কৃষি মন্ত্রণালয়ভুক্ত সংস্থা/দফতরের কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীর ‘লিয়েন’ অর্থাৎ নিজের মূল পদ বহাল রেখে অন্যত্র চাকরি করার অনুমতি দেয়ার ক্ষমতা কৃষিমন্ত্রীর (বর্তমানে কৃষি উপদেষ্টা)। কৃষি মন্ত্রণালয় ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে সংশোধিত প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতা অর্পণ আদেশ জারি করে, যেখানে স্পষ্টভাবে বলা হয় অধিদফতর, পরিদফতর ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার কর্মচারীদের লিয়েন অনুমোদনের ক্ষমতা কেবল মন্ত্রীর। এমনকি সচিবেরও নেই এই ক্ষমতা। অথচ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর (ডিএই) বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এবং সাম্প্রতিক সময়েও সেই ক্ষমতা নিজেদের হাতে নিয়ে নিয়মবহির্ভূতভাবে ধারাবাহিকভাবে কর্মচারীদের লিয়েন দিয়ে আসছে। এটিকে কর্তৃত্বের অপপ্রয়োগ হিসেবেও দেখছেন অনেকে।
জানা যায়, এই অবৈধ লিয়েন অনুমোদনের অন্যতম সুবিধাভোগী মোফাজ্জল আমিন, যিনি ২০০৪ সালের নভেম্বরে অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদে যোগ দেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরে (ডিএই)। অভিযোগ রয়েছে, নোয়াখালীর বাসিন্দা হলেও জেলা কোটায় চাকরি না পেয়ে তিনি ঢাকার কাটাসুরের একটি ভাড়া বাসার ঠিকানা দেখিয়ে নিয়োগ নেন। তার বাবা তখন ডিএই’র আইন শাখায় চাকরি করায় ব্যক্তিগত কোটায় ছেলেকে চাকরিতে ঢোকানো হয়। এরপর সরেজমিন উইংয়ের গুরুত্বপূর্ণ একটি শাখায় পদায়ন পেয়ে তিনি দ্রুতই শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেটের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। সহকারী পরিচালক (অর্থ) মোহাম্মদ হারুন ও সৈয়দ শরিফুল ইসলামের নেতৃত্বে মাঠ পর্যায়ে বরাদ্দ বাণিজ্যের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার যে চক্র গড়ে ওঠে, মোফাজ্জল আমিন সেই চক্রেরই একজন বলে অভিযোগ রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ডিএইতে ২০১৬ সালের পর আইবাস সিস্টেম চালু হলে অর্থ বরাদ্দ ডিজিটাল হয়। রাজস্ব খাতের প্রায় এক হাজার ৬০০ কোটি টাকা এবং ৩১টি উন্নয়ন প্রকল্পের আরো দু’ হাজার ৯০০ কোটি টাকার আইবাস এন্ট্রি তার হাতে থাকায় ক্ষমতা ও সুযোগ দুটিই বেড়ে যায় কয়েকগুণ। অভিযোগ আছে, আইবাস এন্ট্রি করে কমিশন বাণিজ্য করেছেন তিনি।
খামারবাড়ি সূত্র বলছে, তাকে দায়িত্ব হস্তান্তরের নির্দেশ দেয়া হলেও তিন মাসেও তিনি আইডি হস্তান্তর করেননি। এমনকি ঢাকার বাইরে লিয়েনে থাকাকালীনও আইবাস পরিচালনা করেছেন সম্পূর্ণ অবৈধ।
২০২৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর তখনকার পরিচালক (প্রশাসন) জয়নাল আবেদীন প্রথম দফায় মোফাজ্জল আমিনের লিয়েন অনুমোদন দেন, যা ছিল সরাসরি ক্ষমতা বহির্ভূত। লিয়েন নিয়ে তিনি উচ্চ বেতনে ময়মনসিংহে ডিএই’র আবহাওয়া প্রকল্পে জুনিয়র ফিন্যান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট কনসালটেন্ট হিসেবে তিনি যোগ দেন, পরে মেয়াদও বাড়ানো হয়। লিয়েনে থাকা অবস্থায় তিনি ডিএই’র আইবাস ধরে রাখেন। প্রকল্প শেষ হওয়ার পর খামারবাড়িতে ফেরার পরও তিনি আইবাসের দায়িত্বে থাকেন। তার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও সদ্য বিদায়ী ডিজি ছাইফুল আলম অবসরের ঠিক আগের দিন গত ২৯ অক্টোবর ফের মোফাজ্জল আমিনকে দেড় বছরের লিয়েন দিয়ে যান, যা আইনগতভাবে সম্পূর্ণ অবৈধ। কৃষির সম্প্রসারণ অধিদফতরের টারাপ প্রকল্পে (পার্টনার প্রকল্পভুক্ত) মাসে লক্ষাধিক টাকা বেতনে ‘অ্যাসিস্ট্যান্ট ফিন্যান্সিয়াল ম্যানেজার অব টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্টস’ পদে তিনি নিয়োগ পান; যেখানে পিএইচডিধারী আবেদনকারীদেরও টেক্কা দিয়ে তাকে সুযোগ দেয়া হয়।
একই ধারাবাহিকতায় বর্তমান ডিজি এস এম সোহরাব উদ্দিনও নিয়মবহির্ভূতভাবে আরেক প্রধান সহকারী আরিফ বিল্লাহকে দেড় বছরের লিয়েন দিয়েছেন, যিনি একই প্রকল্পে জুনিয়র প্রজেক্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। অথচ, নিয়ম অনুযায়ী এসব লিয়েন অনুমোদনের ক্ষমতা শুধু কৃষিমন্ত্রীর (বর্তমানে উপদেষ্টা) হাতে।
এর আগে, ২০২৪ সালের ৯ এপ্রিল লিয়েন নিয়ে সপরিবারে কানাডা পাড়ি জমান খামারবাড়ির আরেক প্রভাবশালী কর্মচারী নাজমুল হুদা। প্রশাসন ও অর্থ শাখায় দায়িত্বে থাকাকালীন নিজের ফাইল গোপনে উত্থাপন করেই তিনি লিয়েন অনুমোদন নেন। অভিযোগ রয়েছে, বিপুল অবৈধ সম্পদ গোপনে বিক্রি করে তিনি দেশ ছাড়েন।
রাজধানী ঢাকার মোহাম্মদপুরের মোহাম্মদীয়া হাউজিংয়ের ৩ নম্বর রোডের ৭৯ নম্বর হোল্ডিংয়ের পঞ্চম তলায় কোটি টাকার ফ্ল্যাট, মোহাম্মদপুরের কাটাশূর ঢাকা রিয়েল এস্টেটের ২ নম্বর রোডের ৪৪ নম্বর বাড়িতে আরেকটি ফ্ল্যাট রয়েছে বলে জানা যায়।
এছাড়া, নামে বেনামে তার জমি বা সম্পদ রয়েছে বলে অভিযোগ খামারবাড়িতে চাওড় আছে। এদিকে, রাজধানীতে নিজস্ব বাসা থাকা সত্ত্বেও নিয়মবহির্ভূতভাবে মোফাজ্জল আমি ২০২১ সালে সরকারি আবাসন পরিদফতর থেকে রাজধানীর মোহাম্মদপুর কাজী নজরুল ইসলাম রোডের কে-০১ নীচতলার ডি টাইপের বাসা বরাদ্দ নেন। ২৪ হাজার ১১০ টাকা মূল বেতনের বিপরীতে সরকারি এই বাসা ভাড়া বাবদ তার প্রতি মাসে ১২ টাকা কর্তন হয়। তবে, এই বাসায় তিনি না থেকে অন্যের কাছে প্রায় দ্বিগুণ টাকায় ভাড়া দেন বলে অভিযোগ।
অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জনের বিষয়টি অস্বীকার করেন প্রধান সহকারী মোফাজ্জল আমিন। তিনি দাবি করেন, মোহাম্মদপুরের মোহাম্মদীয়া হাউজিংয়ের ৩ নম্বর রোডের ৭৯ নম্বর হোল্ডিংয়ের বাসায় ভাড়ায় থাকতাম। তবে, ঢাকা রিয়েল এস্টেটের ২ নম্বর রোডের ৪৪ নম্বর বাসাটি বাপ-দাদার। তাহলে নিজস্ব বাসা থাকা সত্ত্বেও সরকারি আবাসন থেকে কেন বাসা বরাদ্দ নিলেন এব তা অন্যকে ভাড়া দিলেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভাড়া দেইনি। ওটা একজনকে থাকতে দিয়েছি। আইবাসের দায়িত্ব হস্তান্তর করা হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।
এদিকে, লিয়েন অনুমোদনের ক্ষমতা না থাকলেও কিভাবে কর্মচারীদের লিয়েন অনুমোদন দেয়া হলো–জানতে সদ্য বিদায়ী ডিজি ছাইফল আলমকে ফোন দিলেও রিসিভ করেননি। তবে, বর্তমান ডিজি এস এম সোহরাব উদ্দিন জানান, সম্ভবত কর্মচারীদের লিয়েন অনুমোদনের ক্ষমতা আছে। ২০১৭ সালের জারি করা কৃষি মন্ত্রণালয়ের সংশোধিত প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতা অর্পণ আদেশ অনুযায়ী অধিদফতর/পরিদফতর/স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার কর্মচারীদের লিয়েন অনুমোদনের পূর্ণ ক্ষমতা শুধু কৃষিমন্ত্রী বা বর্তমানে উপদেষ্টার-এ তথ্য জানালে তিনি বলেন, আমার তো আর সবকিছু দেখার সুযোগ হয় না। নিচ থেকে ফাইল ওঠে আমি স্বাক্ষর করি। যদি ক্ষমতা না থাকে তাহলে আমরা স্বাক্ষর দিলেও কাজ হবে না।



