নির্বাচনের আগে ৩ চ্যালেঞ্জের মুখে বিএনপি

তারেক রহমানের দেশে ফেরায় বিলম্ব, খালেদা জিয়ার অসুস্থতা ও মনোনয়ন নিয়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দল- এই তিন বড় চ্যালেঞ্জে আছে বিএনপি। দল এসব সঙ্কট সামাল দিয়ে ঐক্য বজায় রাখার চেষ্টা করছে।

নয়া দিগন্ত অনলাইন
বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান
বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান |ফাইল ছবি

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপির ঘোষিত কিংবা সম্ভাব্য প্রার্থীদের নিজ নিজ এলাকায় ব্যাপক সক্রিয় দেখা গেলেও দলটির সামনে কার্যত তিনটি বিষয় এখন বিশেষ চ্যালেঞ্জ বা সঙ্কট হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দলের বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে যে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে তারেক রহমানের দেশে ফেরার তারিখ এখনো ঠিক না হওয়া, বেগম খালেদা জিয়ার অসুস্থতা ও দলীয় মনোনয়নকে ঘিরে বিরোধ-কোন্দল বেড়ে যাওয়া নিয়ে এক ধরনের উদ্বেগ তৈরি হয়েছে দলের সব স্তরেই।

দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কবে দেশে ফিরবেন- তা নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা আছে দলের ভেতরেই।

উদ্বেগ দেখা দিয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে কেন্দ্র করেও। দলের পক্ষ থেকে ‘উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো কিছু হয়নি’ বলার হলেও তা দেশজুড়ে দলটির নেতাকর্মীদের কতটা আশ্বস্ত করতে পেরেছে তা নিয়ে সংশয় আছে।

অন্যদিকে, নির্বাচনকে সামনে রেখে বহু নির্বাচনী এলাকায় অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বেড়েই চলেছে, যা সামাল দিতে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বিরোধ তৈরি হচ্ছে সমমনা দলগুলোর জন্য খালি রাখা আসন নিয়েও।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ অবশ্য বলছেন, খালেদা জিয়ার উপস্থিতিই বিএনপির জন্য বড় শক্তি এবং সে কারণেই তার স্বাস্থ্য নিয়ে কর্মী সমর্থকদের উদ্বিগ্ন হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু তারেক রহমান কেন এখনো ফিরছেন না সেটি বলা হচ্ছে না বলেই নানা ধরনের আলোচনা ডালপালা মেলছে।

তবে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির অন্যতম শীর্ষ নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলছেন, মনোনয়ন সংক্রান্ত সমস্যা নিরসনে দলের ভেতরে কাজ চলছে। অন্যদিকে খালেদা জিয়া দ্রুতই সুস্থ হয়ে উঠবেন আর তারেক রহমানও দ্রুতই দেশে ফিরবেন বলে আশা করছেন তারা।

তারেক, খালেদা ও নির্বাচন

অক্টোবরেই বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিলো যে নভেম্বরেই লন্ডন থেকে দেশে ফিরবেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ওই মাসেই বিবিসি বাংলাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তারেক রহমান নিজেও দ্রুত ফেরার আশা প্রকাশ করেছিলেন।

তখন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছিলেন, নভেম্বরের মধ্যেই তারেক রহমানের দেশে ফেরার আশা করছেন তারা।

তবে বাস্তবতা হলো নভেম্বর শেষ হতে আর চার দিন বাকি থাকলেও দলটি এখনো তার দেশে ফেরার তারিখ ঘোষণা করতে পারেনি। যদিও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে থাকা সব মামলারও নিষ্পত্তি হয়ে গেছে।

এর মধ্যে ঢাকায় তার জন্য বাড়ি প্রস্তুত করা ও বুলেট প্রুফ গাড়ি কেনার তৎপরতা নিয়ে একাধিক খবর এসেছে সংবাদ মাধ্যমে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ইতোমধ্যেই দু’টি বুলেট প্রুফ গাড়ি কেনার অনুমোদন দেয়া হয়েছে বলে বিএনপির দিক থেকে জানা গেছে।

কিন্তু তারপরেও তিনি আসছেন না কেন কিংবা তার আসার বিলম্বের ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো সমস্যা তৈরি হয়েছে কি-না নাকি দলীয় কোনো কৌশলের অংশ হিসেবেই তিনি আসতে বিলম্ব করছেন- এসব নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা হচ্ছে দলের ভেতরে ও বাইরে।

দলের একাধিক নেতা অবশ্য ইঙ্গিত দিয়েছেন, সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হওয়ার পর তারেক রহমান দেশে ফিরবেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলছেন, তফসিল ঘোষণার পরেও যদি তারেক রহমানের আসতে বিলম্ব হয় তা হলে ‘অনেকের মধ্যে যে সন্দেহ’ তা আরো ডালপালা মেলবে এবং বিএনপির জন্যও সেটি সঙ্কট তৈরি করবে।

খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, তারা আশা করছেন তারেক রহমান আসার প্রস্তুতি নিচ্ছেন এবং শিগগিরই দেশে ফিরবেন। তবে এখনো কেনো তার আসা বিলম্বিত হচ্ছে তা নিয়ে কোনো মন্তব্য তিনি করেননি।

অন্যদিকে ফেব্রুয়ারির সম্ভাব্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপির দিক থেকে যে প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করা হয়েছে, তাতে দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নাম তিনটি আসনের বিপরীতে প্রার্থী হিসেবে রাখা হয়েছে।

গত ১৩ নভেম্বর বিএনপি ২৩৭ আসনের প্রার্থীদের (পরে একটি আসনে প্রার্থিতা স্থগিত করা হয়) নাম ঘোষণা করেছিল। সেখানে খালেদা জিয়াকে তিন আসনে প্রার্থী করার বিষয়টি অনেককেই বিস্মিত করলেও বিএনপির অভ্যন্তরে এটি কর্মী সমর্থকদের উদ্বুদ্ধ করেছিল বলে মনে করা হয়।

যদিও দীর্ঘদিন ধরেই চিকিৎসাধীন থাকায় এবারের নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হচ্ছেন না বলেই অনেকে আগে ধারণা করেছিলেন। আবার যখন নাম ঘোষণা হলো, তখন দলের ভেতরে এমন আলোচনাই জোর পাচ্ছিল যে খালেদা জিয়াকে সামনে রেখেই নির্বাচনটি করতে চাইছে বিএনপি।

কিন্তু হুট করে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি এবং সে কারণে গত রোববার তাকে আবার হাসপাতালে ভর্তির পর দলের ভেতরে তার শারীরিক অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

চিকিৎসকদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, তিনি নতুন করে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন এবং তার হৃদযন্ত্র ও ফুসফুসে সংক্রমণ ধরা পড়েছে।

তার চিকিৎসকদের দলের একজন সদস্য মঙ্গলবার জানিয়েছেন, ‘তাকে খুবই নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। সেখানে সার্বক্ষণিক মনিটর, ডাক্তার ও নার্স রাখা হয়েছে। মেডিক্যাল বোর্ড প্রতিটি মুহূর্ত সক্রিয় আছে।’

খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলছেন, তারাও আশা করছেন যে খালেদা জিয়া দ্রুতই চিকিৎসা শেষে বাসায় ফিরবেন এবং সামনে থেকেই দলের নেতৃত্ব দিয়ে যাবেন।

কিন্তু তারপরেও দলের বিভিন্ন পর্যায়ে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ দেখা যাচ্ছে এবং দলের পক্ষ থেকে দেশের মানুষের কাছেও দোয়া চাওয়া হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় দোয়া-মিলাদের আয়োজন করছে দলের বিভিন্ন ইউনিট।

মহিউদ্দিন আহমদ বলছেন, খালেদা জিয়া বিএনপিকে দীর্ঘকাল ধরে সঙ্কটকালে ঐক্যবদ্ধ রেখে দলটির প্রতীকে পরিণত হয়েছেন এবং সে কারণেই তাকে নিয়ে কর্মী সমর্থকদের মধ্যে উদ্বেগ থাকাই স্বাভাবিক।

তিনি বলেন, ‘তিনি (খালেদা জিয়া) সরাসরি নেতৃত্ব দিতে না পারলেও তাকে সামনে রেখেই বিএনপিকে নির্বাচনে যেতে হচ্ছে। কারণ তিনিই দলটির ঐক্যের প্রতীক। অসুস্থ থাকলেও তিনি আছেন এবং এটিই দলটির জন্য বড় শক্তি। খালেদা জিয়া না থাকলে পরিস্থিতি কী হবে সেটা বোঝা যাচ্ছে না।’

অন্যদিকে দলটি যেসব আসনে প্রার্থিতা ঘোষণা করেছে, তার মধ্যে প্রায় ৫০টির মতো আসনে ঘোষিত প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি পালন বা বক্তব্য দিচ্ছেন সেসব এলাকার বিএনপির অন্য মনোনয়ন প্রত্যাশীরা।

কোনো কোনো জায়গায় সড়ক অবরোধ, বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধনের মতো কর্মসূচি পালিত হয়েছে এবং প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে ক্রমশ এ ধরনের প্রতিক্রিয়া বাড়ছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়, যা অনেক জায়গায় দলটিকে অস্বস্তিতেই ফেলেছে।

এছাড়া সমমনা দলের নেতাদের জন্য যেসব আসন বিএনপি শূন্য রেখেছে এখনো সেগুলোকে ঘিরেও নতুন সঙ্কট তৈরি হচ্ছে। এ ধরনের বেশ কিছু আসন বিএনপি স্থানীয় নেতৃত্ব অন্যদের ছেড়ে দেয়ার বিপক্ষে অবস্থান নেয়ায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

এমন প্রেক্ষাপটে যেসব আসনের প্রার্থীর বিরুদ্ধে গ্রহণযোগ্য অভিযোগ আছে কিংবা যেখানে যোগ্য আরো ‘ত্যাগী’ নেতা আছেন সেসব এলাকায় প্রার্থিতা নিয়ে নতুন করে পর্যালোচনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে।

সোমবার তারেক রহমানের সভাপতিত্বে দলের স্থায়ী কমিটির সভাতেই এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে।

ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন এ সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, মনোনয়ন নিয়ে দলের মধ্যে কাজ এখনো চলছে এবং তার আশা শিগগিরই এ নিয়ে তৈরি হওয়া সমস্যা কেটে যাবে।

তিনি বলেন, ‘এটাকে সঙ্কট বলা যাবে না। বিএনপির মতো বড় দলে এটা স্বাভাবিক। আমরা এগুলো নিয়ে কাজ করছি। এগুলো থাকবে না এবং আমাদের নেতাকর্মীরা সারাদেশেই সবাই মিলে দলীয় প্রার্থীর পক্ষেই কাজ করবে।’

সূত্র : বিবিসি