ক্ষমতায় গেলে গুমের সংস্কৃতি নিশ্চিহ্ন করার অঙ্গীকার সালাহউদ্দিনের

আজ রাষ্ট্রকাঠামোর সংস্কারের জন্য আমরা সব রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধ হয়েছি, যা আগে কখনো কল্পনাও করা যেত না।

নয়া দিগন্ত অনলাইন
বক্তব্য রাখছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ
বক্তব্য রাখছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ |সংগৃহীত

আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে দেশ থেকে গুমের সংস্কৃতি পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করার অঙ্গীকার করেছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ।

‘একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আপনাদের এই কথা বলতে পারি, যদি জনগণ আমাদের ম্যান্ডেট দেয়, গুম প্রতিরোধের জন্য, গুমের সংস্কৃতি নিশ্চিহ্ন করার জন্য প্রথমে যা যা করতে হয়- আইন প্রণয়ন ও তা কার্যকর, সবকিছু করা হবে। আমরা সেই বাংলাদেশের জন্য অপেক্ষা করছি, যেখানে কোনো ব্যক্তি গুমের শিকার হবে না,’ বলেন তিনি।

শুক্রবার (২৯ আগস্ট) বিকেলে বাংলা একাডেমি মিলনায়তনে আন্তর্জাতিক গুম দিবস উপলক্ষে গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্মরণে ‘মায়ের ডাক’ আয়োজিত আলোচনা সভায় তিনি এমন প্রত্যয়ের কথা জানান।

বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘দীর্ঘ সময় একটা বিভীষিকাময় পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ চলেছে। সেই ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রামে আমাদের সন্তানদের রক্ত দিতে হয়েছে। যারা বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটিকে করদরাজ্যে পরিণত করতে আজীবন ক্ষমতায় থাকার জন্য এই হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে, তাদের এখনো অনুশোচনা নেই। তারা নিজেদের অপরাধ স্বীকার তো দূরের কথা, উল্টো অভ্যুত্থানকারীদের অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করছে।’

তিনি বলেন, ‘এরপরও বাংলাদেশের মানুষ কি কখনো তাদের রাজনীতিতে আহ্বান করতে পারবে? বাংলাদেশের মানুষ কি কখনো তাদের ক্ষমা করতে পারবে? ক্ষমা তারা চায়নি। আমরা এমন একটি পরিস্থিতিতে গণতান্ত্রিক উত্তরণের জন্য অপেক্ষা করছি। আজ রাষ্ট্রকাঠামোর সংস্কারের জন্য আমরা সব রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধ হয়েছি, যা আগে কখনো কল্পনাও করা যেত না।’

নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে তিনি বলেন, ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেয়া রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্যে ফাটল ধরানোর একটা চেষ্টা কোনো একটা পক্ষ করছে। কিন্তু আমরা তর্ক-বিতর্ক করছি, সংস্কারের বিপক্ষে আলোচনা করছি, নির্বাচন নিয়ে দুয়েকটা পক্ষ ধোঁয়াশা সৃষ্টি করছে। আমি আহ্বান জানাব, ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য দেশের মানুষ ১৬ বছর সংগ্রাম করেছেন, রক্ত দিয়েছেন, সেই ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যখন একটি রাস্তা তৈরি হয়েছে, তাতে যাতে আমরা কাঁটা না বিছাই। সবার প্রতি এই আহ্বান জানাই।’

গুমের শিকার হয়ে আর ফিরে না আসা মানুষদের ছবির দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘আমার সৌভাগ্য যে- আমি আজ জীবিত আছি, আপনাদের সাথে কথা বলছি। নাহলে আমারও ছবি হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। আমার সহকর্মীদের অনেকের ফিরে আসার সৌভাগ্য হয়নি। তাদের খোঁজ মিলছে না। কেন যে আয়নাঘর নামটা দেওয়া হলো? কিন্তু আয়নাঘরে তো আয়না ছিল না, ছিল জমদূত, ছিল মৃত্যুর পরোয়ানা। সেই আয়নাঘরে আমরা ছিলাম।’

বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘আমাকে একটা গুপ্তগুহায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তখন যদি আমার চোখ বন্ধ না থাকত, তাহলে হয়তো আমার বিশ্বাস হতো না যে এখানে মানুষ থাকতে পারে। তবে রুমের ভেতরে চোখ খোলা থাকত। একদিনই কেবল চোখ খোলা রেখে বাইরে নেয়া হয়েছিল। আমার তারিখ গণনায় সেদিন ২০১৫ সালের ১৪ এপ্রিল, বাংলা নববর্ষ উদযাপনের দিন। তাদের মধ্যে কয়েকজন অফিসার সম্ভবত ছিল সেই অনুষ্ঠানে, আমাকে বলল যে- আজ ম্যাডাম পার্টি অফিসের সামনে অনুষ্ঠান করেছে, পহেলা বৈশাখের। আমাকে নিউজ দিতে চাইল যে দেশে এখন স্বাভাবিক পরিস্থিতি চলছে।’

‘আমি কোনো জবাব দিতাম না। সেদিনই চোখ খোলা রেখে রুমের বাইরে কিছুক্ষণ বসিয়ে রেখেছিল। কারণ রুমটা পরিষ্কার করতে হবে। রুমটা ছিল ময়লা আর দুর্গন্ধে ভরা, বাতাস চলাচলের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। পাঁচ ফুট বাই দশ ফুট বা তার চেয়ে ছোট হতে পারে রুমটা। দুই মাস এক দিন অর্থাৎ ৬১ দিনের মাথায় আমাকে বের করে যমটুপি ও কালো চশমা পরিয়ে গামছা দিয়ে হাত বেঁধে বলা হলো- আজ আপনাকে এমন একটি জায়গায় নিয়ে যাওয়া হবে, ফিরে আসতে আপনার দু-তিন দিন লাগতে পারে। তবে আমাকে জীবিত ছেড়ে দেবে, সেটা আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না,’ বলেন বিএনপির এই নেতা।

তিনি বলেন, ‘তাদের বলতাম, যদি আমার মৃত্যু এখানে হয়, তাহলে আমার লাশটা আমার পরিবারের কাছে ফেরত দিও। তারা কোনো জবাব দিত না। আল্লাহর কাছে সবসময় প্রার্থনা করতাম, যদি আমার হায়াত থাকে, আমাকে ঈমানের সাথে জীবন দিও, ঈমানের সাথে মৃত্যু দিও। আর যদি এখানেই আমার মৃত্যু হয়, তাহলে আমাকে ঈমানের মৃত্যু দিও। দেশ ও দেশের মানুষের জন্য প্রার্থনা করতাম।’

‘আমি খুব বিশ্বাসী মানুষ, আমি অনেক কিছু দেখেছি। সে জন্য অনেক অবিশ্বাসী মানুষকে বলি- আমি শুধু আল্লাহর অস্তিত্ব চোখ দিয়ে দেখিনি, কিন্তু আমি অনুভব করেছি, আমি অনেক কিছু জেনেছি। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাকে অনেক কিছু দেখিয়েছেন। সেগুলো আমি বাস্তব জীবনে পেয়েছি। এটা হয়তো যারা বিশ্বাস করতে চাইবেন, তারাই বিশ্বাস করতে পারবেন। এটা অনুধাবনের বিষয়।’

বিএনপির এই নেতা আরো বলেন, আজকের এই অনুষ্ঠানে গুম হওয়া পরিবারের মধ্যে নতুন কেউ যোগ হয়নি, এটা সুসংবাদ। তারা আশা প্রকাশ করেছেন, আগামী দিনের রাজনীতিবিদরা যাতে নিশ্চিত করেন আগামী দিনে যেন গুম হওয়া পরিবারের সদস্যদের এমন কোনো অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে না হয়। আসলে সে জন্যই আমরা এখানে অনবরত সংগ্রাম করে যাচ্ছি।