জলবায়ু পরিবর্তনসংশ্লিষ্ট সংকট মোকাবেলায় গঠিত সরকারের নিজস্ব তহবিল ‘বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন তহবিল’ (বিসিসিটি) ফান্ডের ৫০ শতাংশেরও বেশি অর্থ নানাবিধ অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার আর্থিক পরিমাণ দুই হাজার কোটি টাকার বেশি।
‘বাংলাদেশে জলবায়ু অর্থায়নে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) ধানমন্ডিস্থ কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য উপস্থাপন করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
গবেষণা অনুযায়ী ২০১০-২০২৪ সময়কালে বিসিসিটির অধীনে মোট ৮৯১টি প্রকল্পে প্রাক্কলিত তহবিল বরাদ্দ অনুমোদনের পরিমাণ ৪৫৮.৫ মিলিয়ন ডলার বা তিন হাজার ৮৯৬ কোটি টাকা এবং উক্ত সময়কালে প্রাক্কলিত মোট দুর্নীতির পরিমাণ ২৪৮.৪ মিলিয়ন ডলার বা দুই হাজার ১১০.৬ কোটি টাকা।
টিআইবির সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, প্রকল্প অনুমোদনে ঘুষ ও অবৈধ লেনদেন, ঠিকাদার নিয়োগে অনিয়ম ও প্রকল্প বাস্তবায়ন পর্যায়ে অর্থ আত্মসাতের মাধ্যমে দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছে টিআইবির গবেষণায়।
সংস্থাটি জানায়, জলবায়ু তহবিল বরাদ্দ ও বাস্তবায়নে অনিয়ম-দুর্নীতির ব্যাপকতা ও দুর্নীতি প্রতিরোধে ব্যর্থতা একদিকে চাহিদার তুলনায় নগণ্য বরাদ্দের ব্যাপক অপচয়, অন্যদিকে এসব বরাদ্দ ও প্রকল্পের উপযোগিতার অভাব বিসিসিটিকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে। যার কারণে ভবিষ্যতে জলবায়ু খাতে অর্থ বরাদ্দ কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে এবং দুর্নীতির ফলস্বরূপ প্রকৃত ঝুঁকিগ্রস্ত প্রান্তিক জনগোষ্ঠী দীর্ঘমেয়াদে সরকারি বরাদ্দ থেকে বঞ্চিত হবে।
আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলামের সঞ্চালনায় প্রতিবেদনটি উপস্থাপনা করেন সিনিয়র রিসার্চ ফেলো মো: মাহ্ফুজুল হক ও রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট মো: সহিদুল ইসলাম। এছাড়া সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের ও গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মুহাম্মদ বদিউজ্জামান।
সরকারি তহবিলের অধীনে প্রকল্প বাস্তবায়নে নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে ৫০ শতাংশের বেশি ক্ষতির সাথে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার সমালোচনা করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এ খাতে অনিয়ম-দুর্নীতির ধরন ও মাত্রা নির্দেশ করে এটি রাজনৈতিক যোগসাজশে দুর্নীতির বিশেষায়িত ক্ষেত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এতে জড়িত বিভিন্ন অংশীজন যেমন- বিসিসিটি বোর্ড প্রধান বা সদস্যসহ রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী মহলের স্বার্থের দ্বন্দ্ব ও ক্ষমতার অপব্যবহার, বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তাদের একাংশের দুর্নীতি ও ঠিকাদার বা বাস্তবায়নকারী সংস্থার অনিয়ম ও অবৈধ লেনদেন এ খাতে দুর্নীতিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। অন্যদিকে জলবায়ু অর্থায়নে ঝুঁকি ও বিপদাপন্নতা বিবেচনায় প্রাধান্যনির্ভর সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা ও সুযোগ থাকলেও অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে তা অর্জিত হয়নি।’
তিনি আরো বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সর্বাধিক ঝুঁকিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। বাংলাদেশসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে অর্থায়নের কথা ছিল সিংহভাগ পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী উন্নত দেশগুলোর। যারা দায় স্বীকার করে বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশের মতো ক্ষতিগ্রস্ত দেশসমূহকে স্বাভাবিক বৈদেশিক সহায়তার অতিরিক্ত ও নতুন অনুদান হিসেবে প্রদানের অঙ্গীকার করেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেই দূষণকারী দেশগুলো অঙ্গীকার রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক তহবিলগুলো থেকে অর্থ ছাড়ের পরিমাণও একেবারেই নগণ্য। একারণে জাতীয় বাজেটের অংশ হিসেবে জনগণের অর্থে জলবায়ু তহবিলের দুর্নীতিমুক্ত ব্যবহারের গুরুত্ব অসীম।’
সরকারি অর্থায়নে সুশাসনের সকল মানদণ্ডে ঘাটতি দেখা গেছে মন্তব্য করে ড. জামান বলেন, ‘সরকার ও বিশেষজ্ঞদের প্রাক্কলন অনুযায়ী ২০০৩ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত প্রকল্পে মোট বরাদ্দের প্রয়োজন ছিল ১০ থেকে ১২ বিলিয়ন ডলার। এর বিপরীতে আমরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মোট বরাদ্দ পেয়েছি মাত্র এক দশমিক দুই বিলিয়ন ডলার। এই নগণ্য পরিমাণ অর্থও স্বচ্ছতার সাথে ব্যয় করা হয়নি বরং রীতিমত লোপাট হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট মোকাবেলায় বিদেশী অর্থায়নের প্রত্যাশিত প্রবাহ না থাকায় দেশীয় অর্থায়ন একধরনের আশাবাদ সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু এ গবেষণা থেকে যা প্রকাশিত হলো তা একান্তই বিব্রতকর।’
তিনি আরো বলেন, ‘সরকারি অর্থায়ন যতটুকু ছিলো তার সিংহভাগ, দুই হাজার কোটি টাকারও বেশি আত্মসাৎ বা অপচয় করা হয়েছে অনিয়ম দুর্নীতির মাধ্যমে। গত ১৬ বছরের চৌর্যতন্ত্রের সার্বিক লুটপাটের তুলনায় এই পরিমাণ কম মনে হলেও আদতে তা এ খাতের সরকারি তহবিলের ৫৪ শতাংশ। তবে এই কারণে সরকারি অর্থায়নে জলবায়ু প্রকল্পের গুরুত্বের অবমূল্যায়নের সুযোগ নেই বরং সরকারি বরাদ্দ আরো বাড়াতে হবে। পাশাপাশি অনিয়মের সাথে যারা জড়িত ছিল তাদের পরিচয় ও অবস্থান নির্বিশেষে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। বিসিসিটিকে সরকারি ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে পেশাদারিত্বের সাথে ভূমিকা পালনের উপযোগী করে ঢেলে সাজাতে হবে।’
গবেষণার ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, বিসিসিটির প্রকল্প বাস্তবায়ন পর্যায়ে দুর্নীতির পরিমাণ সর্বোচ্চ। উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে সড়কের বাতি ও সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল স্থাপনের আড়ালে। ২০১৯-২০২৩ সাল পর্যন্ত বিসিসিটি বোর্ড মোট ৩৭৩টি প্রকল্প অনুমোদন করে। এর মধ্যে ২১৬টি প্রকল্প পৌরসভাসহ বিভিন্ন স্থানে সৌর সড়কবাতি নির্মাণ সংশ্লিষ্ট যা এই সময়ের গৃহীত মোট প্রকল্পের ৫৭.৯ শতাংশ। এ সংক্রান্ত অধিকাংশ প্রকল্প প্রস্তাবে যন্ত্রাংশের অতিমূল্যায়ন করে অনুমোদন করা হয় যা সার্বিকভাবে ৪৭.১-৫৭.১ শতাংশ। শুধুমাত্র সৌর সড়কবাতি প্রকল্প থেকে অর্থ আত্মসাতের প্রাক্কলিত পরিমাণ ১৭.০-২০.৭ মিলিয়ন ডলার বা ১৪৪-১৭৫ কোটি টাকা। বিসিসিটির অধীনে গত ১৪ বছরে প্রকল্প অনুমোদনে ঘুষ ও অবৈধ লেনদেন হয়েছে ১৭৫ কোটি টাকা, যোগসাজশে টেন্ডার, ঠিকাদার নিয়োগ ও সাব-কন্ট্রাক্টের মাধ্যমে দুর্নীতির পরিমাণ ৫৯৯.৯ কোটি টাকা, প্রকল্প বাস্তবায়ন পর্যায়ে আত্মসাৎ করা হয়েছে ১২৮১.৩ কোটি টাকা এবং পরিবীক্ষণ কর্মকর্তাদের মধ্যে ঘুষ লেনদেন হয়েছে ৫৪.৪ কোটি টাকা।
গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনাসমূহ যেমন- জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অনুমিত অবদান (এনডিসি), জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (অভীষ্ট ১৩) ও বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ বাস্তবায়নে অর্থায়নের ঘাটতি লক্ষণীয়। সরকারের নিয়মিত বাজেট থেকে উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় জলবায়ুসংশ্লিষ্ট অর্থ বরাদ্দ করলেও তা বার্ষিক প্রাক্কলিত প্রয়োজনের মাত্র ২৩.২ শতাংশ। এ ছাড়া জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জলবায়ু তহবিল থেকেও বরাদ্দ কম, যা বার্ষিক প্রয়োজনের মাত্র শূন্য দশমিক সাত শতাংশ।
জলবায়ু পরিবর্তন সংশ্লিষ্ট বিদ্যমান আইন ও নীতিমালাতেও দুর্বলতা রয়েছে। বিশেষত, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা (বিসিসিএসএপি) ও বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট আইন, ২০১০ বর্তমান যুগোপযোগী নয়। পরিকল্পনা ও নীতিতে তহবিল ও প্রকল্প বাস্তবায়ন সংক্রান্ত বিধি ও নির্দেশনা অনুপস্থিত রয়েছে। সার্বিকভাবে, বাংলাদেশে জলবায়ু অর্থায়ন ও এ সংক্রান্ত কার্যক্রম বাস্তবায়নে যথাযথ গুরুত্ব প্রদান করা হয়নি। প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য বাজেট বরাদ্দ, চাহিদা, ভৌগোলিক বাস্তবতা ও পরিকল্পনা ও নীতির সাথে সঙ্গতিহীন প্রকল্প গ্রহণ ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ঘাটতিতে এর প্রতিফলন দেখা যায়।
অন্যদিকে, সুশাসনের সব নির্দেশকেই জলবায়ু তহবিলের কার্যক্রমে ব্যাপক ঘাটতি লক্ষ করা যায়। এর মধ্যে রয়েছে আইন, নীতি ও পরিকল্পনার দুর্বলতা ও বিভিন্ন নীতি-নির্দেশিকার অনুপস্থিতি, বিপদান্নতার মাত্রা বিবেচনায় তহবিল বরাদ্দে সামঞ্জস্যহীনতা, তহবিলের অধীনে প্রকল্প বাস্তবায়নে সক্ষমতার ঘাটতি, তহবিল সংগ্রহ ও ছাড় এবং বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রিতার ফলে কার্যকারিতার ঘাটতি, দুর্বল জবাবদিহি কাঠামো ও চর্চা, তথ্য প্রকাশে ঘাটতি, অংশীজনের অংশগ্রহণ ও সমন্বয়ে ঘাটতি ও অনিয়ম-দুর্নীতির ব্যাপকতা ও দুর্নীতি প্রতিরোধে ঘাটতি।
গবেষণার ভিত্তিতে সরকার ও সংশ্লিষ্ট অংশীজনের বিবেচনার জন্য নয় দফা সুপারিশ করেছে টিআইবি।
টিআইবির নয় দফা সুপারিশের মধ্যে আছে, বিসিসিএসএপি ২০০৯ ও জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত জাতীয় পরিকল্পনাসমূহ হালনাগাদ করা এবং জাতীয় পরিকল্পনাসমূহ বাস্তবায়নে ট্রাস্ট ফান্ড ও উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় জলবায়ু সংশ্লিষ্ট অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধি করা, ট্রাস্ট আইন ২০১০ সংশোধন করা, রাজস্ব বাজেটের বাইরে বিসিসিটিকে উদ্ভাবনীমূলক কার্যক্রম যেমন- আন্তর্জাতিক জলবায়ু তহবিল, কার্বন ট্রেডিং, ক্লিন ডেভলপমেন্ট ম্যাকানিজমসহ বেসরকারি অর্থায়ন উৎস থেকে তহবিল সংগ্রহে উদ্যোগ গ্রহণ, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করে প্রকল্প অনুমোদন ও বাস্তবায়নসহ ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর কাছে জলবায়ু তহবিল কার্যকরভাবে পৌঁছাতে বিপদাপন্নতার সূচক ও ভৌগোলিক ঝুঁকিকে প্রাধান্য দেয়া, তহবিলসমূহের প্রকল্প বাস্তবায়নে বিবিধ অনিয়ম-দুর্নীতির সাথে জড়িতদের বিচার নিশ্চিত করা, বাংলাদেশে বাস্তবায়িত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জলবায়ু তহবিলের প্রকল্প নিয়মিত তদারকি ও নিরীক্ষা করার জন্য একটি পৃথক স্বাধীন তদারকি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা। প্রেস বিজ্ঞপ্তি



