অন্তর্বর্তী সরকারে শিক্ষার্থী প্রতিনিধি হিসেবে শপথ নেয়া দুই উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ও আসিফ মাহমুদ আসন্ন নির্বাচনে অংশ নেবেন কিনা, তা নিয়ে বেশ জোর আলোচনা চলছে রাজনীতির মাঠে।
নির্বাচনে অংশ নেয়ার আগ্রহের কথা আগেই জানিয়েছিলেন আসিফ মাহমুদ। তবে কোনো দলের প্রার্থী হবেন নাকি স্বতন্ত্র পদে দাঁড়াবেন, সে বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেননি বলে জানিয়েছিলেন তিনি।
অন্যদিকে মাহফুজ আলম নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন বলে কয়েকদিন আগে এনসিপির এক সভায় বক্তব্য দেন তার ভাই মাহবুব আলম।
সম্প্রতি বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির নেতারা প্রধান উপদেষ্টার সাথে দেখা করে কয়েকজন উপদেষ্টার বিষয়ে তাদের আপত্তি জানান।
এ নিয়ে চলমান আলাপ-আলোচনার মধ্যেই গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়, সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে দুই উপদেষ্টাকে পদত্যাগের পরামর্শ দেয়া হয়েছিল।
এ বিষয়ে জানতে দুই উপদেষ্টার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে সূত্র বলছে, নির্বাচন ঘিরে নানা সমীকরণে এখনই পদত্যাগের কথা ভাবছেন না তারা।
জুলাই গণ-অভ্যত্থানে আওয়ামী লীগের শাসনের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে এই দু’জনসহ তিনজন জায়গা পান।
সরকারে যাওয়া তিনজনের মধ্যে নাহিদ ইসলাম পদত্যাগ করে যোগ দেন আন্দোলনের সামনের সারির নেতাদের নিয়ে গড়ে ওঠা দল জাতীয় নাগরিক পার্টি- এনসিপিতে।
সরকারের ওপর এনসিপির প্রভাব বিস্তারে পরোক্ষভাবে শিক্ষার্থী উপদেষ্টাদের যে ভূমিকা ছিল, নাহিদ ইসলামের পদত্যাগের পর তার অনেকটাই কমে গেছে।
ফলে বাকি দু’জন উপদেষ্টাও যদি পদত্যাগ করেন তাহলে সরকারের সাথে সম্পর্কে ফাটল ধরার শঙ্কা আছে এনসিপিতে।
নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারীর পদত্যাগ নিয়ে গুঞ্জন
এনসিপি থেকে দলটির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী পদত্যাগ করছেন, বৃহস্পতিবার এমন একটি খবর ছড়িয়ে পড়ে।
সূত্রের বরাত দিয়ে প্রকাশিত খবরগুলোয় বলা হয়, উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সরকার থেকে পদত্যাগ করে এনসিপিতে যোগ দেয়ার কথা ভাবছেন। সেক্ষেত্রে দলে এসে নির্বাচন ও সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্বে আগ্রহ প্রকাশ করেন তিনি, যাতে সমর্থন দেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব।
কিন্তু বর্তমানে এর দায়িত্বে থাকা নাসীরুদ্দীন এই সিদ্ধান্তে মনঃক্ষুন্ন হয়ে পদত্যাগপত্র জমা দেন বলে খবরে বলা হয়। যদিও ‘পদত্যাগের বিষয়টি কিংবা দল থেকে অব্যাহতি নেয়ার বিষয়টি সঠিক নয়’ জানিয়ে রাতেই বিজ্ঞপ্তি দেয় এনসিপি।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচন সামনে রেখে দলের অভ্যন্তরে শীর্ষ পদগুলোতে বেশ কিছু পরিবর্তনের আলোচনা চলছে। সেখান থেকেই এই আলোচনার সূত্রপাত হতে পারে। এমনকি আসিফ মাহমুদের এনসিপিতে যোগ দেয়ার গুঞ্জনও সঠিক নয় বলে জানিয়েছেন একাধিক এনসিপি নেতা।
বরং বিএনপির সাথে ‘নেগোসিয়েশন’ করে তিনি স্বতন্ত্র পদে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কথা ভাবছেন, এমন গুঞ্জনও শোনা যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে বা পরে পদত্যাগ করতে পারেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ।
এদিকে গত ১৭ অক্টোবর লক্ষ্মীপুরে এনসিপির এক সভায় উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের ভাই মাহবুব আলম বলেন, ‘আগামী সংসদ নির্বাচনে লক্ষ্মীপুর-১ (রামগঞ্জ) আসনে প্রার্থী হতে পারেন অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম।’
গত মাসের শেষের দিকে এক সংলাপে উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেন, ‘গত দুই মাস ধরে আমি অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি যে আমি কখন নেমে যাই। মানে আমি কখন নামব আমি জানি না।’
রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে পদত্যাগ চাওয়ার প্রসঙ্গ টেনে তিনি একথা বলেন। ফলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের চাপ এবং নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া, দুই দিক থেকেই মাহফুজ আলমের পদত্যাগের আলোচনাটি সামনে এসেছে।
কিন্তু নির্বাচনের আগ দিয়ে রাজনীতিতে যে সমীকরণ দেখা যাচ্ছে, তাতে করে শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদের দু’জনই যদি পদত্যাগ করেন এবং গণ-অভ্যুত্থানের সাথে সংশ্লিষ্ট কেউই যদি সরকারে না থাকেন, তবে সার্বিক পরিস্থিতির ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না বলে মনে করছেন গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেয়া কেউ কেউ।
আর তাই আসিফ মাহমুদ নির্বাচনে অংশ নিলেও মাহফুজ আলম নির্বাচন না করে সরকারে থাকার কথাই ভাবছেন বলে তাদের ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো বলছে।
উপদেষ্টাদের পদত্যাগের আলোচনা, কিভাবে দেখছে এনসিপি?
নির্বাচনের আগে কেবল শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদের থেকে হওয়া দুই উপদেষ্টার পদত্যাগ চাওয়ার বিষয়টিকে সন্দেহের চোখে দেখছেন এনসিপি নেতারা।
রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে দু’জন উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবি এবং সরকার থেকে তাদের পদ ছাড়ার পরামর্শকে পরিকল্পিত বলেই মনে করছেন তারা।
তারা বলছেন, নানা পক্ষের মতামতের ভিত্তিতে অন্তর্বতী সরকার সরকার গঠন করা হয়েছিল। গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি হয়ে তারা সরকারে গেছেন। কিন্তু সরকারে গঠনের ছয় মাস পর আত্মপ্রকাশ করা এনসিপির সাথে তাদের মিলিয়ে ‘প্রচারণা কিংবা পদত্যাগ করতে বলা উদ্দেশ্যমূলক’।
এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘দুই উপদেষ্টাকে দলীয় হিসেবে দেখানোর প্রবণতা যদি থেকে থাকে, অনেক উপদেষ্টাই আছেন যাদের রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড আছে, যারা কোনো একটা দলকে সরকারের ভেতরে থেকে সমর্থন করে যাচ্ছেন।’
তার দাবি, কেবল পূর্বতন রাজনৈতিক পরিচয় বা সখ্যতার বিষয়কে দলীয় হিসেবে বিবেচনা করা হলে সরকার ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের অনেকেই বিএনপি ও জামায়াতের সাথে গভীর সখ্যতা রেখে চলেন। ফলে তাদের জায়গাটাও পুনর্গঠন করা দরকার বলে মন্তব্য করেন তিনি।
রাজনীতিতে কী প্রভাব পড়বে?
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সময় এতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সেনাবাহিনী এবং শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি যুক্ত করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে নানা ইস্যুতে আলাপ-আলোচনায় এক ধরনের ভারসাম্যও দেখা গেছে।
কিন্তু দল গঠনের জন্য নাহিদ ইসলামের পদত্যাগের পর সরকারের ওপর শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদের নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই নড়বড়ে। এরই মধ্যে এগিয়ে আসছে নির্বাচন। এনসিপি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠছে শিক্ষার্থী প্রতিনিধি দুই উপদেষ্টার বিরুদ্ধে।
রাজনীতি পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, নির্বাচনে দাঁড়ানোর আগ্রহ থাকলেও আরো লম্বা সময় ক্ষমতা ধরে রাখার উদ্দেশ্যে ওই দুই উপদেষ্টা এখনো পদত্যাগ করছেন না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক সাব্বির আহমেদ বলেন, ‘ক্ষমতার চেয়ারে থাকার লাভ তো অন্যরকম। যতদিন আপনি ক্ষমতার চেয়ারে ততদিন আপনি প্রভাব-প্রতিপত্তি এনজয় করতে পারবেন।’
তবে নির্বাচনের নিরপেক্ষতার স্বার্থে শিক্ষার্থী উপদেষ্টাদের ‘চলে যেতে হবে’ বলেই মত তার। এমনকি আসিফ মাহমুদ ও মাহফুজ আলম পদত্যাগ করলেও সরকারের সাথে এনসিপির সম্পর্ক খারাপ হবে না বলে মনে করেন তিনি।
সাব্বির আহমেদের মতে, এই শিক্ষার্থীরা অধ্যাপক ইউনূসকে ক্ষমতায় বসিয়েছেন। আর এনসিপি গঠনের ক্ষেত্রেও তার নিজস্ব আগ্রহ কাজ করেছে।
ফলে কেবল পদত্যাগ করলেই ‘এনসিপির পেছন থেকে মেন্টর হিসেবে অধ্যাপক ইউনূস চলে যাবেন, সেটা ভাবার এখনই বোধহয় সময় আসেনি।’
সূত্র : বিবিসি



