জাতীয় পার্টিকে (জাপা) ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের দোসর উল্লেখ করে তাদের নিবন্ধন বাতিল এবং রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ প্রায় ৩০টি দল।
শুক্রবার (৫ সেপ্টেম্বর) রাজধানী শাহবাগ মোড়ে গণঅধিকার পরিষদের তিন দফা দাবিতে সংহতি সমাবেশে এ দাবি করেন ৩০ দলের নেতারা।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন নবী খান সোহেল বলেন, ‘অনেকেই অনেক স্বপ্ন দেখছে আমরা লক্ষ্য করছি, অনেকেই ভাবছেন জাতীয় পার্টি (জাপা) দিয়ে আবার আইসা (এসে) পড়বে। অনেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছেন, স্বপ্ন দেখেন। স্বপ্ন দেখতে কিন্তু বাধা নেই। স্বপ্ন দেখতে পারেন। কিন্তু একটা কথা মনে রাখবেন, শেখ হাসিনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে চ্যাপ্টার ক্লোজড। এই চ্যাপ্টার আর খোলার সুযোগ নাই। জনগণের ধাওয়ায় পালিয়ে যাওয়া স্বৈরাচার আর ফিরে আসার কোনো রকম নজির নাই। সুতরাং বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনা একটি মৃত মানুষ।’
তিনি বলেন, ‘এখন তো স্বৈরাচার পালিয়ে গেছে, এখন তো স্বৈরাচার নাই। তাহলে নূরকে রক্তাক্ত করেছে কারা? আমরা বারবার বলেছি, প্রফেসর ইউনূস সাহেবকে, আপনার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে স্তরে হাসিনার আন্ডা বাচ্চা রয়ে গেছে। তাদের বিরুদ্ধে আপনি ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। ব্যবস্থা কিছু কিছু হয়েছে, বেশি ক্ষেত্রেই হয় নাই। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা হয়েছে। এলোপ্যাথি চিকিৎসা হয় নাই।’
সংহতি সমাবেশে তিনি বলেন, ‘এখানে আমরা যারা আছি, বিভিন্ন পলিটিকাল পার্টি করি। আমাদের মধ্যে চিন্তা-ভাবনার পার্থক্য আছে, আদর্শগত পার্থক্য আছে, আমরা পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে কথা বলি, এটি সত্য। এটি তো গণতন্ত্রের সৌন্দর্য কিন্তু একটি জায়গায় আমরা কিন্তু সব একই, সেটি হলো ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে। আমরা সবাই একটা জায়গায় এক, এক শরীর এক মন, এক রক্ত এক জায়গা। ফ্যাসিবাদ বাংলাদেশে আর আমরা হতে দেবো না।’
‘আর যারা বারবার বিদেশের মাটিতে বসে বাংলাদেশকে নিজের রাডারে আনার স্বপ্ন দেখে তাদের উদ্দেশে বলতে চাই, বাংলাদেশ আর কখনোই পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের পুতুল খেলার পাত্র হবে না।’
৮৬ সাল থেকে আওয়ামী লীগ আর জাতীয় পার্টির মধুর সম্পর্ক শুরু হয়েছে, সেটি আর শেষ হয় না জানিয়ে বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘আওয়ামী লীগ এবং জাতীয় পার্টি এ যেন দু’জনে দু’জনার। যখনই এরশাদ বিপদে পড়েছেন হাসিনা তার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। যখন হাসিনা বিপদে পড়েছে বন্ধু তাকে ভুলে নাই, মন কষ্ট দেয় নাই । ঠিক সময় মতো পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। তাদের দু’জনের গুরু এক, তাদের কেবলা এক।’
ফ্যাসিস্টদের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন সোহেল বলেন, ‘একটি কথা মনে রাখবেন, ওই স্বপ্নের বাস্তবায়ন যদি বাংলাদেশে করতে আসেন বা রাস্তায় নামেন। আমরা কিন্তু আর হাত গুটিয়ে বসে থাকব না।’
সভাপতির বক্তব্যে গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, ‘নুরের ওপরে হামলা করা সেনাবাহিনী এবং পুলিশের সদস্যদের চিহ্নিত করে বিচার করতে হবে। হামলাকারীরা কোনোভাবেই সেনাবাহিনী এবং পুলিশ বাহিনীর সদস্য হতে পারে না।’
তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ অপরাধ করেছে, জাতীয় পার্টিও একই অপরাধ করেছে। এদেরকে নিষিদ্ধ করতে হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতকে আর কোনো সুযোগ দেয়া হবে না। বাংলাদেশের রাজনীতি কোথায় যাবে, আমাদের দেশ কোথায় যাবে, সেই সিদ্ধান্ত নেব আমরা।’
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, ‘গণঅধিকার পরিষদের ওপর হামলা ছিল না শুধু, এই হামলা বাংলাদেশের ওপর হামলা, এই হামলা বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ওপর হামলা। এই হামলা জুলাই রক্ষার বিরুদ্ধে হামলা। এই হামলা ছিল ফ্যাসিবাদকে আর তার দোসরদের ফিরে আসার আরেকটি অপচেষ্টার নাম।’
তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ফ্যাসিবাদ বিদায় নিয়েছে কিন্তু এই ফ্যাসিবাদ তৈরি করেছিল যারা সেই জাতীয় পার্টির সেই বহাল তবিয়তে এখনো আছে।’
তিনি বলেন, ‘প্রতিবাদের বিরুদ্ধে ছিলাম আমরা, ঐক্যবদ্ধ আছি ইনশাআল্লাহ। কোনো শক্তির কাছে আমরা মাথানত করব না। আগামী বাংলাদেশে আমাদের সবার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করব।’
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ প্রেসিডিয়াম সদস্য আশরাফ আলী আকন বলেন, ‘ভেবেছিলাম, ৫ আগস্ট থেকে এই দেশ থেকে ভারতীয় আধিপত্যবাদের ষড়যন্ত্র বন্ধ হবে, কিন্তু আমরা কি দেখতে পাই, মর্মান্তিক একটি অবস্থা। নুরের ওপরে হামলার পেছনে একটি গভীর ষড়যন্ত্র রয়েছে, এই ষড়যন্ত্র শেখ হাসিনার দোসররা।’
তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের পতন হয়েছে কিন্তু ফ্যাসিবাদের পতন হয় নাই। এই ফ্যাসিবাদ আর কোনো দিন বাংলাদেশে আসতে না পারে, আওয়ামী লীগ আর আসতে না পারে সেজন্য প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।’
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মুখ্য সংগঠক মো: আতাউল্লাহ বলেন, ‘জুলাই গণআন্দোলনে আমরা সফল হয়েছি। এর একমাত্র কারণ ছিল ঐক্যবদ্ধ ছিলাম আমরা। আমাদের মধ্যে বিভক্তি তৈরি করার পায়তারা চালাচ্ছে। আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা হয়ে ভারতীয় মিডিয়াগুলোতে গুজব ছড়াচ্ছে। জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের ১৪, ১৮ এবং ২৪-এর ডামি নির্বাচনের সহযোগী ছিল তারা কোনোভাবেই এদেশে আর রাজনীতি করার অধিকার রাখে না। তাদেরকে নিষিদ্ধ করতে হবে।’
ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ বলেন, ‘এই সংহতির সমাবেশের শুধু মনের এবং মুখের কথায় প্রকৃত, এটা জানাতে পারি। তাহলে আওয়ামী লীগ যেভাবে পালাতে বাধ্য হয়েছে ১৪ দলের সাথে তাদের দোসররাও পালাতে বাধ্য হবে। সেজন্য অবশ্যই এখানে মুখের কথার সাথে আমাদের বুকের কথার মিল থাকতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘বাইরে গিয়ে আমরা কাজের মাধ্যমে দেখা না দেখাই। জাতীয় পার্টিকে আমরা নিষিদ্ধ করতে না চাই, জাতীয় পার্টিকে যদি হজম করা হয়। একটা সময় জাতির উপরে চাপিয়ে দেয়া হবে। আওয়ামী লীগকে হজম করার জন্য আপনাদেরকে প্রস্তুত থাকতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘এত দিনে সেই মিডিয়ার সামনে চিহ্নিতদের গ্রেফতার না হওয়া শুধু অশনিসঙ্কেত নয়, এটি আবু সাঈদ এবং মুগ্ধদের রক্তের সাথে রীতিমত অপমান এবং লাঞ্ছিত করার শামিল।’
নেজামে ইসলাম পার্টি মহাসচিব মাওলানা মুসা বিন ইযহার বলেন, ‘আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি এবং ১৪ দল নিষিদ্ধ ছাড়া কোনো নির্বাচন হবে না।’
লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা: মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, ‘আমরা সংস্কার, বিচার এবং ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচনও চাই। এক বছরের অন্তর্বর্তী সরকার কতটা সংস্কার করেছেন সেটা জনতা জানতে চায়। আমরা জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধ চাই।’
লেফটেন্যান্ট কর্নেল হাসিনুর রহমান বলেন, ‘নুরের ওপরে হামলার বিচার চাই। সেই সাথে ১৬ বছরের ফ্যাসিস্টদের বিচার করতে হবে।’
জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি-জাগপার সিনিয়র সহ-সভাপতি ও মুখপাত্র রাশেদ প্রধান বলেন, ‘৫ আগস্টের পর থেকে দিল্লি সরকার শুধু আওয়ামী লীগকে প্রশয় দেয় নাই, সেইসাথে জাতীয় পার্টির মাধ্যমে এ দেশে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। কথা পরিষ্কার, এদেশ থেকে জাতীয় পার্টি এবং ১৪ দলকে চিরতরে নিষিদ্ধ করতে হবে।’
প্রগতিশীল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ফিরোজ মাহমুদ লিটন, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি চেয়ারম্যান ক্বারী মাওলানা আবু তাহের বলেন, ‘জাতীয় পার্টির এখন বিএনপিতে আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করছে। এই জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করতে হবে। এরা সহযোগিতা না করলে আওয়ামী লীগ নির্বাচন করে জোর করে ক্ষমতায় থাকতে পারত না।’
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মোহাম্মাদ মুনতাসির আলী বলেন, ‘নুরের ওপরে আঘাত মানে বাংলাদেশের রাজনীতির ওপরেই আঘাত করা হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক মেরুকরণের পরও আজকে রাজনৈতিক দলগুলোকে ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে এখনো ঐক্যবদ্ধ, এটা আনন্দদায়ক।’
জেএসডি সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক কামাল উদ্দিন পাটোয়ারী, গণসংহতি আন্দোলনের বাচ্চু ভুঁইয়া, জমিয়তে উলামায় মহাসচিব গোলাম মহিউদ্দিন ইকরাম, এনডিএম মহাসচিব মোহাম্মদ মমিনুল হক, যুব অধিকার পরিষদের সভাপতি মঞ্জুর মোর্শেদ মামুন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্সি ভাষা বিভাগের চেয়ারম্যান আবু মুসা বিল্লাহ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা ও হেফাজত নেতা আতাউল্লাহ আমিনী, বাংলাদেশ জাস্টিস পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান আবুল কাশেম মজুমদার, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি চেয়ারম্যান শামসুদ্দিন পারভেজ, ডেমোক্রেটিক লীগের সাধারণ সম্পাদক খোকন চন্দ্র দাস, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল হারুন, জনতার পার্টির চেয়ারম্যান তারিকুল ইসলাম ভুঁইয়া প্রমুখ।
উল্লেখ্য, শাহবাগে সংহতি সমাবেশের তিন দাবি হলো-গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরসহ নেতাকর্মীদের ওপর হামলায় জড়িতদের শাস্তি, আওয়ামী লীগের দোসর জাতীয় পার্টি এবং ১৪ দলের বিচার, নিবন্ধন বাতিল ও রাজনীতি নিষিদ্ধ এবং ব্যর্থতার দায়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ।