বিএনপি-জামায়াতের রাজনৈতিক সম্প্রীতি

রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার দৌঁড়ে বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীরা যখন পরস্পর কাঁদা ছোঁড়াছুঁড়ি ও মারমুখী অবস্থানে ঠিক তখন একটি দৃশ্য নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

অনলাইন প্রতিবেদক
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও অধ্যাপক মুজিবুর রহমান একে অপরকে কেক খাইয়ে দিচ্ছেন
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও অধ্যাপক মুজিবুর রহমান একে অপরকে কেক খাইয়ে দিচ্ছেন |নয়া দিগন্ত

বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপি ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সম্পর্ক দুই যুগেরও বেশি পুরনো। একসময় তারা ছিল জোটের শরিক, একে অপরের আন্দোলনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। কিন্তু ৫ আগস্টের পর থেকে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও কৌশলগত অবস্থানের পরিবর্তনে উভয় পক্ষই নিজেদের অবস্থান স্পষ্টভাবে আলাদা রেখেছে।

রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার দৌঁড়ে বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীরা যখন পরস্পর কাঁদা ছোঁড়াছুঁড়ি ও মারমুখী অবস্থানে ঠিক তখন একটি দৃশ্য নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

শনিবার (২৫ অক্টোবর) নয়া দিগন্তের ২১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে এ দৃশ্য ধরা পড়ে। ছবিতে দেখা যায়—বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান একে অপরকে কেক খাইয়ে দিচ্ছেন। এসময় দুই নেতার হাস্যোজ্জ্বল মুখ, পারস্পরিক সৌজন্য ও আনন্দময় পরিবেশ যেন রাজনীতির প্রচলিত দূরত্বকে মুহূর্তেই ভুলিয়ে দেয়। বিভেদের বেড়াজাল ছিন্ন করে রাজনৈতিক সম্প্রতির বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ঘোষণা করে এবং নেতা-কর্মী ও সমালোচকদের উদ্দেশে আঙুল তুলে দেখিয়ে দেয়— বন্ধন অটুট রাখার কৌশল।

২৫ বছরের সম্পর্ক: ঐতিহ্য, টানাপোড়েন ও পরিবর্তন

চারদলীয় ঐক্যজোট একটি রাজনৈতিক জোট ছিল যা ১৯৯৯ সালে গঠিত হয়েছিল এবং এতে প্রধানত বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টি (নাজিউর) এবং ইসলামী ঐক্যজোট অন্তর্ভুক্ত ছিল। চারদলীয় জোট গঠনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় বিএনপি-জামায়াতের আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক অংশীদারিত্ব। ২০০১ সালের নির্বাচনে সেই জোট ক্ষমতায় আসে, পরবর্তী বছরগুলোতে আন্দোলন-সংগ্রামে থেকেছে পাশাপাশি। ২০০৮ সালের পর সময়ের পরিক্রমায় আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ চাপ উপেক্ষা করেও চলে এই সম্পর্ক।

জুলাই আন্দোলনে ৫ আগস্টের পর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দুই দলই নিজেদের পথ বেছে নিয়েছে স্বতন্ত্রভাবে। জামায়াত নিজস্ব রাজনৈতিক সংগঠন শক্তিশালী করতে মনোযোগী হয়েছে।

'বার্তা দেয় ছবিটি'

শনিবারের নয়া দিগন্তের ২১ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে কেক খাওয়ানোর মুহূর্ত অনেককেই চমকে দিয়েছে। কেউ বলছেন, এটি নিছক সৌজন্য; আবার কেউ দেখছেন ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পুনরায় ঘনিষ্ঠতার ইঙ্গিত। বক্তব্যে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘গণতন্ত্রকামী শক্তিগুলোর ওপর ফ্যাসিবাদী সরকারের দমন-পীড়নের কথা জাতি ভুলে যায়নি। ৬০ লাখ কর্মীর নামে মিথ্যা মামলা, ২০ হাজারের বেশি নেতাকর্মী হত্যাকাণ্ড ও গুমের শিকার হয়েছেন। জামায়াতে ইসলামীর আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, কামরুজ্জামান , নয়া দিগন্তের মালিক মীর কাসেম আলী, সালাউদ্দিন কাদেরসহ অনেক আলেম ওলামাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে মিথ্যা মামলায়। এসব এই জাতির ইতিহাসে কলঙ্কজনক অধ্যায়।’

গেলো ২০ অক্টোবর নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার নাটেশ্বর ইউনিয়নে বিএনপির ৩১ দফার লিফলেট বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নাল আবদিন ফারুক বলেন, ‘বিএনপি-জামায়াত ভাই ভাই, এ মাটিতে যেন আর ভাইয়ে-ভাইয়ে রক্ত না ঝরে।’

এ সময় জামায়াতকে উদ্দেশ্য করে বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘আপনারা ক্ষমতায় গেলে পিআর ঠিক করে নেবেন। জুলাই সনদে যখন দস্তখত করে ফেলেছেন, আসুন মিলেমিশে ইউনুস সাহেবকে সহযোগিতা করি

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন “বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতীক অনেক বড় কথা বলে। মির্জা ফখরুলের এই আচরণ কেবল বন্ধুত্ব নয়—এটি একটি রাজনৈতিক সিগন্যালও বটে। হয়তো আগামী দিনে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে পুরনো ঐক্যের ছায়া ফের দেখা যেতে পারে।”

ছবিটি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর নানামুখী প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। বিএনপিপন্থী অনেকে একে “মানবিক সৌহার্দ্য” হিসেবে বর্ণনা করেছেন, অন্যদিকে কিছু বিশ্লেষক বলছেন—এটি হতে পারে “রাজনীতিতে বরফ গলার সূচনা”।

এখন টিভির সিনিয়র রিপোর্টার মুজাহিদ শুভ তার নিজের ফেরিফাই ফেসবুক পেজে মির্জা ফখরুলের কেক খাওয়ানোর ছবিপোস্ট দিয়ে লেখেছেন, "রাজনীতির কোটি রঙের একটি!"

জাতীয় নাগরিক পার্টির ( এনসিপি) যুগ্ম সদস্য সচিব জয়নাল আবেদীন শিশির বলেন, “রাজনীতিতে সৌজন্য ও পারস্পরিক সম্মান হারিয়ে যাচ্ছে—এই ( কেক খাওয়ানো) দৃশ্য ইতিবাচক। রাজনীতিতে মতপার্থক্য থাকবেই, রাজনীতিদিদের মধ্যে এমন সৌহার্দ্যপূর্ণ দৃশ্য শুধু বিএনপি বা জামায়াত নয়, সমগ্র রাজনীতির জন্যই ইতিবাচক।

মতের ভিন্নতা থাকতেই পারে, কিন্তু পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা বজায় রাখাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য।”