যে কারণে বিভিন্ন দূতাবাস থেকে সরানো হয়েছে রাষ্ট্রপতির ছবি

বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশী দূতাবাস ও কনস্যুলেট অফিস থেকে রাষ্ট্রপতি মো: সাহাবুদ্দিনের ছবি সরানোর নির্দেশনা দিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

নয়া দিগন্ত অনলাইন
রাষ্ট্রপতি মো: সাহাবুদ্দিনের ছবি
রাষ্ট্রপতি মো: সাহাবুদ্দিনের ছবি |সংগৃহীত

বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশী দূতাবাস ও কনস্যুলেট অফিস থেকে রাষ্ট্রপতি মো: সাহাবুদ্দিনের ছবি সরানোর নির্দেশনা দিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ওই নির্দেশনা পাওয়ার পর এরই মধ্যে কয়েকটি দেশের বাংলাদেশী দূতাবাস থেকে রাষ্ট্রপতির ছবি সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

তবে, কেন বা কী কারণে রাষ্ট্রপতির ছবি সরানোর এই নির্দেশনা, তা নিয়ে স্পষ্ট করে কেউ কিছু বলতে পারেনি।

বেশ কয়েকটি দেশের বাংলাদেশী দূতাবাসে কথা বলেছে বিবিসি বাংলা। সেগুলোর মধ্যে কোনো কোনো দূতাবাস সরকারের মৌখিক নির্দেশনা পেয়েছে, কোনো কোনোটি সেই নির্দেশনা পায়নি।

এমন নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল লন্ডনে বাংলাদেশে হাইকমিশনেও। লন্ডন হাইকমিশন সূত্র বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছে, মন্ত্রণালয়ের এই নির্দেশনা পাওয়ার পর লন্ডন হাই কমিশনে থাকা রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনের ছবি শুক্রবার রাতেই সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

ইউরোপ মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার অন্তত পাঁচটি দূতাবাস কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সরকারের মৌখিক নির্দেশনা পেয়ে দূতাবাস থেকে রাষ্ট্রপতির ছবি সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

তবে এ নিয়ে আনুষ্ঠানিক মন্তব্য জানতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘বিগত সরকারের সময়ে আইন অনুযায়ী শুধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি ব্যবহারের নিয়ম ছিল। রাষ্ট্রপতির ছবি রাখার কোনো আইন ছিল না। তারপরও যদি কোনো অফিসে সেটা ব্যবহার করে থাকে এই সরকারের সময়, তাহলে সরকারের উচিত ছিল লুকোচুরি না করে লিখিতভাবে নির্দেশনা জারি করা’।

শনিবার মধ্য রাত থেকে বিভিন্ন গণমাধ্যমে এই খবর ছড়িয়ে পড়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক ধরনের গুঞ্জন তৈরি হয় যে- রাষ্ট্রপতিকেও কী তার পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে কি না?

নানা আলোচনার মধ্যে রোববার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, বিদেশী মিশন থেকে রাষ্ট্রপতির ছবি সরানোর ঘটনায় ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানে কোনো প্রভাব ফেলবে না।

শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের দাবিতে বিভিন্ন ব্যানারে বিক্ষোভ হলেও সাংবিধানিক সঙ্কটের আশঙ্কা থেকে অধ্যাপক ইউনূসের সরকার সে পথে হাঁটেনি।

'নির্দেশ দেয়া হয়েছিল মৌখিকভাবে'

রোববার শ্রীলঙ্কার কলম্বো দূতাবাসের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিবিসি বাংলাকে বলেন, তাদের দূতাবাসে ৫ আগস্টের পরই রাষ্ট্রপতি মো: সাহাবুদ্দিন, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি সরিয়ে ফেলেন।

ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘গতকাল (শনিবার) আবার মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের কাছে মৌখিকভাবে নির্দেশনা এসেছে রাষ্ট্রপতির ছবি সরিয়ে ফেলার। কিন্তু আমাদের এখানে আগে থেকেই ছবি ছিল না। যে কারণে কলম্বো দূতাবাস থেকে নতুন করে ছবি সরাতে হয়নি’।

ওই কর্মকর্তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল ঠিক এই নির্দেশনা কিভাবে পেয়েছেন তারা? জবাবে ওই কর্মকর্তা শুধু এতটুকুই বলেছেন যে- ‘হেডকোয়ার্টার (ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়) শুধু বলেছে, তোমাদের দূতাবাসসহ অন্য যদি কোনো দূতাবাসে রাষ্ট্রপতির ছবি থাকে সেটি সরিয়ে ফেলো’।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার সময় কলম্বো দূতাবাসে রাষ্ট্রপতির ছবি না থাকলেও এমন একটি ছবি ছিল লন্ডনে বাংলাদেশী হাই-কমিশনে।

সেখানে বাংলাদেশী হাইকমিশনারের রুমে শুধু রাষ্ট্রপতি মো: সাহাবুদ্দিনের ছবিটি ছিল বলে দূতাবাস সূত্র নিশ্চিত করে।

শুক্রবার রাতেই ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনে ফোন করে রাষ্ট্রপতির ছবি সরানোর নির্দেশনা দেয়া হলে ওই রাতেই ছবি সরিয়ে ফেলা হয়।

এ নিয়ে রোববার কথা হয় ইরানের বাংলাদেশী দূতাবাস কার্যালয়ে। এই দূতাবাস সূত্র জানিয়েছে, ৫ আগস্টের পর তারা শেখ হাসিনা ও শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি সরিয়ে ফেলেছিলেন।

অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেয়ার পর তেহরানের বাংলাদেশ দূতাবাসে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার দুটি ছবি বাঁধাই করে রাষ্ট্রদূতের অফিস কক্ষে টানানো হয়েছিল।

সেখানকার একজন কর্মকর্তা নাম গোপন রেখে বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘আমি আজকে অফিসে এসে দেখি সেখান থেকে দুইটি ছবিই সরিয়ে ফেলা হয়েছে। আজকে সেখানে কোনো ছবি নাই’।

তেহরান দূতাবাসের ওই কর্মকর্তা জানান, সরকারের এই নির্দেশনার পরই রাষ্ট্রপতির ছবিসহ দুইটা ছবিই সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

অন্তত আরো দুটি দূতাবাস অফিস জানিয়েছে যে- তারা কোনো ধরনের মৌখিক নির্দেশনাও পাননি। যদিও ওই দূতাবাসগুলোতে রাষ্ট্রপতির ছবি আগে থেকে ছিল না বলেও জানান তারা।

হঠাৎই নির্দেশনার কারণ কী?

গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বিভিন্ন জায়গায় সরকারি দফতর বা আদালত থেকে শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি অপসারণ করা হয়।

কোথাও কোথাও দূতাবাস কর্মকর্তারা নিজ উদ্যোগেই শেখ মুজিবুর রহমান, শেখ হাসিনা ও রাষ্ট্রপতি মো: সাহাবুদ্দিনের ছবি সরিয়ে ফেলেন।

কোথাও আবার দূতাবাস অফিসে প্রবাসী বাংলাদেশীদের কেউ কেউ হামলা চালিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবিও অপসারণ করেন।

৫ আগস্টেই যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে বাংলাদেশী দূতাবাসে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি সরিয়ে ফেলা হয়। বিভিন্ন গণমাধ্যমে সেই খবরও প্রকাশিত হয়।

গত ১১ আগস্ট রাষ্ট্রীয় সফরে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় যান পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্রের দাবি, পরিবেশ উপদেষ্টা জেনেভায় বাংলাদেশী দূতাবাসে গিয়ে সেখানে রাষ্ট্রপতি মো: সাহাবুদ্দিনের ছবি টানানো দেখতে পান। পরবর্তীতে তিনি বিষয়টি নিয়ে উষ্মাও প্রকাশ করেন। সেখানেই তিনি জানান যে- তিনি বিষয়টি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানাবেন।

সুইজারল্যান্ড সফর শেষে শনিবার দেশে ফিরেছেন পরিবেশ উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান।

তবে রিজওয়ানা হাসান বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, জেনেভা দূতাবাসে তিনি রাষ্ট্রপতির কোনো ছবি দেখেননি, কিংবা এ নিয়ে তার সাথে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো কথাও হয়নি।

সাবেক কূটনীতিকেরা বলছেন, রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে সরকারি আদেশে রাষ্ট্রপতির ছবি ব্যবহার করা হতো। সেই হিসেবে আনুষ্ঠানিক কোনো নির্দেশনা না পাওয়ায় এতদিন কোনো কোনো দূতাবাসে রাষ্ট্রপতির ছবি ছিল।

সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ূন কবির বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘কার ছবি কোথায় টানাতে হবে সেই নির্দেশ কেবিনেট থেকে এটি ইস্যু করা হয়। সেরকম নির্দেশনার ভিত্তিতেই হয়তো ছবি সরানো হয়েছে। সরকার যেকোনো সময় যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতেই পারে’।

মৌখিকভাবে হঠাৎ এই নির্দেশনা কেন দেয়া হয়েছে, এ নিয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা, পররাষ্ট্র সচিব ও মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রের সাথে বিবিসি বাংলার পক্ষ থেকে যোগাযোগ চেষ্টা করেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

অফিস আদালতে ছবি ব্যবহারের নিয়ম কী?

রাষ্ট্রপতির ছবি টানানো নিয়ে আইনি বিধান কি আছে, সেটি নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠছে মো: সাহাবুদ্দিনের ছবি সরানো নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার পর।

বাংলাদেশের সংবিধানের চার অনুচ্ছেদে সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষের প্রধান ও শাখা কার্যালয়, সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাস ও মিশনসমূহে সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি ব্যবহারের আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

এর বাইরে সরকার প্রধানের ছবি ব্যবহার করা নিয়ে কোনো আইন, বিধি বা সাংবিধানিক নির্দেশনা শেখ হাসিনার শাসনামলে হয়নি।

তবে, ২০০২ সালে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক বিজ্ঞপ্তিতে মন্ত্রীদের কার্যালয়, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদফতর, বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাস ও সব স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়ে সরকারপ্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিকৃতি কিংবা ছবি টাঙানোর নির্দেশ দেয়া হয়।

ওই নির্দেশ মোতাবেক ওই সময়কার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও পরবর্তীতে শেখ হাসিনার ছবি ব্যবহার হয়ে আসছিল।

৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর অবশ্য সরকার প্রধান হিসেবে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এ ধরনের কোনো নির্দেশনা দেননি।

কিন্তু কোনো ধরনের নির্দেশনা না থাকার পরও রাষ্ট্রপতির ছবি বিভিন্ন দূতাবাস কার্যালয়ে কেন ব্যবহার করা হয়, তার একটা ব্যাখ্যা পাওয়া গেছে আইনজীবীদের কাছ থেকে।

সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরশেদ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, প্রত্যেকটা দেশে রাষ্ট্রদূত বা হাই-কমিশনার যারা থাকেন, সেখানে তাদের দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের ছবি থাকে, এটা একটা কাস্টম। এটা দীর্ঘদিন থেকে চলে আসছে এবং সেই হিসেবেই হয়তো রাষ্ট্রপতির ছবি ছিল’।

‘এখন এটাকে আইনি বা বেআইনি দু’টার কোনোটাই বলা যায় না। এখন সরকার যদি নির্দেশনা দেয় তাহলে নামিয়ে ফেলতে হবে’, যোগ করেন মোরশেদ।

সাবেক রাষ্ট্রদূত, সচিব ও আইনজীবীরা বলছেন, আইনি কোনো বাধ্যকতা না থাকার পরও যদি দূতাবাস ও বিদেশে বাংলাদেশী মিশনে রাষ্ট্রপতির ছবি থাকলে সেটি সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের আনুষ্ঠানিক ও লিখিত সিদ্ধান্তে সরিয়ে ফেলা যেতো।

সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘এই ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত যদি নিতেই হয় মৌখিকভাবে টেলিফোনে সিদ্ধান্ত না জানিয়ে উপদেষ্টা পরিষদ সিদ্ধান্ত নিয়ে নির্দেশনা জারি করা দরকার ছিল। কিন্তু সরকার সেটি করেনি’।

যে কারণে অনেকটা গোপনে ও মৌখিকভাবে এই নির্দেশনার বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশের পরই রাষ্ট্রপতির পদ নিয়েও নানা গুঞ্জন দেখা যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

সূত্র : বিবিসি