শাহানারা স্বপ্না
বৈশাখের সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির নানা অনুষঙ্গ। সূচনাকাল থেকেই এটি আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। মানবজীবনে সময় গণনার উন্মেষলগ্ন থেকেই বৈশাখ মাস ছিল কৃষকের হাসি-আনন্দ ও আশা আকাঙ্খার মূর্ত প্রতীক।
আমাদের সংস্কৃতি বলতে আমরা বুঝি মূলত মানুষের প্রাত্যহিক জীবনাচরণের অভিজ্ঞতার নির্যাস। সভ্য সমাজ ও সভ্যতাই জন্ম দিতে পারে উন্নততর সংস্কৃতি। বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিভা আবুল মনসুর আহমদ এ সম্পর্কে লেছেন- ‘কথাটা সহজে বুঝিবার জন্য আমরা সভ্যতাকে ইমারতের সঙ্গে তুলনা করতে পারি। আর কালচারকে তুলনা করতে পারি গাছের সঙ্গে। ইমারত মাটি হইতে রস গ্রহণ করে না। কাজেই যেকোনো প্ল্যানের ইমারত যেকোনো দেশে নির্মিত হইতে পারে। কিন্তু গাছকে মাটি হইতে রস সংগ্রহ করিয়া বাঁচিতে হয়। সে জন্য যেকোনো গাছ দুনিয়ার যেকোনো দেশে লাগানো যায় না। কোনো দেশের কালচার তা যতই সুন্দর হউক না কেন, অন্য দেশে তা চালানো যাইবে না। স্থানীয় রসের অভাবে তা মারা যাইবে। কারণ আগেই বলিয়াছি- কালচারটা মনের বস্তু, মস্তিষ্কের নয়। এই দিক হইতে বিচার করিয়া বলা যায় সিভিলাইজেশন একটি ন্যাশনাল কনস্ট্রাকশন; আর কালচার একটি ইমোশনাল গ্রোথ।’ আমাদের সংস্কৃতির শেকড় গ্রথিত লোকজ সংস্কৃতির গভীরে। সেখানের রূপ-রস-গন্ধ-মাধুর্যে পরিপুষ্ট হয়েছে এই সংস্কৃতি। লোকজীবন, দর্শন, সাহিত্য, খাবার-দাবার, প্রথা উৎসব ইত্যাদির রয়েছে ঐতিহ্যবাহী সমৃদ্ধ ইতিহাস। আবহমানকালের সমাজ সভ্যতার ধারক মানুষের ব্যক্তিগত ও সমাজবদ্ধ জীবনযাপনের নান্দনিক প্রতিচ্ছবিই হলো সংস্কৃতি।
ইসলামই প্রথম সুস্থ সংস্কৃতির রূপকল্প মানুষের সামনে হাজির করে। মানুষের জন্য যা শুভ ও কল্যাণকর, তাকে তুলে ধরতে ইসলাম বদ্ধপরিকর। ইসলাম সারা বিশ্বে জয়ের নিশান হাতে এগিয়ে চলার পথে কখনো নিজের মতামত কোনো সমাজের ওপর চাপিয়ে দেয়নি; বরং যা কিছু ভালো তার সাথে ইসলামী রীতি-নীতির সংমিশ্রণ ঘটিয়ে মানুষের হৃদয় জয় করেছে, সমাজে স্থিতিস্থাপকতা এনেছে। এ প্রসঙ্গে শাহ আবদুল হালিম তার ‘সংস্কৃতির পুনর্পাঠ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘জনগণের ন্যায়সঙ্গত প্রথা ও আচার ব্যবহারের প্রতি সমর্থন এবং এসবকে মৌলিক, বুনিয়াদি ও স্থায়ী পলিসি গাইডলাইন হিসেবে গ্রহণ করার জন্য আল্লাহ তার নবীকে নির্দেশ দিয়েছেন। ইসলাম-পূর্ব যুগের আরব দেশের স্থানীয় সংস্কৃতিকে রাসূল সা: ধ্বংস করেননি; বরং তিনি এসবের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করেছেন; যা অসঙ্গত, তা সংশোধন করেছেন; যা ক্ষতিকর তা পরিবর্তন করেছেন।’
এভাবে সংস্করণের মাধ্যমেই তিনি আল্লাহর নির্দেশে মানব জাতির জন্য একটি আদর্শ জীবনের রূপরেখা প্রণয়ন করেছেন। মানবসভ্যতা ও সংস্কৃতি দুটো সমানভাবে পাশাপাশি কাজ করে চলে। একটি অপরটির পরিপূরক। যেকোনো জাতির মননশীল সভ্যতা ও সংস্কৃতি সাধনাসাপেক্ষ। ইসলামী জীবন পদ্ধতি আদর্শভিত্তিক সংস্কৃতি বা তমুদ্দুনের জন্ম দেয়। এই আদর্শিক জীবন ব্যবস্থা যা কিছু সুন্দর, কল্যাণকর, তা বরণ করে নিয়ে সব দেশের, সব জাতির ও কালের অনুসরণীয় হয়ে ওঠার শক্তিতে পরিপূর্ণ।
মানুষের সব কাজ কখনো শুভ হয় না। এই শুভ-অশুভের পার্থক্য সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করতেই ইসলামের আবির্ভাব। কুরআন মানব জাতিকে আহ্বান করেছে ইতিহাসের মধ্যে নিহিত স্বর্গীয় পরিকল্পনা অনুধাবন করতে। মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতির মূল শক্তি নিহিত নৈতিক উৎকর্ষ, বস্তুগত সামর্থ্য, সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তা অর্জনের মধ্যে। মার্শাল জি এস হডসন তার ‘দ্য ভেঞ্চার অব ইসলাম’-এর তিন নং ভলিয়ুমের ৪৪১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন, ‘যদি প্রমাণ করা যায় যে, ইসলাম আধুনিক যুগের মানুষের বিবেককে আলোকিত করার জন্য ফলপ্রসূ রূপকল্প সরবরাহ করতে সক্ষম, তাহলে এর ফলাফলে শুধু কেবল মুসলমানের নয়, গোটা মানব জাতির স্বার্থ রয়েছে।’
মানুষ যেমন বৈচিত্র্যময় তেমনি লোক সংস্কৃতিতেও রয়েছে বিচিত্রিত শাখা-প্রশাখা। হিন্দু-মুসলিম-খ্রিষ্টান, পাহাড়ি সব মানুষের জীবনাচরণের ভিন্ন ভিন্ন ধ্রুপদি ধারা এক হয়ে মিশেছে আমাদের সংস্কৃতিতে। বিভিন্ন লৌকিক সমাজের ধ্যান-ধারণা, বোধ-বিশ্বাস, খেলাধুলা, গান, নৃত্য, উৎসব, পালা পার্বণ ইত্যাদি সংস্কৃতির উপাদান। ইসলামের আবির্ভাবের সাথে সাথেই বাংলায় প্রসারমান ঘটে ইসলামের। সেই সাথে মুসলিম ঘরানার তাহজিব তমুদ্দুন লোকজ সংস্কৃতিকে উন্নততর সোপানে নিমগ্ন করে। এ সময় থেকেই বাঙালি জীবনে আসে বুদ্ধিবৃত্তিক সংস্কৃতির জোয়ার। বাংলা ভাষা, সাহিত্য, পুঁথি, ইতিহাস, গান ইত্যাদি রচিত হতে থাকে ইসলামের আদর্শিক বাতাবরণে। বাঙালি জীবনে শুরু হয় মনীষার ভিত্তিপ্রস্তরের স্বপ্ন, রেনেসাঁর যুগ।
প্রতাপশালী মুঘল বাদশাহ আকবর প্রথম পয়লা বৈশাখকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় অভিষিক্ত করেন। তার সভাসদ ফতেউল্লাহ সিরাজিকে নির্দেশ দেন বাঙালি জীবনের আনন্দের সাথে সম্পৃক্ত একটি দিনকে উৎসবের দিন হিসেবে নির্দিষ্ট করার জন্য। চান্দ্র ও সৌর মাস নিয়ে গবেষণাসাপেক্ষে ফতেউল্লাহ সিরাজি ১৫৫৬ সালে ধার্য করেন বৈশাখের প্রথম দিনটি। আকবরের আমলেই পয়লা বৈশাখ রাজস্ব আদায়, খাজনা প্রদান ও উৎসবের দিন হিসেবে পালিত হওয়ার রেওয়াজ শুরু হয়। কালক্রমে বাঙালি জীবনে পরিণত হয় এক সাংস্কৃতিক আনন্দোৎসবে। এ সময়ে নতুন ধান ওঠে, কৃষকের মুখে হাসি ফোটে। সারা বছরের জমানো স্বপ্নগুলো এ সময়ে তারা পূরণের চেষ্টা করে। সেই থেকে পয়লা বৈশাখ আমাদের সংস্কৃতির অন্যতম আনন্দের দিন। ছোট-বড়, নারী-পুরুষ, যুবা-বৃদ্ধ সবাই মিলে উৎসবে সৃষ্টি করে প্রাণের জোয়ার। পয়লা বৈশাখ তাই গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে সর্বজনীন উৎসবের।
এই উৎসবে বাংলার দুই বিরাট প্রতিবেশী হিন্দু ও মুসলিম নিজ নিজ ঐতিহ্যানুসারে বরণ করে নতুন বছরকে। ঘরে ঘরে রান্না হয় নবান্ন, পিঠাপুলি। মহা ধুমধামে চলে নতুন জামাকাপড় পরিধান, আত্মীয়স্বজনের বাড়ি বাড়ি দাওয়াত ও মিষ্টান্ন বিলি-বিতরণ, মেলায় অংশগ্রহণ ইত্যাদি। হিন্দুরা তাদের মতো করে পূজা পার্বণ, নিমন্ত্রণসহ বিভিন্ন আনন্দানুষ্ঠান পালন করে। আর মুসলমানরা ওয়াজ মাহফিল, নতুন বছরের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া প্রার্থনা, মিলাদ মাহফিল ইত্যাদি পালন করে।
প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয় বৈশাখী মেলা, নৌকাবাইচ, লাঠিখেলা, কুস্তিলড়া, পুঁথির আসর, গম্ভীরা, কবিয়াল, গাজীর কিচ্ছা ইত্যাদির আসর। এতে মানুষের মধ্যে দৃঢ় হয় সামাজিক ও লৌকিকতার বন্ধন। সমাজ ঋদ্ধ হয় সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ডের অনুশীলনে। বিভিন্ন দুস্থ প্রতিষ্ঠান, মন্দির-মসজিদ, এতিমখানা, মাদরাসা সর্বত্র মানুষ দান করে খোলা মনে ও ভালো খাবারের জোগান দেয়। বণিক ও ব্যবসায়ী সমাজেও প্রসারিত হয় অর্থ ও বাণিজ্যের নতুন দিগন্ত। বছর শেষে হিসাব-নিকাশ নবায়ন করে খোলা হয় ‘হালখাতা’। মূলত হালখাতাই পয়লা বৈশাখের মূল আকর্ষণ। ঘরে ঘরে যেমন উৎসবের বান ডাকে, দোকানে, বিপণিবিতানেও সাজসজ্জার প্লাবণ দেখা দেয়। নতুনত্ব ও সম্প্রীতির সাড়া জাগে। প্রত্যেকে সাধ্যমতো নতুনভাবে সাজিয়ে তোলে নিজেদের প্রতিষ্ঠানকে। আলোকসজ্জিত বাণিজ্যালয়ে অন্যরকম আলোকিত দিনের মাত্রা যোগ হয়। এ সময় ক্রেতা-বিক্রেতার সাথে নবায়িত হয় তাদের সম্পর্ক, গড়ে ওঠে পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়া, যা একটি সমাজের সুস্থভাবে টিকে থাকার মূলে রস সিঞ্চন করে। উপহারে, আনন্দে শহর থেকে প্রান্তিক জনজীবনে বয়ে যেত নির্মল এক আনন্দধারা।
সংস্কৃতির মিলনমেলার এই প্রস্ফুটিত বাগানে হঠাৎ দেখা দেয় ষড়যন্ত্রের কালো ছায়া, আধিপত্যবাদীদের করাল গ্রাস। নিজেদের ঘৃণ্য অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য কলঙ্কিত করল সর্বজনীন এ উৎসবধারাটিকে। ষড়যন্ত্রকারীরা হিন্দু ধর্মের লক্ষ্মী, কালী, পেঁচা, হনুমান ইত্যাদি আমদানি করে বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে পুরো হিন্দুয়ানি রূপ দিতে চেষ্টা করল। ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নাম দিয়ে মুছে দিতে চাইল বৃহত্তর মুসলিম দেশের মুসলিম সংস্কৃতি। যার ফলে একটি সর্বজনীন উৎসবে দেখা দিলো সাম্প্রদায়িক রূপ, যা কারোর কাম্য হতে পারে না।
বর্তমান আমরা এক ক্রান্তিকালীন সময় পার করছি। একটি মুসলিম ভূখণ্ডের জনসাধারণের ওপর জোরপূর্বক অন্য ধর্ম, অন্য দেশের সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। চব্বিশে জুলাই এ দেশের তরুণ সমাজ নিজেদের রক্তের বিনিময়ে সেই অশুভ শক্তিকে পরাজিত করে নতুন আশার প্রদীপ জ্বেলেছে। সমাজের একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবীর হঠকারী আচরণ অন্ধত্বের পর্যায়ে পড়ে। দুই-দুইবার স্বাধীন হয়েও তাদের উপনিবেশায়ানকৃত মস্তিষ্ক থেকে দাসত্বের শৃঙ্খল মোছেনি।
আমরা বাঙালি মুসলমান। আমাদের আত্মপরিচয়ের নতুন সংজ্ঞা নির্ধারণের দায়িত্ব তুলে দিয়েছে ইতিহাস আমাদের হাতে। স্বতন্ত্র ঐতিহ্য, নিজস্ব সংস্কৃতির পাটাতন তৈরি করতে হবে নিজেদেরই। পয়লা বৈশাখ সর্বজনীনভাবে আমরা উদযাপন করব নিজস্ব ঐতিহ্যিক ধারায়। বাঙাল মুসলমানের কল্যাণকর বিশ্বাসে উজ্জীবিত হবে সুস্থ সংস্কৃতির ধারা। সঞ্চার করবে আনন্দ, উদ্দীপনা ও নতুন জীবনের বার্তা। পয়লা বৈশাখের বর্ণিল উৎসব হোক আমাদের উজ্জ্বল জীবনবোধের অঙ্গীকার। এই আশায় জাতীয় অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান তার ‘বিদায়ী বাংলা চতুর্দশ শতাব্দী’ শীর্ষক প্রবন্ধে উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছিলেন- ‘বাংলা চতুর্দশ শতকের শেষ মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আমি সব লেখক ও সংস্কৃতিসেবীর কাছে একটি আবেদন জানাতে চাই, তারা যেন জীবনের জন্য এমন একটি কর্মবৃত্ত নির্মাণ করেন যা আসক্তি এবং অপরাধপ্রবণতার বিরুদ্ধতা করবে। তারা যেন তাদের জীবনবোধকে সংশয়িত না রাখেন। তারা যেন বিশ্বাসের জন্য এমন একটি বলয় নির্মাণ করেন, যেখানে মানব-হিতৈষণা হচ্ছে সৃষ্টি চৈতন্যের মূলকথা। যন্ত্রণা আছে এবং যন্ত্রণা থাকবেই। কিন্তু যন্ত্রণাকে প্রাসঙ্গিক রেখেই কল্যাণের কথা ভাবতে হবে। নববর্ষের সূত্রপাতে আমরা প্রথম ঊষার আলোয় আলোকের তরঙ্গভঙ্গ লক্ষ করি। এ বিচিত্রতা মধুময়। নববর্ষের জয় হোক।’