হারানো দাঁড়িপাল্লা প্রতীক যেভাবে ফেরত পেতে পারে জামায়াত

২০১৩ সালে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হলেও তাদের দলীয় প্রতীক দাঁড়িপাল্লা বাদ দেয়া হয়েছিল ২০১৬ সালে ফুল কোর্ট সভায়

নয়া দিগন্ত অনলাইন
আদালত জামায়াতের দলীয় প্রতীকের বিষয়েও নির্বাচন কমিশনকে সিদ্ধান্ত নিতে বলেছে।
আদালত জামায়াতের দলীয় প্রতীকের বিষয়েও নির্বাচন কমিশনকে সিদ্ধান্ত নিতে বলেছে।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে দেয়া হাইকোর্টের রায় বাতিল করে রোববার আপিল বিভাগ দলটির নিবন্ধন ফিরিয়ে দিতে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) নির্দেশ দিয়েছেন। এছাড়া জামায়াতের দলীয় প্রতীক হিসেবে দাঁড়িপাল্লা ব্যবহারের বিষয়েও সিদ্ধান্ত নেবে ইসি।

আদালতের রায়ে ২০১৩ সালে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হলেও তাদের দলীয় প্রতীক দাঁড়িপাল্লা বাদ দেয়া হয়েছিল ২০১৬ সালে ফুল কোর্ট সভার একটি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী। যেটি কোনো রায় ছিল না।

যে কারণে নিবন্ধন ফেরত পেতে জামায়াত আপিলের পাশাপাশিও দাঁড়িপাল্লা প্রতীক বরাদ্দ বিষয়ে আলাদা একটি আবেদনও করেছিল।

যদিও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দাঁড়িপাল্লা প্রতীক নিয়ে জামায়াতের সঙ্কট এই প্রথম নয়। ১৯৮৬ সালে নির্বাচনের আগেও এই প্রশ্ন সামনে এসেছিল। তবে তখন সেটি আদালত পর্যন্ত গড়ায়নি।

নির্বাচন কমিশন সূত্র বলছে, এখনই এই প্রতীক জামায়াতকে দেয়ার আইনি সুযোগ কম। কেননা, বর্তমানে নির্বাচন কমিশনের প্রতীকের তালিকায় এখন দাঁড়িপাল্লা প্রতীক নেই।

যে কারণে, নির্বাচন কমিশনকে বিধিমালায় সংশোধন এনে সেটি আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিং করে পরে গেজেট আকারে প্রকাশ করতে হবে। যেটি একটু সময় সাপেক্ষ ব্যাপার।

নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ বলেন, ‘আদালতের রায় অনুযায়ী আইন বা বিধি মোতাবেক আমরা পরবর্তী প্রক্রিয়া গ্রহণ করব।’

যেভাবে দাঁড়িপাল্লা হারায় জামায়াত

১৯৮৬ সালে তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী দলীয় প্রার্থীদের জন্য প্রতীক হিসেবে ‘দাঁড়িপাল্লা’ বরাদ্দের জন্য আবেদন করে নির্বাচন কমিশনে। পরে আবেদনের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে তৎকালীন নির্বাচন কমিশন নির্বাচনি প্রতীক হিসেবে ‘দাঁড়িপাল্লা’ বরাদ্দ দেয় জামায়াতকে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘জামায়াতের প্রতীক নিয়ে ১৯৮৬ সালেও বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। তখন তারা বলেছে, এটা তাদের অনেক পুরানো প্রতীক। এই প্রতীক নিয়েই ১৯৭০ সালেও ভোট করেছিল। ইসি তখন এই প্রতীক বহাল রেখেছিল।’

এরপরে দলীয় প্রতীক দাঁড়িপাল্লা নিয়ে পরপর আরো পাঁচটি সংসদীয় নির্বাচনে অংশ নেয় জামায়াত। এতে কখনো জোটবদ্ধভাবে, কখনো স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে অংশ নেয় দলটি।

২০০৮ সালে নির্বাচন কমিশন যখন রাজনৈতিক দল নিবন্ধন চালু করে তখনও চাহিদা অনুযায়ী দাঁড়িপাল্লা প্রতীক দেয়া হয় জামায়াত ইসলামীকে।

হাইকোর্টে এক রিটের আদেশের ২০১৩ সালে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করা হয়। পরে তাদের নিবন্ধন বাতিল করে নির্বাচন কমিশন।

২০১৬ সালে রাজনৈতিক দল বা প্রার্থীকে প্রতীক হিসেবে দাঁড়িপাল্লা বরাদ্দ না দিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) চিঠি দেন সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। যদি কাউকে বরাদ্দ দেয়া হয়ে থাকে, তাহলে ওই বরাদ্দ বাতিলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতেও বলা হয়।

চিঠিতে আরো বলা হয়, এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারপতিদের উপস্থিতিতে ফুল কোর্ট সভায় সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহীত হয়েছে, ‘দাঁড়িপাল্লা’ ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের মনোগ্রামে ব্যবহৃত হবে। অন্য কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা রাজনৈতিক সংগঠনের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার না করার বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগ্রহণের জন্যও বলা হয় নির্বাচন কমিশনকে।

জামায়াতের আইনজীবী শিশির মনির বলেন, ‘তখন একটা ভিন্ন এজেন্ডাকে সামনে নিয়ে কাজটা করা হয়েছিল। ফুলকোর্ট সভার স্টাটাস হলো- প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত। এটা কোনো বিচারিক সিদ্ধান্ত না।’

তখন উচ্চ আদালতের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের ৯ মার্চ ‘দাঁড়িপাল্লা’ প্রতীক বাদ দিয়ে নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালা, ২০০৮ সংশোধন করে গেজেট প্রকাশ করে ইসি। ফলে নির্বাচনে দল বা প্রার্থীর প্রতীক হিসেবে দাঁড়িপাল্লা প্রতীক বাদ হয়ে যায়।

প্রতীক ফেরত আসতে পারে কিভাবে?

৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর জামায়াতে ইসলামী নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে। একইসাথে দলটি প্রতীক বরাদ্দ বিষয়ে একটি আবেদন দেয় ইসিতে।

সেখানে দলটি তাদের দলীয় প্রতীক দাঁড়িপাল্লার বিষয়ে আদালতের একটি পর্যবেক্ষণ চায়।

আইনজীবী শিশির মনির বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের কোনো আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই। কিন্তু তখনকার ইসি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত পাওয়ার পরেই প্রতীকের তালিকা থেকে দাঁড়িপাল্লা বাদ দিয়ে দিয়েছে। সে জন্য আমরা আপিল বিভাগের কাছে একটা পর্যবেক্ষণ চেয়েছিলাম।’

সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত দলটির নিবন্ধনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেয়ার পাশাপাশি দলীয় প্রতীকের বিষয়েও নির্বাচন কমিশনকে সিদ্ধান্ত নিতে বলেছে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জাহেদ ইকবাল বলেন, ‘এই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো আদালতে না গড়ানোই ভালো ছিল।’

এখন জামায়াতকে দলীয় প্রতীক দাঁড়িপাল্লা ফেরত দেয়ার প্রক্রিয়া শেষ হতে কত সময় লাগতে পারে, সেই প্রশ্ন সামনে আসছে।

নির্বাচন কমিশনের সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলী বলেন, ‘কোর্টের যে আদেশ থাকবে তার পরিপ্রেক্ষিতে বিধিমালাতে এটা অন্তর্ভুক্ত করবে ইসি। বিধিমালায় যুক্ত করার পর খসড়া আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে ইসি। ভেটিং শেষে আইন মন্ত্রণালয় থেকে ফেরত আসলেই গেজেট করতে পারবে নির্বাচন কমিশন।’

তবে ঠিক কতদিন সময় লাগবে সেটি এখনই বলছে না নির্বাচন কমিশন। কমিশন বলছে, আদালতের আদেশের সার্টিফাইড কপি আসলেই প্রক্রিয়া শুরু করে থাকে ইসি।

নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ বলেন, ‘আইন বা বিধিতে যা আছে সেই অনুযায়ী সব সিদ্ধান্ত হবে।’

সূত্র : বিবিসি