বাংলাদেশে গত বছর শেখ হাসিনার সরকারের পতন ও তার ভারতে নির্বাসনের পর থেকে নতুন শখ গড়ে তোলার বা পুরনো কোনো পছন্দের কাজে মনোযোগ দেয়ার সময় পাননি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা মোহাম্মদ এ আরাফাত। দলীয় কাজেই দিনরাত ব্যস্ত সময় পার করছেন তিনি আর স্বপ্ন দেখছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন ঘটিয়ে শেখ হাসিনাকে আবারো দেশে ফিরিয়ে আনা। তিনি এই সরকারকে ‘অবৈধ’ বলে দাবি করছেন।
সাবেক এই তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ফোনে দ্য প্রিন্ট-কে বলেন, ‘হাসিনা দেশ ছাড়ার পর থেকেই বাংলাদেশ খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে। আমার লক্ষ্য একটাই- বাংলাদেশকে আবার সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা। আমার আসলে এখন কোনো শখ নেই বা খেলাধুলা করার সময় নেই। জীবনে অন্য কোনো বিনোদনে নিজেকে জড়ানোর সুযোগও নেই।’
৫১ বছর বয়সী সাবেক শিক্ষাবিদ আরাফাত প্রায় চব্বিশ ঘণ্টাই কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। তিনি বলেন, ‘আমার ঘুমের নির্দিষ্ট সময়ও নেই। অনেক সময় ভোর আর সন্ধ্যার পার্থক্যই বুঝতে পারি না। প্রতিদিনের জীবন কেবল কাজ, কাজ আর কাজের ভেতরেই আটকে আছে।’
তার জন্য কাজ মানেই বাংলাদেশে রাজনৈতিক কর্মসূচি পরিকল্পনা করা এবং দেশজুড়ে থাকা আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি নির্বাসিত সিনিয়র নেতাদের সাথে প্রতিদিন যোগাযোগ রাখা।
শেখ হাসিনাকে অনুসরণ করে ভারতে পাড়ি জমানো আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের মধ্যে আরাফাত একজন। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট কোটা সংস্কারবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দেশজুড়ে বিক্ষোভে রূপ নেয় এবং একপর্যায়ে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। এরপর থেকে প্রায় এক হাজার ৩০০ সাবেক মন্ত্রী, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ের নেতা, যুবলীগ এবং ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী ভারতে ও বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তে নির্বাসনে রয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের একজন সাবেক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যের মতে, শুধু আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিদ বা দলীয় কর্মীই নয়, তাদের সাথে নির্বাসনে গেছেন সাংবাদিক, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, সেনা কর্মকর্তা, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য ও কূটনীতিকরাও। তার ভাষায়, ‘ড. মুহাম্মদ ইউনুসের প্রশাসন আমাদের বিরুদ্ধে যে উইচ হান্ট শুরু করেছিল, তাতে অনেকে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। সব মিলিয়ে এই সংখ্যা দুই হাজার ছাড়িয়ে গেছে।’
যারা ভারতে আছেন তারা বেশিভাগই নিউ টাউনে বসতি স্থাপন করেছেন। এটি মূলত কলকাতার উপকণ্ঠে একটি দ্রুত বর্ধনশীল পরিকল্পিত স্যাটেলাইট শহর। প্রশস্ত রাস্তাঘাট, ভাড়ার জন্য সাশ্রয়ী মূল্যের অ্যাপার্টমেন্টের সহজলভ্যতা, শপিং মল, ফিটনেস সেন্টার এবং নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছাকাছি থাকার কারণে নিউ টাউন তাদের জন্য আদর্শ আবাসস্থল হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশে থাকা পরিবারের সদস্যদের থেকে যারা এখন দূরে আছেন, তাদের জীবন একরকম নির্দিষ্ট ছকে বাঁধা পড়েছে- ফজরের নামাজ, সকালবেলায় হাঁটা বা জিম সেশন, প্রতিদিন সন্ধ্যায় বাংলাদেশের ভেতরে ও বিদেশে থাকা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সাথে অনলাইন বৈঠক, আর ফেরার আশায় দিন গোনা। তাদের মধ্যে বাংলাদেশের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও রয়েছেন। যাকে গত অক্টোবরে এই এলাকায় দেখা গিয়েছিল।
‘এখানে আরাম করতে আসিনি’
২০২৪ সালের ২ অক্টোবর বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামালকে কলকাতার জনপ্রিয় বিনোদনকেন্দ্র নিক্কো পার্কে দেখা গেছে। এ খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। কেউ তাকে দেশ ছাড়তে দেখেনি। তিনি কিভাবে ঢাকা থেকে অদৃশ্য হয়ে কলকাতায় আবির্ভূত হলেন, তা জনগণকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ঢাকার আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো হিমশিম খাচ্ছিল। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডসংক্রান্ত একাধিক মামলায় ইতোমধ্যেই তার নাম উঠে আসে। শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগ সরকারের যে ক’জন মন্ত্রী ও এমপির খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না, তিনি ছিলেন তাদের মধ্যে একজন।
অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক (ভারপ্রাপ্ত) শাহ আলম স্থানীয় গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখেছি। যদি তারা ইমিগ্রেশন পার করে আসত, তাহলে আমাদের কাছে প্রমাণ থাকত। কিন্তু এখানে কোনো প্রমাণ নেই। অনেক (আওয়ামী লীগ মন্ত্রী ও নেতা) অবৈধভাবে দেশ ছেড়েছেন। কেউ কেউ এখনো দেশে আছেন, আবার অনেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়েছেন।’
নিউ টাউনে বসবাসরত আওয়ামী লীগের একজন সাবেক সাংসদ দ্য প্রিন্ট-কে জানান, তিনি নিয়মিতই আসাদুজ্জামান খানের সাথে দেখা করেন। তার মতে, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এখন ওই এলাকায় একটি বড় অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়েছেন। সেখানে নিয়মিত তার দলীয় সহকর্মী ও নতুন প্রতিবেশীরা আসেন। তিনি স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে কলকাতায় থাকেন, আর প্রতি সপ্তাহে দিল্লি যান দলীয় বৈঠক এবং ভারতের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগের জন্য। তার ছেলে সাফি মুদ্দাসসির খান জ্যোতি গত বছরের সেপ্টেম্বরে ঢাকায় গ্রেফতার হন।
সাবেক ওই এমপি বলেন, দলের নেতা-কর্মীদের মনোবল ধরে রাখার দায়িত্ব এখন আসাদুজ্জামান খানের ওপর। ‘আমরা এখানে আরাম করতে বা অনির্দিষ্টকাল থাকার জন্য আসিনি। আমরা এসেছি বাঁচার জন্য, আর আগামী দিনের লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত থাকতে,’ প্রতিদিন এভাবেই দলীয় সহকর্মীদের উদ্দেশে বার্তা দেন সাবেক মন্ত্রী।
আসাদুজ্জামান খান সাপ্তাহিক দিল্লি ভ্রমণ ও কলকাতায় প্রতিদিনের বৈঠকে ব্যস্ত থাকলেও, তার বিপরীতে আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতারা গত আগস্ট থেকে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন।
গোপন দলীয় অফিস?
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কক্সবাজারের একজন সাবেক আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য বলেন, তাদের জীবন এখন নির্দিষ্ট একটি ছকে বাঁধা। তিনি বলেন, ‘আমি খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠি এবং আমার সাথে থাকা আরেকজন আওয়ামী লীগ এমপির সাথে তিন বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্টে ফজরের নামাজ পড়ি। তারপর আমরা দুজনেই এলাকার ফিটনেস স্টুডিওতে যাই, যা বেশ উন্নতমানের। আমি ওয়েট ট্রেনিং করি, আর আমার ফ্ল্যাটমেট পিলেটস ক্লাসে ভর্তি হয়েছেন।’
দেড় হাজার বর্গফুটের এই অ্যাপার্টমেন্টের মাসিক ভাড়া ৩০ হাজার রুপি। সাবেক এই এমপির কাছে এটি খুব বেশি অর্থ মনে হয় না। তবে ঝামেলা হয় রান্নার লোক আর গৃহপরিচারিকা অকারণে ছুটি নিলে।
দুপুরের খাবারের পর একটু বিশ্রাম নিয়ে তাদের সন্ধ্যা কাটে বাংলাদেশ, ভারত ও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সাথে অনলাইন বৈঠকে। সেখানে তারা দেশে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক খবর নিয়ে আলোচনা ও বিশ্লেষণ করেন এবং পরবর্তী পদক্ষেপের পরিকল্পনা নেন।
সম্প্রতি বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম কলকাতায় আওয়ামী লীগের গোপন কার্যালয় সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। যার বিষয়ে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো অবগত। তবে কক্সবাজারের ওই সাবেক এমপি এ অভিযোগ অস্বীকার করেন।
তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, নিউ টাউনে আমরা একটা জায়গা ভাড়া নিয়েছি। সেখানে আমরা সবাই একত্রিত হই। কলকাতায় প্রায় এক হাজার ৩০০ জন দলীয় নেতা আছেন। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের লিভিং রুমে তো আর সবার একসাথে বসা সম্ভব নয়। কিন্তু এটাকে অফিস বললে অতিরঞ্জিত করা হবে।’
একটি উপন্যাস ও হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট
কলকাতার নিউ টাউন থেকে বহু দূরে, কানাডার রাজধানী অটোয়ার শান্ত এক এলাকায় নতুন জীবন শুরু করেছেন বাংলাদেশের সাবেক কূটনীতিক হারুন আল রশিদ। আওয়ামী লীগের সদস্য না হলেও তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের সমর্থক এবং ড. ইউনূসের প্রশাসনের কড়া সমালোচক হিসেবে দলের অনুগত মহলে জায়গা করে নিয়েছেন।
শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর, ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে যখন তিনি মরক্কোতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন, তখন তাকে ঢাকায় ফিরে আসার নির্দেশ দেয়া হয়। তিনি সেই নির্দেশ এড়িয়ে যান এবং পরে ফেসবুকে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে পোস্ট দেন।
দিনি বলেন, ‘আমি সেই পোস্টের শিরোনাম দিয়েছিলাম, এ প্লি ফর বাংলাদেশ- অ্যান্ড ফর মাইসেলফ। এরপরই অন্তর্বর্তী সরকার আমার ও আমার পরিবারের পাসপোর্ট বাতিল করে।’
অটোয়ায় তিনি এখন লেখালেখিতেই সময় কাটান। তিনি বলেন, ’আমি যতটা পড়তে চাই, ততটা পড়া হয় না। তবে ঘরে কোথাও না কোথাও একটা বই খোলা থাকে- সকালের চায়ের সাথে পাঁচ পৃষ্ঠা, রাতে শোয়ার আগে একটা অধ্যায়।’
তিনি জানান, এখন তিনি স্বনির্ভর। যা কখনো কখনো অস্বস্তির কারণও হয়। তিনি এখন সীমিত খরচ করেন এবং বাড়ি থেকে বেশিদূরে যেতে হয়, এমন যেকোনো কাজ এড়িয়ে চলেন।
গত এক বছর ধরে তিনি অনলাইনে সক্রিয় রয়েছেন। তার প্রোফাইলে ভরে আছে বাংলাদেশের নতুন রাজনৈতিক গতিপথ নিয়ে মতামত। ড. ইউনূসকে নিয়ে তার সমালোচনার মাঝে, রশিদের দিন তখনই সার্থক হয় যখন তিনি তার ডেস্কে বসে একটি ঝরঝরে অনুচ্ছেদ লিখতে পারেন। এই চেষ্টার ফলেই তৈরি হয়েছে তার প্রথম উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি—বাংলাদেশ নিয়ে এক ডিস্টোপিয়ান কাহিনি।
এদিকে নিউ টাউনে অবস্থানরত ঢাকার এক তরুণ আওয়ামী লীগ এমপি সাম্প্রতিক সময়ে কিছুটা হাসির খোরাক খুঁজে পেয়েছেন। গত ডিসেম্বর থেকে নিউ টাউনের একটি দুই বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্টে তিনি একাই থাকছেন। অবসর সময়ে নিজের পুরোনো সমস্যার সমাধান করে নিয়েছেন- চুল প্রতিস্থাপন।
তিনি বলেন, ‘ঢাকা থেকে পালিয়ে আসার সময় আমার হেয়ারলাইন অনেকটাই পেছনের দিকে চলে গিয়েছিল। আমার স্ত্রী কয়েক বছর ধরে আমাকে হেয়ার ট্রান্সপ্লান্টের জন্য বলছিল। কিন্তু প্রথমবারের মতো এমপি হওয়ার কারণে আমি আমার নির্বাচনী এলাকায় এতটাই ব্যস্ত ছিলাম যে কখনো সময় বের করতে পারিনি।’
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে তিনি দিল্লিতে যান এবং দক্ষিণ দিল্লির একটি হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট সেন্টার থেকে নতুন চুল প্রতিস্থাপন করেন। তিনি বলেন, ‘এমন কঠিন সময়ে মাথায় নতুন চুল গজানোও একধরনের আনন্দ।’