাজ করছেন।

জুলাই বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অপ্রতিরোধ্য সংগ্রামের নাম। উত্তাল জুলাইয়ের দিনগুলোতে দেশের তরুণ প্রজন্মের সাহসী আন্দোলনে কেঁপে উঠেছিল রাজপথ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরব ছিল এদেশের তারুণ্য, সরব ছিলেন আকিফও। এই আন্দোলনের পেছনে ছিল দীর্ঘদিনের নিপীড়ন, অবিচার ও দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে এক অভূতপূর্ব জাগরণ। জুলাই জাগরণে হাজারো মানুষের সাথে বৈষম্যবিরোধী স্লোগানে সুর তুলেছিলেন তিনি।

নয়া দিগন্ত অনলাইনের সাথে এক একান্ত সাক্ষাৎকারে আকিফ বলেছেন উত্তাল জুলাইয়ের রক্তাক্ত স্মৃতি, প্রত্যয় এবং ভবিষ্যতের স্বপ্ন। তার অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে দেখা যায় কীভাবে মাদরাসার গণ্ডি পেরিয়ে একজন তরুণ নিজ দায়িত্বে রাজপথে নেমে আসে, কীভাবে সহযোদ্ধাদের গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত মুখ আজো তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। ঠিক এক বছর পর তিনি ফিরে তাকিয়েছেন আন্দোলন মুখর জুলাইয়ের দিকে।

নয়া দিগন্ত : জুলাই আপনার জীবনে কীভাবে এমন গভীরভাবে জড়িয়ে গেল?

আকিফ : এখনো বেশি সময় হয়নি জুলাই পার হলো। জুলাই জেগে আছে। এখনো জুলাই থেকে বের থেকে পারেনি মনে হয়। না বের হতে পারব। তাই নিজেকে জুলাইয়ের জন্য উৎসর্গ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত অনেক আগেই নিয়েছি। সে ধারাবাহিকতায় জুলাই নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। কাজ করতে গিয়ে বারবার ভয়াল স্মৃতিগুলো আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়।

Akif-02

নয়া দিগন্ত : আপনি এই আন্দোলনের সঙ্গে কীভাবে যুক্ত হলেন? শুরুটা কেমন ছিল?

আকিফ : আন্দোলনের সাথে আমার সম্পৃক্ততার শুরুটা ছিল একেবারে আবেগ আর ক্ষোভ থেকে। প্রথম মাঠে নামি ১৮ জুলাই। এর আগে, ১৬ জুলাই যেদিন পাঁচজন ভাই শহীদ হলেন সেদিন থেকেই আমার মন ভেঙে পড়ে। নিজের ভেতর এক ধরনের অসহ্য কষ্ট অনুভব করতে থাকি। মনে হচ্ছিল, আমি যদি চুপ করে বসে থাকি, তাহলে শহীদ ভাইদের প্রতি অন্যায় হবে। সেদিন থেকেই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিই, যেভাবেই হোক মাঠে নামতে হবে।

আমাদের স্লোগান ছিল, 'আমার ভাই মরল কেন, খুনি হাসিনা জবাব দে', এই কথাটার ভেতরেই ছিল আমাদের রক্তক্ষরণ আর প্রতিবাদ। এ স্লোগানে কণ্ঠ মিলিয়ে আমি বুঝি, মনে মনে সিদ্ধান্ত নেই আমি একজন সাধারণ তরুণ নই— আমি শহীদের অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সেদিন থেকেই আন্দোলনই হয়ে ওঠে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় দায়।

নয়া দিগন্ত : জুলাইয়ে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল তা আপনাকে কতটা গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল, প্রেরণা পেলেন কীভাবে?

আকিফ : দেখেন জুলাইয়ে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যে, চারপাশের অবস্থা দেখে আর স্থির থাকা যায়নি। পুলিশের গুলিতে আমার ভাই-বোনেরা মারা যাচ্ছে এর চেয়ে বড় প্রেরণা আর কী হতে পারে। আমি ওই সময়টাতে মাদরাসার ম্যানেজারের দায়িত্বে ছিলাম। মাদরাসায় কাউকে না জানিয়ে চলে যেতাম। আর বাসায় জানালে নিষেধ করবে এজন্য না জানিয়েই আসতাম।

নয়া দিগন্ত : আপনার সামনে কেউ আহত হয়েছিল?

আকিফ : হ্যাঁ, চাষাড়ায় আন্দোলনের সময় মুহুর্মুহু গুলিবর্ষণে অনেক সহযোদ্ধা আহত এবং শহীদ হন। আমি নিজের চোখে দেখেছি, কারো মুখ দিয়ে পানির মতো রক্ত গড়িয়ে পড়ছে, কেউ আবার পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন, হাঁটতেও পারছেন না। কারো শরীর ছিন্নভিন্ন, কেউ ছুটে আসছে আহতদের ধরতে।

ওই সময় রাস্তাজুড়ে কান্না আর রক্তের স্রোত। সেই দুঃসহ স্মৃতিগুলো আজও চোখের সামনে স্পষ্ট ভেসে ওঠে। এমন দৃশ্য কোনোদিন ভুলে যাওয়ার মতো নয়। জীবনের সবচেয়ে কঠিন ও হৃদয়বিদারক মুহূর্তগুলোর বললে জুলাই ভেসে উঠবে বারবার।

Akif-03

নয়া দিগন্ত : যখন ইন্টারনেট বন্ধের সময়ে আন্দোলনের খোঁজ খবর কীভাবে পেতেন?

আকিফ : ইন্টারনেট যখন বন্ধ ছিল তখন আমি আর আন্দোলনে যুক্ত হতে পারিনি। দেশে কী হচ্ছে জানার জন্য এদিক থেকে ওদিক ছুটতাম। ডিসের লাইনে টিভিতে হালকা হালকা নেটওয়ার্কে ঝিরঝির নিউজ দেখা যেত। সেটা দেখার জন্য একটার পর একটা দোকানে যেতাম।

নয়া দিগন্ত : রেজিম পরিবর্তনের আশা করছিলেন, এখন কী মনে হয়?

আকিফ : স্বপ্ন ছিল একটি রেজিম পরিবর্তনের, কিন্তু বাস্তবতায় এসেছে অপূর্ণতা আর হতাশা। তবুও তার মধ্যে আছে এক অবিচল প্রত্যয়, জুলাই যতদিন বেঁচে থাকবে, ততদিন ঐক্য টিকে থাকবে। আর ঐক্য টিকে থাকলে বাংলাদেশ টিকে থাকবে বলে মনে করি।

জুলাই তো শুধু একটি মাস নয়, এটি একটি প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে থাকবে। যতদিন এই চেতনা বেঁচে থাকবে, ততদিন এই ঐক্যও থাকবে। আর এই ঐক্যই একদিন একটি নতুন বাংলাদেশের ভিত্তি গড়ে তুলবে বলে আমি বিশ্বাস করি। হতাশার ধুলো জমলেও হৃদয়ের গভীরে আমি সেই আশার আলো জ্বালিয়ে রাখি, যেটা আমাকে এগিয়ে যেতে এখনো প্রেরণা দেয়।

নয়া দিগন্ত : ৫ আগস্ট (৩৬ জুলাই) কোথায় ছিলেন?

আকিফ : সেই দিনটা ছিল আমার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় একটি দিন। আমি তখন নারায়ণগঞ্জের চাষাড়া এলাকায় ছিলাম। চারপাশে রাজনৈতিক উত্তেজনা আর গুজবের স্রোত বইছিল। সারা দেশের মতোই আমরা চাষাড়াতেও টানটান উত্তেজনার মধ্যে দিনটা কাটাচ্ছিলাম।

হঠাৎ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার খবরটা মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ল চাষাড়ার অলিগলি, মোড়ে মোড়ে। একটা অদ্ভুত উত্তেজনায় ভাসছিল ছাত্র-জনতা। উল্লাসে ফেটে পড়েছিলাম।

নয়া দিগন্ত : গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশ নিয়ে কিছু বলেন।

আকিফ : প্রাপ্তি তো অবশ্যই আছে। আমাদের ১৩ সালের শাপলা গণহত্যাকে মানুষ এখন জানে, এটাকে নিয়ে দুঃখ করে। এখন ওপেনলি সমালোচনা করতে পারি। স্বাধীনতা তো রয়েছে। তবে আমাদের ইচ্ছা ছিল পুরো সিস্টেম পরিবর্তন হওয়া কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয়নি। আমি এমন একটি বাংলাদেশ দেখতে চাই যেখানে সকল মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে পারবে।

দেখেন এটাও সত্য, আমাদের আকাঙ্ক্ষা ছিল শুধু অতীত নিয়ে কথা বলার সুযোগ পাওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। আমাদের স্বপ্ন ছিল, এই বিকল হওয়া রেজিম পুরোপুরি বদলে দেয়া। আমরা এমন একটা রাষ্ট্র চেয়েছিলাম, যেখানে ন্যায়বিচার থাকবে, বৈষম্য থাকবে না, এবং শোষণমুক্ত এক বাংলাদেশ গড়ে উঠবে। সেই কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন এখনো আসেনি, তাই আন্দোলন শেষ হয়নি। মুক্তির লড়াই চলবে।

য়া দিগন্ত : জুলাইয়ের এক বছর কীভাবে পার করলেন?

আকিফ : জুলাইয়ের এক বছর পার হওয়া আমার জন্য দুঃখের। অনেক কষ্টের স্মৃতি নিয়ে দিন পার হচ্ছে। কারণ এক বছরেও জুলাইয়ের অনেক কাজ অপূর্ণ। শহীদ পরিবারগুলোর ভাতা, পুনর্বাসন হয়নি এখনো। আহত ভাইয়েরা ঋণ নিয়ে ঘুরছে। হাসপাতালে এখনো অনেকে পড়ে আছে। জুলাই ডে, ভাই ডে প্রতিটা শহীদের কথা মনে পড়ে আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারি না। খুব কষ্ট লাগছে।

Akif-04

নয়া দিগন্ত : প্রয়োজন হলে আবারো আন্দোলনে যাবেন?

আকিফ : শুধু বিপ্লব কেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সব সময় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকব। এটাই জুলাইয়ের শিক্ষা। এর বাইরেও যদি কোনো স্বৈরাচার মাথা চাড়া দেয়, বিপ্লবের প্রয়োজন হয়, জীবন বিলিয়ে দিয়ে আমার দেশকে তাদের হাত থেকে রক্ষা করবো। এদেশে আর কোনদিন অন্যায় ও বৈষম্যের ঠাঁই হবে না।

নয়া দিগন্ত : আপনাদের জায়গা থেকে সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক কী পদক্ষেপ নেবেন?

আকিফ : সাংস্কৃতিকভাবে জুলাইকে টিকিয়ে রাখা বড় একটা বিষয়। এতে আমাদের সুযোগ হলে আমরা তা রাখবো। আসলে সাংস্কৃতিকভাবে জুলাইকে টিকিয়ে রাখা এখন সময়ের দাবি। আমরা বিশ্বাস করি, একটি রাজনৈতিক ধারণা টিকিয়ে রাখতে হলে তার সাথে সম্পৃক্ত সাংস্কৃতিক চর্চা থাকতে হয়। গান, কবিতা, নাটক, সাহিত্যচর্চা এসবের মাধ্যমে জনগণের সাথে ভাবগত সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। যা শুধুই রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে সম্ভব নয়। সেদিক থেকে জুলাইকে ঘিরে একটি শক্ত সাংস্কৃতিক ধারা গড়ে তোলা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি।

নয়া দিগন্ত : এখন কী পরিকল্পনা করছেন?

আকিফ : এখন জুলাইকে টিকিয়ে রাখাই বড় কাজ। আমি আগেও বলেছি, জুলাই টিকে থাকলে আমরা বেঁচে থাকব, বাংলাদেশ টিকে থাকবে। জুলাইকে টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখে জীবন পার করতে চাই। জুলাই যতদিন টিকে থাকবে, ততদিন ঐক্য টিকে থাকব বলে মনে করি।

নয়া দিগন্ত : শহীদ পরিবার ও আহত ভাইদের পুনর্বাসন নিয়ে আপনি কী ধরনের উদ্যোগ বা পদক্ষেপ প্রত্যাশা করেন?

আকিফ : শহীদ পরিবার ও আহত ভাইদের পুনর্বাসনের বিষয়ে আমাদের প্রত্যাশা খুবই স্পষ্ট। আমি চাই, রাষ্ট্র বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যেন তাদের যথাযথ মর্যাদা ও সহানুভূতির সঙ্গে দেখে।

শহীদ পরিবারগুলোকে মাসিক ভাতা দেয়া, সন্তানদের শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করা, এবং ঘর-বাড়ি পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।

আর যারা আহত হয়েছেন, তাদের চিকিৎসা যেন সরকারিভাবে সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত করা হয়। অনেকেই এখনো ঋণগ্রস্ত অবস্থায় জীবনযাপন করছেন এটা খুবই কষ্টদায়ক। সরকার যেন আরো আন্তরিকভাবে পাশে থাকে এজন্য বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শহীদ, আহত সেলের হয়ে কাজ করছি।