বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কবে দেশে ফিরবেন, এই প্রশ্ন বহু পুরনো। বিশেষ করে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এই প্রশ্ন বার বার উঠেছে। বিএনপির নেতারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কথা বলেছেন।
তবে সম্প্রতি বিবিসি বাংলার সাথে সাক্ষাৎকারে তারেক রহমান নিজেই জানান, খুব শিগিগির তিনি দেশে ফিরবেন এবং নির্বাচনেও অংশ নেবেন। এরপর তার ফেরার গুঞ্জনের আরো ডালপালা মেলেছে।
স্থানীয় গণমাধ্যম তো বটেই, এমনকি খোদ বিএনপিতেও এমন আলোচনা আছে যে আগামী নভেম্বরে তিনি দেশে ফিরতে পারেন।
তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে বড় আয়োজনেরও পরিকল্পনা আছে বিএনপিতে।
নেতা-কর্মীরা মনে করছেন, বিএনপির এই শীর্ষ নেতার প্রত্যাবর্তন এবং সরাসরি নেতৃত্ব আগামী নির্বাচনের মাঠে বিএনপিকে জয়ের দিকে এগিয়ে দেবে। শেষ মুহূর্তে তাকে ঘিরে একটা মোমেন্টাম তৈরি হবে। ফলে তারেক রহমানের ভাবমূর্তি নির্বাচনে ব্যবহার করতে চায় বিএনপি।
দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ‘যখন খালেদা জিয়া ছিলেন, তখন তার প্রভাবেই কিন্তু ভোট প্রভাবিত হয়েছে। এখন তারেক রহমান আসবেন, জনগণের মধ্যে স্বতস্ফূর্ততা আসবে। সুতরাং তারও একটা প্রভাব ভোটের ওপর পড়বে।’
তবে সবকিছু যে এমন সহজ নাও হতে পারে, সেই বিশ্লেষণও আছে রাজনীতিতে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সাব্বির আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, বিএনপি এবং তারেক রহমানকে নিয়ে ভোটারদের অতীত অভিজ্ঞতা আছে। ফলে এখানেও বিএনপির জন্য চ্যালেঞ্জ আছে।
তিনি বলেন, ‘মানুষ বিএনপির শাসনামলটাকে প্রত্যক্ষ করেছে। মানুষের কাছে কিন্তু মোটামুটি তারেক জিয়ার মেমোরিটা এখনো আছে।’
এছাড়া তারেক রহমান দেশে ফিরলে তাকে ঘিরে নেতা-কর্মীদের মধ্যে ‘বেপরোয়াভাব’ চলে আসতে পারে, এমন আশঙ্কাও করেন বিশ্লেষকদের কেউ কেউ। বিশেষ করে নির্বাচনের অতীত ইতিহাস বিবেচনায় বিএনপি জয়ী হতে যাচ্ছে, এমন ধারণা আছে অনেকের মধ্যে।
সেই ধারণা থেকেই ব্যবসায়ী, সিভিল সোসাইটি, প্রশাসনসহ বিভিন্ন খাতের নেতাদের মধ্যেও বিএনপির দিকে ঝুঁকে পড়ার সম্ভাবনা আছে।
তারেক রহমান সেটা কিভাবে সামলাবেন সেটাও দেখার বিষয়।
যদিও রাজনীতির এতসব জটিল আলোচনায় না গিয়ে বিএনপির তৃণমূল আছে তারেক রহমানের অপেক্ষায়।
‘নেতা-কর্মীদের একটাই জিজ্ঞাসা, তারেক রহমান কবে আসবেন?’
মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার ইছাপুর ইউনিয়ন বিএনপির কার্যালয়। গত সোমবার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, নেতা-কর্মীদের ভীড়।
অফিসের ভেতরে চলছে বৈঠক। কার্যালয়ের সামনে এবং ভেতরের দেয়ালে বড় করে টাঙানো বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ শীর্ষ নেতাদের ছবি।
দলীয় আলোচনাতেও তারেক রহমানের নির্দেশনাই পৌঁছানো হচ্ছে নেতা-কর্মীদের কাছে।
এছাড়া যেসব সম্ভাব্য প্রার্থী চেষ্টা করছেন নির্বাচনে দলের প্রার্থী হওয়ার, তাদের প্রচারণাতেও গুরুত্ব পাচ্ছে দলটির শীর্ষ নেতার ছবি।
সবমিলিয়ে দলের সকল কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু তারেক রহমান।
‘এখন আমাদের নেতা-কর্মীদের একটাই জিজ্ঞাসা, তারেক রহমান সাহেব কবে আসবেন’, বলেন সিরাজদিখান উপজেলা বিএনপির উপদেষ্টা আব্দুল কুদ্দুস ধীরন।
খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, সিরাজদিখানে বিএনপির কমপক্ষে পাঁচজন নেতা আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন প্রত্যাশী। প্রত্যেকেই চেষ্টা করছেন যার যার অবস্থান থেকে।
এলাকার সবখানে সম্ভাব্য প্রার্থীরা নিজেদের ব্যানার-ফেস্টুন লাগিয়েছেন।
আব্দুল কুদ্দুস ধীরন বলেন, ‘এই যে এতজন প্রার্থী। এর সমাধান করবেন তারেক রহমান। না হলে কেউ কারো কথা শুনবে না। আর উনি যখন দেশে আসবেন, সেইটা এমনিতেই নেতা-কর্মীদের আরো চাঙা করবে, দলের ভেতর সবার মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি করবে।
তিনি বলেন, ‘নেতা-কর্মীরা সরাসরি তার নেতৃত্বে কাজ করতে চায়। আমরাও চাই আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন থেকে সবকিছুই তিনি দায়িত্ব নিয়ে পরিচালনা করবেন।’
বিএনপির জন্য কেন গুরুত্বপূর্ণ?
তারেক রহমান দেশের বাইরে আছেন ১৭ বছরেরও বেশি সময় ধরে।
এরমধ্যে ২০১৮ সালে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে গেলে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন তারেক রহমান। বলা যায়, তখন থেকেই দলটির শীর্ষ নেতা হিসেবে দেশের বাইরে থেকেই বিএনপিকে পরিচালনা করতে থাকেন তিনি।
১৭ বছর পর নতুন পরিস্থিতিতে এখন তার দেশে ফেরার কথা নতুন করে আলোচনায় এসেছে।
চলতি মাসে বিবিসি বাংলাকে দেয়া তারেক রহমানের এক সাক্ষাৎকারে তিনি নিজেই শিগগির দেশে ফেরার কথা জানিয়েছেন। তবে দিনক্ষণ নির্দিষ্ট না হলেও খোদ বিএনপিতেই জোর গুঞ্জন আছে আগামী নভেম্বরেই তিনি ফিরতে পারেন।
নির্বাচনের আগে তার দেশে ফেরা নিয়ে দলটির ভেতরে কয়েক ধরনের মূল্যায়ন আছে।
১) তার প্রত্যাবর্তন দলটির জন্য নির্বাচনে জয়ের মোমেন্টাম তৈরি করবে।
২) একাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশী থাকায় আগামী নির্বাচনে দলের প্রার্থী হওয়া নিয়ে দলে যে বিভক্তি বা অনিশ্চয়তা আছে সেটা দূর হবে।
৩) তার সরাসরি উপস্থিতি নেতা-কর্মীদের চাঙা করবে।
৪) বিএনপি দেরিতে নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করায় আর জামায়াতে ইসলামী আগেভাগে শুরু করায় বিএনপির যে প্রস্তুতির ঘাটতি আছে, সেটা কাটিয়ে ওঠা যাবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, খালেদা জিয়ার মতো তারেক রহমানের উপস্থিতিও নির্বাচনে একটা প্রভাব রাখবে।
তিনি বলেন, ‘তারেক রহমান যখন বিভাগীয় শহর এবং জেলা শহরগুলোতে যাবেন, সেখানে সমাবেশ করবেন, তখন তো এটা বিরাট ইম্প্যাক্ট তৈরি করবে। যেটা নির্বাচনের জন্য সহায়ক হয়ে দাঁড়াবে। যখন খালেদা জিয়া রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন, তখন তার প্রভাবেই কিন্তু ভোট প্রভাবিত হয়েছে। এখন তারেক রহমান আসবেন, জনগণের মধ্যে স্বতস্ফূর্ততা আসবে। সুতরাং তারও একটা প্রভাব ভোটের ওপর পড়বে। সেই ভোট দিয়ে প্রার্থীকে বের করে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে আমার মনে হয় অনেক প্রভাব থাকবে।’
ফলে তারেক রহমানের দিকে যেমন দল তাকিয়ে আছে, তেমনই তার ফেরার দিনে বড় আয়োজনের পরিকল্পনাও আছে।
ইকবাল হাসান মাহমুদ বলেন, ‘সেদিন কত মানুষের জমায়েত হবে বলা কঠিন। তাকে এয়ারপোর্ট থেকে বাড়িতে নেয়া পর্যন্ত যে সিকিউরিটি দেয়া প্রয়োজন, সেটাও আমাদের ভাবায়। সবমিলিয়ে এটা একটা বড় ঘটনা আমাদের দল এবং দেশের জন্য।’
তারেক রহমানের ফেরা এবং ‘হাওয়া ভবনের মেমোরি’
তারেক রহমান দেশে ফিরলে যে নির্বাচনের মোমেন্টাম বিএনপির দিকে ঘুরে যাবে, তেমনটা আবার নাও হতে পারে বলে মনে করেন বিশ্লেষকদের কেউ কেউ।
এর বড় কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশের নির্বাচন রাষ্ট্রপতিকেন্দ্রিক নয় বরং সংসদীয় পদ্ধতির। যেখানে তিনশত আসনে তিনশত প্রার্থী থাকে।
ফলে নির্বাচন আসনভিত্তিক প্রার্থীর ব্যক্তিগত ইমেজ এবং যোগ্যতাও প্রভাব ফেলে। এছাড়া স্থানীয় রাজনীতির নানা হিসাবও থাকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজনীতি বিশ্লেষক সাব্বির আহমেদ বলেন, ‘একজন নেতা তো আর একাই তিন শ’ আসনকে রিপ্রেজেন্ট করতে পারবেন না। তবে হ্যাঁ, উনি যদি উনার ইমেজ কেন্দ্রীয়ভাবে তৈরি করতে পারেন, যেটা সাধারণ মানুষ যদি তাকে রিড করতে পারে যে হি ইজ আ গুড লিডার। তাহলে এটার একটা ইম্প্যাক্ট পড়বে।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপি এবং তারেক রহমানকে নিয়ে ভোটারদের অতীত অভিজ্ঞতা আছে। ফলে এটাও বিএনপির জন্য চ্যালেঞ্জ হতে পারে।
সাব্বির আহমেদ বলেন, ‘মানুষ বিএনপির শাসনামলটাকে প্রত্যক্ষ করেছে। মানুষের কাছে কিন্তু মোটামুটি তারেক জিয়ার মেমোরিটা এখনো আছে।’
‘ওই যে মেমোরিটা, হাওয়া ভবনের যে মেমোরি, মানে বিএনপির বিজয় তাকে কেন্দ্র করেই হবে এরকমটা যদি বিএনপি চিন্তা করে তাহলে তাকে ওই লিগ্যাসি থেকে বের হয়ে আসতে হবে।’
“এছাড়া তারেক রহমান দেশে ফিরলে তাকে ঘিরে নেতা-কর্মীদের মধ্যে ‘বেপরোয়াভাব’ চলে আসতে পারে এমন আশঙ্কাও করেন বিশ্লেষকদের কেউ কেউ। বিশেষ করে নির্বাচনের অতীত ইতিহাস বিবেচনায় বিএনপি জয়ী হতে যাচ্ছে, এমন ধারণা পাকাপোক্ত হলে সেটা নেতা-কর্মীদের বেপরোয়া করে ফেলতে পারে।”
সেই ধারণা থেকেই ব্যবসায়ী, সিভিল সোসাইটি, প্রশাসনসহ বিভিন্ন খাতের নেতাদের মধ্যেও বিএনপির দিকে ঝুঁকে পড়ার সম্ভাবনা থাকে।
রাজনীতির এমন জটিল পরিবর্তন এবং পরিস্থিতি যদি সামলানো না যায়, তাহলে সেটা ভোটারদের মধ্যেও বিরূপ ধারণা তৈরি করতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
রাজনীতি বিশ্লেষক সাব্বির আহমেদ বলেন, ‘তারেক রহমানকে ঘিরে একটা স্তাবক শ্রেণি তৈরি হবেই। এটা ভাঙা কঠিন। বিশেষ করে বিএনপির মতো রাজনৈতিক দলের জন্য। সিভিল ব্যুরোক্রেসি, আর্মি ব্যুরোক্রেসি, ব্যবসায়ী এমনকি সিভিল সোসাইটি- সবাই একটা মেরুর দিকে ঝুঁকবে। এতে কোনো সন্দেহ নাই। কারণ এটাই এখানকার কালচার।’
সবমিলিয়ে ১৭ বছর পর তারেক রহমানের দেশে ফেরার ঘটনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে বড় প্রভাবক হতে যাচ্ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই প্রভাব কী রকম হবে, সেটা নির্ভর করছে দেশে ফিরে তারেক রহমান কিভাবে দলকে নেতৃত্ব দেন এবং পরিস্থিতি সামলান তার ওপর।