বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দ্বন্দ্বে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে দাবি করেছেন দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত বৃটেনের সাবেক ট্রেজারি মন্ত্রী ও হ্যাম্পস্টেড-হাইগেট আসনের লেবার এমপি টিউলিপ সিদ্দিক।
রোববার (১০ আগস্ট) ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করেন তিনি।
টিউলিপ সিদ্দীক বলেন, সত্যি কথা হলো, ড. ইউনূস ও আমার খালার মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে আমি এমন ক্ষতির মধ্যে পড়েছি। এখন আমাকে একাই বৃহত্তর শক্তির বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে। আমি স্বীকার করছি যে বাংলাদেশের অনেকেই অপরাধ করেছে। তাদের শাস্তিও হওয়া উচিৎ। তবে আমি তো অপরাধী নই।
টিউলিপের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তিনি স্বীয় খালা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রভাবের উপর ভর করে রাজধানীর পূর্বাচলে নিজের মা, ভাই ও বোনের জন্য একটি প্লট বরাদ্দ নিয়েছেন। তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তিনি। তিনি বলেন, এটি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক দাবি।
টিউলিপ জানান, গত সপ্তাহে তিনি জানতে পেরেছেন যে বাংলাদেশে তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছে। আগামী ১১ আগস্ট তিনিসহ আরো ২০ জনের বিচারের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত তিনি আনুষ্ঠানিক সমন পাননি। তিনি বলেন, আমি ব্রিটিশ আইনজীবী হুগো কিথ কেসির পরামর্শ নিচ্ছি। তবে ব্যক্তিগতভাবে বা ভিডিও কনফারেন্সে হাজির হবেন কিনা- এ বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত নেননি।
টিউলিপ অভিযোগ করেন, আমার বিদেশে শোকজ ট্রায়ালের কয়েক দিন মাত্র বাকি। অথচ আমার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ আছে তা এখনো আমি জানতে পারিনি। আমার মনে হচ্ছে, আমি যেন এক ধরনের ‘কাফকায়েস্ক দুঃস্বপ্নে’ আছি, যেখানে আমাকে বিদেশে বিচারের মুখোমুখি করা হচ্ছে। অথচ আমি এখনো জানি না অভিযোগগুলো আসলে কী; এর বিচারই বা কী হবে।
বাংলাদেশী কর্তৃপক্ষ বলছে, ‘প্রয়োজনে তারা টিউলিপের অনুপস্থিতিতেই বিচার করবে।’ তারা আরো বলছে, বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে প্রত্যর্পণ চুক্তি না থাকলেও অভিযোগ প্রমাণিত হলে বিয়ষটি বিবেচনা করা হতে পারে।’
গত বছর জুলাইয়ে লেবার পার্টি ক্ষমতায় আসে। এ সময় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে টিউলিপ অর্থনৈতিক সচিব ও সিটি মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান। তিনি আর্থিক খাত পর্যালোচনায় সক্রিয়ভাবে কাজ করছিলেন। তবে এ সময় ক্ষমতার পালাবদল হয় পাঁচ হাজার মাইল দূরের বাংলাদেশে। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ভেঙে পড়ে টিউলিপের খালা শেখ হাসিনার শাসন। হাজার হাজার মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঢেলে দিয়ে স্বপরিবারে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেন তিনি।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হন টিউলিপের নানা ও বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান। এ সময় প্রায় তার পুরো পরিবারকেই হত্যা করা হয়। ওই ট্র্যাজেডি মাথায় রেখেই তিনি বলেন, আমি এখানে আমার খালাকে রক্ষা করতে আসিনি। আমিও চাই বাংলাদেশের জনগণ তাদের কাঙ্ক্ষিত ন্যায়-বিচার পাক।
টিউলিপ বলেন, গত বছরের শেষে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ও শেখ হাসিনার সবচেয়ে তিক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এরপর থেকেই তার জীবনে দুর্ভোগ নেমে আসতে শুরু করে। তার দাবি, বাংলাদেশের এই ‘নোংরা রাজনীতি’ই তার জীবন পাল্টে দেয়।
তিনি বলেন, অচেনা কিছু ওয়েবসাইটে খবর ছাপা হয় যে তিনি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার আত্মসাত করেছেন। ২০১৩ সালে মস্কোতে তার খালা ও ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে হাসিমুখে তার একটি ছবিকে এর সাথে জড়িয়ে দেয়া হয়। এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, আমার খালা রাশিয়ায় রাষ্ট্রীয় সফরে গিয়েছিলেন। আমি ও আমার বোন লন্ডন থেকে সেখানে তাকে দেখতে গিয়েছিলাম। আমি সেখানে কোনো রাজনৈতিক আলোচনায় অংশ নেইনি। আমরা সেখানে বেড়াচ্ছিলাম। পরে শেষ দিনেএকটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠান হয়। সেখানে আমরা পুতিনের সাথে দুই মিনিটের জন্য সাক্ষাৎ করেছিলাম। এই ছবিটি মূলত ওই অনুষ্ঠানের ছবি।
টিউলিপের বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ হলো, ২০০৪ সালে কিংস ক্রস নামক এলাকায় তাকে একটি ফ্ল্যাট উপহার দিয়েছিলেন তার খালার রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের এক ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ওই ব্যবসায়ী দলের সক্রিয় কোনো নেতা নন। এমনকি তিনি কখনো আওয়ামী লীগকে ভোটও দেননি। তবে এখানে বিপত্তি দেখা দিয়েছে, দুই বছর আগে একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেলেন, ‘এটি তার বাবা-মা কিনেছেন।’ এটি মূলত তার বাবা-মার স্মৃতি বিভ্রাটের ফলে হয়েছিল। তারা বলেছিলেন, এটি তারা কিনেছেন। বাস্তবে এটি কেনা হয়নি।
প্রশ্ন ওঠে তার আবাসন নিয়েও। তার ক্রিকলউডে নিজের বাড়ি ছিল। তা সত্ত্বেও তিনি কেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ডেভেলপারের বাড়িতে থাকছিলেন। এ বিষয়ে টিউলিপ বলেন, নিরাপত্তা হুমকির কারণে তাকে বাড়ি বদলাতে হয়েছে। সেজন্য তিনি পরিচিত ওই ব্যক্তির বাড়িতে ভাড়ায় ছিলেন।
তিনি আরো জানান, এই অভিযোগ ওঠার পরই তিনি মন্ত্রীদের নৈতিক মানদণ্ডবিষয়ক স্বাধীন উপদেষ্টা স্যার লরি ম্যাগনাসের কাছে নিজেকে উপস্থাপন করেন। দুই সপ্তাহের গভীর তদন্ত শেষে ম্যাগনাস তাকে কোড লঙ্ঘনের অভিযোগ থেকে মুক্ত করেন। তবে ম্যাগনাস বলেন, পারিবারিক সম্পর্কের কারণে সৃষ্ট সুনামের ঝুঁকি সম্পর্কে আরও সচেতন না থাকা দুর্ভাগ্যজনক। টিউলিপ এ বিষয়ে বলেন- আমি জন্মসূত্রে কার ভাগনি, সেটা তো আমার হাতে নেই।
স্টারমারের সমর্থন থাকা সত্ত্বেও সরকারে বিভ্রান্তি তৈরি না করার জন্য টিউলিপ পদত্যাগ করেন। স্টারমার তাকে ভবিষ্যতে ফেরার ইঙ্গিতও দেন।
বাংলাদেশে প্রতিশ্রুত নির্বাচন এখনো হয়নি। ডোটি চেম্বার্সের আইনজীবীরা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে জমা দেওয়ার জন্য সহিংসতার প্রমাণ সংগ্রহ করছেন, যার মধ্যে সাংবাদিক, পুলিশ, সংখ্যালঘু ও সাবেক আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের ওপর হামলার অভিযোগ রয়েছে।
সিদ্দিক জানান, তিনি যুক্তরাজ্যে সফরকালে মুহাম্মদ ইউনুসের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা তা প্রত্যাখ্যান করেন। এদিকে, যুক্তরাজ্যের অপরাধ দমন সংস্থা শেখ হাসিনা-সংশ্লিষ্ট দুই ব্যক্তির প্রায় ৯ কোটি পাউন্ড মূল্যের সম্পত্তি জব্দ করেছে, যার একটিতে মা বসবাস করতেন। টিউলিপ বলেন, এর সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই।
সূত্র : গার্ডিয়ান