বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা: শফিকুর রহমান বলেছেন, ‘বীরদের শ্রদ্ধা না করলে এদেশে কোনো মায়ের গর্ভে আর কোনো বীর জন্মামে না।’
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের উদ্যোগে মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে সোমবার (১৫ ডিসেম্বর) বিকেলে জাতীয় প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি একথা বলেন।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে জামায়াত আমির বলেন, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধারা আমাদেরকে ভিনদেশীদের জুলুমের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। চব্বিশের বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী জুলাইযোদ্ধারা জাতিকে ফ্যাসিবাদের হাত থেকে রক্ষা করেছে।’
চব্বিশ না হলে আমরা যারা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি, ‘নির্বাচন’ শব্দও মুখে উচ্চারণ করার সাহস দেখাতে পারতাম না— উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সিইসি চেয়ার পেতেন না, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় বসতেন না বরং উপদেষ্টাদের অনেকেই জেলে বা আয়নাঘরে থাকতে হতো। এজন্য যারা ১৯৪৭ সাল থেকে আজ পর্যন্ত দেশের স্বার্থে জীবন ও রক্ত দিয়েছে আমরা তাদের সমানভাবে শ্রদ্ধা করি, স্মরণ করি।’
জামায়াত আমির বলেন, ‘জুলাই বিপ্লবের আগে জাতি দীর্ঘ ১৫ বছর ফ্যাসিবাদের জুলুমের শিকার হয়েছে। ফ্যাসিবাদের জুলুমে আমরা আমাদের অসংখ্য সহযোদ্ধাকে হারিয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘জুলাই আন্দোলনের শহীদ যোদ্ধাদের তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে আমরা যাদের তথ্য পেয়েছি বাস্তবে এর সংখ্যা অনেক বেশি। বিপ্লব-পরবর্তী বাংলাদেশে জুলাইয়ের অন্যতম বীর ওসমান হাদিকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলিবর্ষণ করার ঘটনায় আমরা শঙ্কিত। যাদের মনে সামান্য মানবিক মূল্যবোধ আছে তারা সকলেই এই ঘটনায় ব্যথিত। অথচ প্রধান নির্বাচন কমিশনার এই ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করে তিনি জাতিকে ব্যথিত করেছেন।’
সিইসিকে জাতির সামনে তার বক্তব্যের ব্যাখ্যার দেয়ার আহ্বান জানিয়ে জামায়াত আমির বলেন, ‘নয়তো জাতি পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বাধ্য হবে।’
কোনো বিভক্তি নয়, ঐক্যের ভিত্তিতে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ করা হবে উল্লেখ করে জামায়াত আমির বলেন, ‘আমাদের বন্ধুপ্রতিম সংগঠন বলেছে, তারা নির্বাচিত হলে সবাইকে নিয়ে সরকার গঠন করবে, তবে কোনো কোনো দলকে নেবে না। কিন্তু আমরা তাদেরকে সুসংবাদ দিচ্ছি- আমরা নির্বাচিত হলে জামায়াতে ইসলামী আপনাদেরকেসহ সকল ফ্যাসিবাদবিরোধী দলকে নিয়ে সরকার গঠন করবে। তবে এক্ষেত্রে জাতির সামনে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে যে, সরকারে গিয়ে কেউ দুর্নীতি করবে না, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় বাধা হয়ে দাঁড়াবে না এবং নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন করবে।’
তিনি বলেন, ‘আগামীর বাংলাদেশ বিশ্বের সভ্য জাতির সাথে প্রতিযোগিতা করার বাংলাদেশ হবে। এই বাংলাদেশ হবে মা-বোনদের ইজ্জত রক্ষার বাংলাদেশ। আর কোনো মা-বোনের কান্নার আওয়াজ শুনতে চাই না। আমরা কারো কাছে হাত পেতে জীবন চালাবো না। তরুণরা বুক ফুলিয়ে বলতে পারবে— আমরা স্বনির্ভর বাংলাদেশ। আগামীর বাংলাদেশ হবে তারুণ্যের বাংলাদেশ। এজন্যই আজকে তরুণরা টার্গেট, বিপ্লবীরা টার্গেট। কিন্তু দুয়েকজনকে সরিয়ে দিয়ে তরুণদের দমাতে পারবা না। তোমরা যদি ভালো হয়ে না যাও তবে জাতি হিসাব বুঝে নেবে। আমরা অতীত নিয়ে পড়ে থাকতে চাই না।’
‘আমরা এটাও চাই না যে, আমাদের জাতির ওপর কেউ বাহির থেকে এসে দাদাগিরি করুক। আমরা চাই সকলের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে আমাদের দেশ আমরা গড়বো। আমরা চাই বিভক্তি নয় ঐক্যের ভিত্তিতে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ হোক। জাতি ৫৪ বছরে বিভিন্ন শাসন দেখেছে, জাতি এখন মুখিয়ে আছে নতুন শাসন ব্যবস্থায় নতুন বাংলাদেশের দিকে। জাতি পুরোনো ব্যবস্থাকে পায়ের নিচে দিয়ে মাড়িয়ে নতুন ব্যবস্থায় নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চায়। নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে আমরা কারো সাথে কোনো ধরনের আপস করবো না।’
‘ফ্যাসিবাদের সাথে অনেকেই বিভিন্নভাবে আপস করলেও জামায়াতে ইসলামীর আপসের কোনো ইতিহাস নেই’- উল্লেখ করে জামায়াত আমির বলেন, ‘আমাদের কাছেও বিভিন্নভাবে আপসের প্রস্তাব এসেছে, চাপও এসেছে। তবুও আমরা কারো কাছে মাথানত করিনি। আমাদের নেতারা ফাঁসি বরণ করেছে তবুও কোনো অপশক্তির কাছে, কোনো অন্যায়ের কাছে মাথানত করেনি। আগামীতেও আমরা কোনো অন্যায়ের কাছে মাথানত করবো না।’
উপস্থিত সাংবাদিকদের উদ্দেশে জামায়াত আমির বলেন, ‘সাংবাদিকরা রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। বাকি তিন স্তম্ভকেও সাংবাদিকদেরই দেখতে হয়। আমাদের পক্ষ থেকে আমরা সাংবাদিক সমাজকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি ন্যায়সঙ্গত প্রতিটি কাজে আমরা সাংবাদিক সমাজকে সহযোগিতা করবো। সেটি যদি আমাদের বিরুদ্ধেও হয়। তবে নিউজের ক্ষেত্রে সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো বলতে হবে, লিখতে হবে। আমাদের সমালোচনা করবেন তীব্রভাবে কিন্তু সেই সমালোচনা হতে হবে দেশ ও জাতির স্বার্থে।’
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে সাংবাদিক সমাজের ভূমিকা অনস্বীকার্য উল্লেখ করে জামায়াত আমির ডা: শফিকুর রহমান, প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে জীবন ও রক্তদানকারী সাংবাদিকদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন।
সভায় বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এ টি এম মা’ছুম বলেন, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কারণেই আজ জাতি বিশ্বের দরবারে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে মাথা ঊঁচু করে দাঁড়াতে পারছে। কিন্তু বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চেতনা বিগত ৫৪ বছরেও বাস্তব রূপ লাভ করেনি। বরং স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে যখন যারা ক্ষমতায় বসেছে তখন তারা রাষ্ট্রকে তাদের পৈত্রিক সম্পত্তি মনে করেছে। মুক্তিযুদ্ধকে নিজেদের দলীয় অর্জনে আখ্যায়িত করেছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘ফ্যাসিস্ট হাসিনা গণতন্ত্রের মুখোশ পরে এদেশে যত গণহত্যা চালিয়েছে দুনিয়ার সকল গণহত্যাকে হার মানিয়েছে। হাসিনার অপশাসনের বিরুদ্ধে জাতি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ফলে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের পতন হয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের পতনের পর সেই ঐক্যে ফাটল দেখা দেয়ার কারণে পতিত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ চোরাগোপ্তা হামলা ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনার ছক কষছে।’
আওয়ামী লীগের সকল ষড়যন্ত্র রুখে দিয়ে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে বিজয়ের এই দিনে তিনি সকলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার শপথ গ্রহনের আহ্বান জানান।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান বলেন, ‘যেই চেতনায় স্বাধীনতা অর্জন করা হয়েছে বিগত ৫৪ বছরেও সেই চেতনা বাস্তবায়ন হয়নি। বরং বৃটিশ এবং পাকিস্তানিদের সৃষ্ট বৈষম্য বাংলাদেশে আজও বিদ্যমান। স্বাধীনতা লাভের পর থেকে এই পর্যন্ত যারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসেছে কেউ জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারেনি। বরং ক্ষমতাসীনরা কেবল নিজেদের ভাগ্যের উন্নয়ন সাধন করেছে। সার্বভৌমত্বের স্বাধীনতা অর্জিত হলেও মানুষ স্বাধীনতা পায়নি। যার কারণে বারবার নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই করতে হয়েছে। সবশেষ চব্বিশের জুলাই আন্দোলনের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন হয়।’
তিনি আরো বলেন, ‘ফ্যাসিবাদ সরকার পতনের পর পালিয়ে যাওয়ার পর নিরপেক্ষ সরকার গঠনের লক্ষ্যে জাতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে। কিন্তু এই সরকার কতটা নিরপেক্ষ সেটি জনগণ মূল্যায়ন করবে। তবে দুর্ভাগ্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ফ্যাসিবাদের দোসরদের বহাল রেখে রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। ফ্যাসিবাদের দোসরদের অপসারণের পরিবর্তে অনেক ক্ষেত্রে তাদেরকে প্রমোশন দেয়া হয়েছে।’
‘এজন্য জুলাই যোদ্ধা ওসমান হাদিকে হত্যার টার্গেটে পরিচালিত কিলিংয়ের সাথে জড়িত কাউকে আজও গ্রেফতার করা যায়নি। এই ঘটনায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করা উচিত ছিল। তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করলে নিজের নৈতিকতার প্রমাণ দিতে পারতেন,’ বলেন তিনি।
তিনি নতুন বাংলাদেশ গড়তে সন্ত্রাসীদের মোকাবেলায় ফ্যাসিবাদবিরোধী সকল শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘এটিই হতে পারে বিজয় দিবসের অঙ্গীকার।’
কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমির মো: নূরুল ইসলাম বুলবুলের সভাপতিত্বে এবং ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের অফিস সেক্রেটারি কামরুল আহসান হাসানের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত সভায় আরো বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য অ্যাডভোকেট জসিম উদ্দিন সরকার, কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের নায়েবে আমির আব্দুস সবুর ফকির, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য অ্যাডভোকেট ড. হেলাল উদ্দিন, বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি কবির আহমেদ, মহানগরীর কর্মপরিষদ সদস্য যথাক্রমে অধ্যাপক মোকাররম হোসাইন খান, অ্যাডভোকেট এস এম কামাল উদ্দিন, সৈয়দ জয়নুল আবেদীন প্রমুখ।
এসময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সহকারী সেক্রেটারি মুহাম্মদ শামছুর রহমান, মহানগরীর কর্মপরিষদ সদস্য যথাক্রমে আব্দুস সালাম, শাহীন আহমেদ খান, মহানগরীর সহকারী প্রচার সম্পাদক আবদুস সাত্তার সুমন, সহকারী মিডিয়া সম্পাদক আশরাফুল আলম ইমন, সহকারী অফিস সম্পাদক মুজিবুর রহমানসহ মহানগরীর বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বশীল নেতৃবৃন্দ।
সভাপতির বক্তব্যে মো: নূরুল ইসলাম বুলবুল বলেন, ‘নয় মাসের আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা স্বাধীন ভূখণ্ড লাভ করেছি। কিন্তু আমরা স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ ভোগ করতে পারিনি। আমাদের কথা বলার স্বাধীনতা ছিল না। আমাদের স্বাধীনতাকে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের কাছে বর্গা দেয়া হয়েছিল। আমরা আমাদের হারিয়ে যাওয়া সার্বভৌম শক্তি ছিনিয়ে এনেছি চব্বিশের ৫ আগস্ট। আগামী দিনে সুখি-সমৃদ্ধ বৈষম্যহীন এক কল্যাণ ও মানবিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার মাধ্যমে স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ প্রতিটি মানুষের ঘরে-ঘরে পৌঁছিয়ে দেয়া হবে।’
সন্ত্রাস-চাঁদাবাজ-দুর্নীতিবাজ মুক্ত নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে জুলাই জাতীয় সনদের পক্ষে গণভোটে ‘হ্যাঁ’ ভোট দিতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান তিনি।



