মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চল থেকে গত এক বছরে নতুন করে আরো অন্তত এক লাখ আঠারো হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে। এখনো প্রতিদিন গড়ে ২০-৩০ জন রোহিঙ্গা সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে বলে জানিয়েছে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়।
কক্সবাজারে স্থানীয় বাংলাদেশীরা বলছেন, নতুন রোহিঙ্গাদের সংখ্যা আরো অনেক বেশি এবং বিষয়টি স্থানীয় বাংলাদেশী নাগরিকদের জন্য গভীর উদ্বেগের। নতুন এই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিবন্ধন, থাকা খাওয়ার ব্যবস্থাসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনা নিয়েও দুশ্চিন্তা রয়েছে।
রাখাইনে কী পরিস্থিতি?
মে মাসের শুরুতে স্বামী, দু’ সন্তান ও বাবাকে নিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে হামিদা বেগম। রাখাইনে পরিস্থিতি তাদের জন্য এতটাই খারাপ যে তার মাকে একা রাখাইনে ফেলে আসতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আাশ্রয় নিলেও হামিদার পরিবার নতুন আসা রোহিঙ্গাদের সরকারি-বেসরকারি হিসাবের বাইরে।
হামিদা ও তার পরিবার যেখানে আশ্রয় নিয়েছেন তার কাছাকাছি আরেকটি ঘরে উঠেছেন সাবেরা নামের আরেক নারী। গত মার্চ মাসে তিনি ছয় শিশু সন্তান সাথে করে পালিয়ে এসেছেন।
সাবেরা জানান, প্রায় চার মাস ধরে বুচিডং থেকে পায়ে হেঁটে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন। এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে মানুষের সাহায্য নিয়ে নিয়ে তিনি পালিয়ে আসেন।
তিনি বলেন, ‘তিন চার মাইল করে হেঁটেছি। চার পাঁচ মাস লেগেছে। মানুষের সাহায্য নিয়ে নিয়ে এসেছি।’
সাবেরা বলেন, ‘কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থাকা খাওয়ার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু তারপরও এটাই তিনি ও তার সন্তানদের জন্য নিরাপদ।’
তিনি বলেন, ‘বুচিডংয়ে বোমায় আমার মা, স্বামী, এক ছেলে মারা গেছে। কাজ নাই। মগের কারণে কাজ করা যায় না। মগেরা মারধর করে। কারো কাছে সাহায্য নেব সে অবস্থাও নেই। তাই কষ্ট করে চলে এসেছি।’
রোহিঙ্গারা এখন কেন নিজ দেশে থাকতে পারছেন না সেই প্রশ্ন করেছিলাম বুচিডং থেকে আসা মাদরাসাশিক্ষক মকবুল আহমেদকে। তিনি নয় সদস্যের পরিবার নিয়ে শরণার্থী হয়েছেন বাংলাদেশে। মিয়ানমার আর্মি এবং আরসা সদস্যদের সহযোগিতার অভিযোগ তুলে সেখানে রোহিঙ্গাদের ব্যাপক নির্যাতন করা হচ্ছে বলে তিনি দাবি করেন।
তিনি বলেন, ‘আরসার কাছে ওষুধ বিক্রি করেছিস? ভাত খাইয়েছিস? তোরাও আরসার সমর্থক। এসব মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে তারা আমার বাড়ি নিয়েছে। বিরাট ওষুধের দোকান দখলে নিয়েছে।’
মকবুল আহমেদ জানান, গত মার্চে রোজার সময় তারা তিন শ’ রোহিঙ্গা একসাথে বাংলাদেশে ঢুকেছিলেন। তার পরিবারের বাকি আটজন সদস্য আসেন তার দু’ দিন পর। রোহিঙ্গাদের নতুন করে আসার পেছনে রাখাইনে নিত্যপণ্যের মারাত্মক সঙ্কট একটা বড় কারণ বলে উল্লেখ করেন তিনি।
মকবুল আহমেদ বলেন, ‘খাদ্য সঙ্কটের কারণে নিত্যপণ্যের দাম আকাশচুম্বী।’
তিনি বলেন, ‘না ওষুধ আছে, না ডাক্তার আছে, না খাদ্য আছে। আমি দেখেছি এক বস্তা চাল বার্মা টাকায় এক লাখ টাকায় বিক্রি হয়। দু’ কেজি পিঁয়াজ ৭০ হাজার, এক লিটার তেল বিশ হাজার। মরিচ এক কেজি আশি থেকে এক লাখ বার্মা টাকা। এই সঙ্কটে কী করে থাকবে? রোহিঙ্গাদের পক্ষে সেখানে থাকা সম্ভব না।’
উখিয়ায় রোহিঙ্গাদের একটি ক্যাম্পের মাঝি মোহাম্মদ রফিক। তিনি এসেছেন ২০১৭ সালে। তিনি বলেন, ‘তার ক্যাম্পেই এক হাজারের বেশি নতুন পরিবার যুক্ত হয়েছে গত এক বছরে।’ কেন নতুন করে এই রোহিঙ্গাদের আসাটা বেড়ে গেল সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘রাখাইনে বসবাসের অবস্থা নেই। সব মিয়ানমার সরকার নয় আরাকান আর্মি সব নিয়ন্ত্রণ করছে।’
তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গা যারা আছে, তারা নিরাপদ নয়। বিশ বছরের ছেলে দেখলে তাদের দলে নিয়ে যায়। মিয়ানমার আর্মির সাথে যুদ্ধ করার সময় তাকে সামনে দিয়ে দেয়। সেখানে মারা যাচ্ছে। অথবা বিরুদ্ধে কোনো কথা বললে তারা মেরে ফেলতেছে। মা বোনদের মধ্যে দেখতে ভালো লাগলে তাকে তুলে নিয়ে ইজ্জত ধ্বংস করে। নিজ বাড়িতে থাকতে পারতেছে না। আরাকান আর্মি যেখানে চায় সেখানে থাকতে হচ্ছে। পশুপাখির মতো পাহাড় জঙ্গলে রাখা হচ্ছে বলেও জানা যাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘আরসা নামে একটা সংগঠন আছে এটা মিথ্যা না। তারা রোহিঙ্গার পক্ষে দাঁড়ায়। ওখানে তারা মেহনত করতেছে। তাদের আত্মীয় স্বজন থাকতে পারে। ওখানে যে গ্রাম আছে সেখানে তাদের আত্মীয়-স্বজন থাকতে পারে। খাওয়া দাওয়া করতে হয়। আরসার সহযোগী হিসেবে অভিযোগ এনে নির্যাতন করে। যারা আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে কথা বলে তাদের অভিযুক্ত করে নির্যাতন করে।’
উদ্বেগ কোথায়?
নতুন আসা রোহিঙ্গারা জানান, নাফ নদীর বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে গোপনে তারা নৌকায় পার হয়ে বাংলাদেশে ঢুকছে। টেকনাফ, সেন্টমার্টিন ঘুরে শাহপরীর দ্বীপসহ বিভিন্ন জায়গা দিয়ে লুকিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিচ্ছেন রোহিঙ্গারা।
বাংলাদেশ অন্তর্বর্তী সরকার শুরুতেই আর কোনো রোহিঙ্গা আশ্রয় না দেয়ার নীতিগত অবস্থান ঘোষণা করেছিল কিন্তু রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ থামানো যায়নি। এছাড়া গত আট বছর ধরে থাকার পরেও প্রত্যাবাসনের কোনো অগ্রগতি নেই। সবমিলিয়ে নতুন অনুপ্রবেশ এবং সার্বিক রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে স্থানীয়রা বাংলাদেশীদের।
বাস্তবতা হলো, প্রত্যাবাসনের বিষয়টি বর্তমান পরিস্থিতিতে অসম্ভব বলেই অনেকে মনে করছেন। অন্যদিকে, নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বেড়েছে বলেও স্থানীয় বাংলাদেশী নাগরিকদের দৃষ্টিগোচর হচ্ছে।
কক্সবাজারের নতুন অনুপ্রবেশ এবং সার্বিক রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে হতাশা এবং উদ্বেগ বাড়ছে স্থানীয়রা বাংলাদেশীদের।
কক্সবাজার উখিয়ায় স্থানীয় নাগরিকদের অধিকার বাস্তবায়ন কমিটি নামের একটি সংগঠনের সভাপতি রবিউল হোসাইন আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের কারণে মাদকসহ নানা অপরাধ বাড়ছে। এছাড়া অনেকেই ক্যাম্পের বাইরে বাসা ভাড়া করে বসবাস করছে। ক্যাম্পের বাইরে থাকা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা পঞ্চাশ হাজারের কাছাকাছি বলেও ধারণা করছে অধিকার বাস্তবায়ন কমিটি।’
তিনি বলেন, ‘যখন প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা আসছে তখনই রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বেড়েই যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে মিয়ানমারে কোনো রোহিঙ্গা অবশিষ্ট থাকবে না যদি আমাদের সীমান্তে কঠোর নিরাপত্তা বলয় নিশ্চিত করা না যায়। প্রতি মাসে পাঁচ-ছয় হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করছে।’
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জানান, নতুন রোহিঙ্গাদের বায়োমেট্রিক নিবন্ধন চলছে। অনেকেই নিবন্ধনের অপেক্ষায় আছেন। গড়ে প্রতিদিন ২০-৩০ জন এখনো বাংলাদেশে ঢুকছেন বলে তারা শুনছেন।’
তিনি বলেন, ‘ওইখানে মূলত রোহিঙ্গারা মাঝখানে পড়েছে। আরাকান আর্মি যখন মংডু দখল নেয়ার চেষ্টা করে আক্রমণটা চূড়ান্ত পর্যায় পৌছে তখন রোহিঙ্গাদের আগমনটা বেড়ে যায়। এটা মে জুন মাসে বেড়ে যায় এরপর জুলাই আগস্ট সেপ্টেম্বরে আরো বেশি আসে। বিশেষ করে আমাদের সীমান্তে যখন কিছুটা শিথিলতা দেখা দেয় যখন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশকে (বিজিবি) আইন শৃঙ্খলার জন্য বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয় সে সময়টাতে অনেক লোক ঢুকে পড়ে।’
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রশ্নে এবার মিয়ানমার সরকারের পাশাপাশি আরাকান আর্মির সাথেও যোগাযোগের চেষ্টা চলছে বলে ইঙ্গিত দিচ্ছে বাংলাদেশ। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘সরকারে নিশ্চয়ই যারা ঢাকায় এগুলো ডিল করছেন তারা চেষ্টা করছেন যে নন স্টেট ফ্যাক্টর যারা আছেন ফিল্ডে তাদের সাথে যোগাযোগ করতে। যদিও ফরম্যালি সেটা হয়নি তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট যারা আছেন তারা চেষ্টা করছেন। আমাদের টার্গেটটাই হচ্ছে প্রত্যাবাসন সুতরাং যেকোনো ফ্যাক্টরই থাকুক না কেন ফিল্ডে তাদের সাথে আমাদের যোগাযোগ রক্ষা করতে হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘একটি মানুষকেও প্রত্যাবাসনে নিতে পারিনি। আমাদের কাছে প্রত্যাবাসন ছাড়া বিকল্প নেই। সরকার গুরুত্বসহকারে এগুচ্ছে। যদিও মানুষজন এখনো আসছে। পরিস্থিতি ওই পাড়ে প্রত্যাবাসনের জন্য সহায়ক না। সরকার নেপিডো কর্তৃপক্ষের সাথে কাজ করছে।’
জাতিসঙ্ঘ কী বলছে
২০১৭ সালে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকে পড়ার পর কক্সাবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে ৩৩টি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। সরকারি হিসাবে এসব ক্যাম্পে দশ লাখের বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে।
জাতিসঙ্ঘ শরণার্থী সংস্থা জানাচ্ছে নতুন পুরোনো মিলিয়ে রোহিঙ্গাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করা কঠিন হচ্ছে। তবে এসব রোহিঙ্গাদে নিজ দেখে ফেরত পাঠানোর মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।
কক্সবাজারে অবস্থিত ইউএনএইচসিআর’র মুখপাত্র শারি নিজমান বলেন, ‘সেখানে মানবিক সঙ্কট এবং নিরাপত্তার অভাবেই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসছে। বর্তমান পরিস্থিতি প্রত্যাবাসনের অনুকূল নয় বলেও তিনি উল্লেখ করেন।’
তিনি বলেন, ‘তাদের দেশত্যাগের কারণ আছে। নিরাপত্তার জন্যেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এসে শরণার্থী শিবিরে তারা এই পরিস্থিতির মধ্যে বাস করছেন। এর অর্থ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বর্তমান পরিস্থিতি তাদের ফেরার জন্য মোটেও অনুকূল নয়। সেখানে তারা নিরাপদ নয়, সম্মানের সাথে বেঁচে থাকার অবস্থা নেই, মৌলিক চাহিদা পূরণের সুযোগ নেই, চলাফেরার স্বাধীনতা নেই। যত দিন পর্যন্ত এই পরিস্থিতির উন্নতি হবে সেখানে তাদের ফেরার জন্য উপযুক্ত নয়।’ বিবিসি