চব্বিশের কোটা বিরোধী আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিয়েছে দেশের সকল মানুষ ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কারণে। দেশের প্রায় প্রতিটি নাগরিকই নিজ নিজ অবস্থান ও সক্ষমতা অনুযায়ী এ আন্দোলনে কোনো না কোনোভাবে অবদান রেখেছেন। কেউ ছিলেন সরাসরি রাজপথে, সক্রিয়ভাবে নেতৃত্ব দিয়ে ও অংশ নিয়ে। আবার কেউ কেউ থেকেছেন নেপথ্যে—দেয়ালে গ্রাফিতি এঁকে, আন্দোলনের পক্ষে গান-কবিতা রচনা করে, কিংবা আন্দোলনকারীদের খাবার-পানীয় ও সাহায্য-সহযোগিতা দিয়ে।
তবে এই দুইভাবেই, অর্থাৎ প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ উভয় ভূমিকায় একসাথে অবদান রেখেছেন নুরুল কুরআন একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক এবং জামিয়াতুল উস্তায শহীদুল্লাহ ফজলুল বারির সিনিয়র শিক্ষক আবদুল্লাহ আল মাসউদ।
মাঠে নেমে আন্দোলনে সরব থাকার পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখালেখির মাধ্যমে তিনি আন্দোলনের পক্ষাবলম্বন করে অভ্যুত্থানে গভীর প্রভাব রেখেছেন।
আন্দোলনের বর্ষপূর্তিতে নয়া দিগন্ত অনলাইনের সাথে একান্ত আলাপে তিনি স্মৃতিচারণ করেছেন আন্দোলনের নানা অভিজ্ঞতার। যেখানে উঠে এসেছে কওমি ছাত্র-শিক্ষকদের সাহস, আত্মত্যাগ ও দেশপ্রেমের অনন্য ও উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

নয়া দিগন্ত : জুলাই অভ্যুত্থানে কওমি মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকের অংশগ্রহণ ছিল অত্যন্ত লক্ষণীয়। আপনি কিভাবে এর সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন?
আবদুল্লাহ আল মাসউদ : জুলাই গণঅভ্যুত্থানে মাদরাসার ছাত্র শিক্ষকদের অংশগ্রহণটা একদিনেই হয়নি, ধীরে ধীরে এটা বেড়েছে। শেখ হাসিনার পতনের দাবি যত বেশি জোরালো হয়েছে, মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদের সম্পৃক্ততা তত বেড়েছে। যদিও হাসিনার পতনের দাবির আগ থেকেও ছাত্র-শিক্ষকদের মোটামুটি একটা অংশ এই আন্দোলনের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিল, আর বাকিরা তাদেরকে যার যার অবস্থান থেকেই সমর্থন জানিয়েছেন, আন্দোলনের সাথে একাত্মতা পোষণ করেছেন। প্রচুর সংখ্যক একটিভিস্ট আলেম আন্দোলনের পক্ষে জনগণের সম্মতি উৎপাদনে অনলাইনে লেখালেখি করেছেন। ১৮ জুলাই প্রভাবশালী তরুণ আলেমদের একটি দল সম্মিলিত বিবৃতি প্রদানের মাধ্যমে ছাত্রদের কোটা বিরোধী আন্দোলনে নিজেদের সমর্থনের কথা ব্যক্ত করেন, যা অনেক বড় এবং সুস্পষ্ট একটি দলিল।
আমি ব্যক্তিগতভাবে আন্দোলনের সাথে সরাসরি যুক্ত হই ১৮ জুলাই। বসিলা ব্রিজের ওদিকে কোনো এক দরকারে গিয়েছিলাম। দেখলাম রাস্তা ব্লক করা। কোনো গাড়ি চলছে না। ছাত্ররা রাস্তা অবরোধ করে রেখেছেন। আমি আর বাসায় যাইনি। তাদের সাথেই সেই আন্দোলনে অংশ নিই এবং তপ্ত গরম-রোদ উপেক্ষা করে ছাত্রদের সেই আন্দোলন সফল করার ক্ষেত্রে সাধ্যমতো ভূমিকা রাখার চেষ্টা করি। সেদিন আমরা আন্দোলনকারীদেরকে পানি এবং খাবার সরবরাহ করার মাধ্যমে খেদমত আঞ্জাম দিয়েছিলাম। মূলত এটাই ছিল আমার আন্দোলনের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত হওয়ার প্রথম দিন। তারপর তো দিন যত গড়িয়েছে, এই আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ততা আরো গভীর হয়েছে।
নয়া দিগন্ত : মাঠপর্যায়ে আপনার প্রত্যক্ষ ভূমিকা ও অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাই! আর আপনার এই অংশগ্রহণকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করেন?
আবদুল্লাহ আল মাসউদ : ছাত্রদের কোটা বিরোধী আন্দোলনের সাথে আমাদের সমর্থন শুরু থেকেই ছিল। যদিও সরকারি চাকরির সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক ছিল না। সরকারিভাবে কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীরা শুরু থেকেই বৈষম্যের শিকার। তাদের জন্য সরকারিভাবে কোনো চাকরির সুযোগ রাখা হয়নি। নামকাওয়াস্তে একটি স্বীকৃতি দেয়া হলেও এর বাস্তব কার্যকারিতা নেই। তারপরও ইসলামের শিক্ষা, উস্তাদদের দীক্ষা আর আমাদের দেওবন্দী উলামায়ে কেরামের যেই দীর্ঘ সিলসিলা আছে অন্যায়ের বিপক্ষে প্রতিবাদ করার এবং হাদিসের যে শিক্ষা আছে অন্যায়কারীকে অন্যায় থেকে বাধা দেয়ার, সেই চেতনা থেকেই মূলত আন্দোলনের সাথে আমার সম্পৃক্ততা।
আন্দোলনে ভূমিকার কথা যদি বলতে হয়- তাহলে আমরা মূলত রাস্তা ব্লক করে রাখা আন্দোলনকারীদেরকে বিভিন্ন সহায়তা দেয়া, যেমন- খাবার-পানি সরবরাহ, মাস্ক সরবরাহ, রাস্তা অবরোধে সহায়তা, বিভিন্ন জায়গায় দেয়াল লিখন ইত্যাদি কাজগুলো করেছি। তবে, এর বাইরে আমি ব্যক্তিগতভাবে আরেকটি বিষয়ে মনোযোগ দিয়ে করার চেষ্টা করেছি। সেটা হচ্ছে, এই ধরনের বড় আন্দোলনগুলোতে সাধারণত কিছু বিশৃঙ্খলা হয়। যেহেতু আন্দোলনে নানান উদ্দেশ্য নিয়ে মানুষজন জড়ো হয়। আমি লক্ষ্য রাখতাম নিরপরাধ কোনো মানুষ ও তাদের সম্পদ যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। পুরো আন্দোলন জুড়ে এই বিষয়ে আমি বিশেষভাবে সচেষ্ট ছিলাম। উদাহরণস্বরূপ একটা ঘটনা বলি। একদিন শুক্রবার সকালে একজন লোক তার দুই মেয়েকে নিয়ে সম্ভবত কোথাও যাওয়ার জন্য নিজস্ব গাড়ি নিয়ে বের হয়েছেন। তখন সর্বাত্মক অবরোধ চলছে। তিনি বেড়িবাঁধ মোড়ে আসার পর কিছু ছেলে তার গাড়ি ঘিরে ধরে। তারা বারবার বলতে থাকে- আপনি তো জানেন অবরোধ চলছে তাও কেন গাড়ি নিয়ে এলেন? তাদের সবার হাতে ছিল লাঠি। পারলে তখনই সেই গাড়ির গ্লাস ভেঙে দেয় দেয় অবস্থা। আমি চেষ্টা করেছি ছেলেগুলোকে বুঝিয়ে নিবৃত করার। যদিও শেষ পর্যন্ত ড্রাইভার যখন গাড়ি ঘুরিয়ে উল্টো পথে চলে যাচ্ছিল, দুয়েকজন পেছন থেকে এক দুইটা বাড়ি দিয়েছিল। কিন্তু এতে বড় ধরনের কোনো ক্ষতি হয়নি। এই বাধাটুকু না দিলে শঙ্কা ছিল তারা তখন তার গাড়ি ভেঙে তছনছ করে দিত। কারণ, সবার মধ্যে তখন প্রচণ্ড ক্ষোভ কাজ করছিল। এমন আরো অনেকগুলো ঘটনা আছে। সবসময় এই ধরনের ঘটনাগুলো সামলানো সম্ভব হয়নি, যেহেতু অনেক বড় এরিয়া। তারপরও যতটুকু সাধ্যের মধ্যে ছিল আমরা চেষ্টা করেছি। আর ৪ আগস্ট রাতে আমরা একটা মেডিক্যাল টিম গঠন করেছিলাম। সেখানে ফার্মেসি থেকে প্রাইমারি চিকিৎসার যে সমস্ত জিনিসপত্র দরকার, তার বড় এক বস্তা সংগ্রহ করে আমরা প্রস্তুত ছিলাম। পরের দিন ৫ আগস্ট যদি রক্তক্ষয়ী কোনো সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে, তখন যেন প্রাইমারি চিকিৎসা প্রদান করা সম্ভব হয়। যদিও আমাদের মোহাম্মদপুর এলাকায় সেই ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি, তার আগেই শেখ হাসিনা পলায়ন করেন।
নয়া দিগন্ত : অভ্যুত্থানে শুধু কওমি অঙ্গনেই অন্তত ৪২ জন শহীদ হয়েছেন, তাদের এই ত্যাগের বিনিময় কি আপনারা পেয়েছেন এবং তাদের স্মরণে ও সম্মানে কী পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন?
আবদুল্লাহ আল মাসউদ : কওমি অঙ্গনে ৪২ জন শহীদের কথা তো আপনি বললেন। কিন্তু কোনো কোনো অনুসন্ধানে সংখ্যাটা এর চেয়েও আরো বেশি। সংখ্যাটা যাই হোক না কেন, মূল বিষয় হচ্ছে এই ত্যাগের বিনিময়ে আমরা আসলে কিছুই পাইনি আলাদাভাবে; বরং মাদরাসা শিক্ষার্থীদের সাথে যেই ধরনের বৈষম্য হয়ে আসছিল, স্বৈরাচারের পতনের পরও সেই ধরনের বৈষম্যগুলো আপন জায়গায় রয়ে গেছে। শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের দাবি কওমি সনদের স্বীকৃতির কার্যকর বাস্তবায়ন হয়নি। ছাত্রদের উচ্চ শিক্ষার জন্য ইউনিভার্সিটিতে বা বিদেশের মাটিতে পড়তে যাওয়া অথবা চাকরি-বাকরির ক্ষেত্রে সুবিধার দরজাগুলো আজও বন্ধ রাখা হয়েছে। এই বিষয়ে কোনো ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। জুলাই সনদে ২০১৩ সালে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার যে অবদান, সেটাকে পাশ কেটে যাওয়া হয়েছে। ২০২১ সালে মোদি বিরোধী আন্দোলনে তারা রক্ত দিয়েছে। বাংলাদেশকে ভারতীয় আধিপত্যবাদ থেকে মুক্ত করার ক্ষেত্রে তাদের রক্তের অনেক ঋণ আছে। কেননা, শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রেখেছিল প্রতিবেশী দেশের সহায়তা। এগুলোর বিরুদ্ধে বারবার গর্জে উঠেছে মাদরাসার শিক্ষার্থীরা। কিন্তু নতুন রাষ্ট্র এগুলোর কোনো কিছুকেই স্বীকার করেনি। এখনো আগের মতোই রয়ে গেছে সবকিছু। এটা তো গেল রাষ্ট্রের দায়ের কথা। এর পাশাপাশি আমরা নিজেরাও, আমরা বলতে এখানে কওমি মাদরাসার যারা অথরিটি আছেন তাদের কথা বলছি, তারাও কিন্তু এই শহীদদের স্মরণে কিংবা সম্মানে উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন বলে আমাদের জানা নেই। আলাদা করে তাদের জন্য কোনো আয়োজন করা, তাদেরকে কেন্দ্র করে কোনো উদ্যোগ নেয়া, শহীদ পরিবারগুলোর খোঁজখবর নেয়া বা শহীদদের অবদানের কথা মাদরাসার পাঠ্যপুস্তকে তুলে ধরার মতন কোনো উদ্যোগের কথা আমরা জানতে পাইনি বা শুনতে পাইনি এখন পর্যন্ত। ফলে আমাদের বিড়ম্বনার গল্পটা আসলে অনেক বেশি দীর্ঘ। অন্যরা মূল্যায়ন করছে না সেটা নিয়ে তো আমাদের দুঃখ আছেই, কিন্তু নিজ ঘরেই আমরা আসলে কতটুকু মূল্যায়িত সেটা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়।
নয়া দিগন্ত : রাজনৈতিক কোনো ব্যানারের বাইরে গণঅভ্যুত্থানে কওমি আলেমদের এই যে বৃহৎ অংশগ্রহণ, তাতে দেশের মানুষের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা ও মূল্যায়ন বৃদ্ধি পেয়েছে নাকি অবনতি হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
আবদুল্লাহ আল মাসউদ : অবশ্যই। ছাত্রদের যেই বৃহৎ অংশগ্রহণ ছিল, এর ফলে দেশের মানুষের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা এবং মূল্যায়ন বৃদ্ধি পেয়েছে। অবনতি হওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। কারণ, মাদরাসা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার পেছনে তাদের নিজেদের কোনো স্বার্থ ছিল না। এই আন্দোলন শুরু হয়েছে যেই কোটাকে কেন্দ্র করে, যার সাথে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের স্বার্থের কোনো সম্পর্ক নেই। তারপরও তারা শুরু থেকেই এর সাথে একাত্মতা পোষণ করে এসেছিল এবং তাদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল। স্বৈরাচারের পতনের পর যেই নতুন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে এবং মানুষ যেই স্বাধীনতা ভোগ করছে সেটার পেছনে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের অবদানকে অস্বীকারের কোনো উপায় নেই। ফলে এটা অবশ্যই তাদের ভাবমূর্তিকে মানুষের সামনে উজ্জ্বল করেছে। তাদের এই অবদানের কথাগুলো যদিও সরকারিভাবে সেভাবে স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে না, কিন্তু মানুষের কাছে ইতিহাসের চিত্রগুলো সুস্পষ্ট থাকার কারণে তারা ঠিকই মাদরাসা শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের কথা বলছে এবং স্বীকার করে নিচ্ছে। কারণ, তারা দেখেছে তাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মাদরাসা শিক্ষার্থীরা ময়দানে নেমে এসেছিল। রাষ্ট্রের কর্তা ব্যক্তিরা, যারা তাদেরকে অবহেলা করছে, তাদের অধিকাংশই এই আন্দোলনের সাথে সরাসরি মাঠে সম্পৃক্ত ছিলেন না। ফলে হয়তো তাদের চোখে এটা সেভাবে ধরা পড়েনি কিংবা ধরা পড়লেও তারা আসলে চায় না যে মাদরাসা শিক্ষার্থীরা রাষ্ট্রীয়ভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠুক, তাদের প্রভাব সমাজে বিস্তার লাভ করুক। ফলে যত অবদানই থাকুক না কেন কিভাবে তাদেরকে অবদমিত করে রাখা যায় এটাই হচ্ছে তাদের পলিসির অংশ। এই জায়গা থেকে বলা যায়, তারা আমাদেরকে যথাযোগ্য স্বীকৃতি দেবে না এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু শিক্ষার্থীরা সাধারণ মানুষদের ভালোবাসা এবং সম্মান পাচ্ছে। এই পাওয়াটাও কিন্তু একেবারে ছোট নয়।

নয়া দিগন্ত : আন্দোলনের সময় রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন, গ্রেফতার, নির্যাতন ইত্যাদি নিয়ে কী ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে আপনাদের?
আবদুল্লাহ আল মাসউদ : আন্দোলনের সময় রাষ্ট্র তার যতগুলো বাহিনী আছে, যত ধরনের শক্তি আছে এর পুরোটুকুই ব্যয় করেছে সাধারণ নিরস্ত্র নাগরিকদেরকে দমন করার জন্য। কেমন যেন নিজ দেশের জনগণের বিরুদ্ধেই তারা যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। ব্যক্তিগতভাবে আমি যেহেতু সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক সরব ছিলাম, ফলে আমার নিজের ব্যাপারে একটা শঙ্কা ছিল যে কোনো মুহূর্তে গ্রেফতার হওয়ার। যখন সারা দেশে কারফিউ চলছিল তখন মোহাম্মদপুরে বিভিন্ন এলাকায় রেড দিয়ে প্রশাসনের লোকেরা আন্দোলনকারীদেরকে দমন করার কৌশল অবলম্বন করেছিল। সেই সময়টাতে একটা গ্রেফতার আতঙ্ক আমার মধ্যে কাজ করতো। তবে এর মাত্রা এতটুকু ছিল না, যা আন্দোলন থেকে পেছনের দিকে টেনে নিয়ে যাবে বা মুখ বন্ধ রাখতে বাধ্য করবে। কোনো কোনো রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়েছিলাম। বাঁশির শব্দ শুনলে দৌড়ে গিয়ে বারান্দা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখতাম। না জানি পুলিশের কোনো গাড়ি চলে আসলো কিনা! তবে আমি মাঠে প্যান্ট এবং গেঞ্জি পরে ও মুখে মাস্ক লাগিয়ে যেতাম অধিকাংশ সময়ে। যাতে করে সহজে কেউ পরিচয় শনাক্ত করতে না পারে। একবার ছাত্রলীগের ধাওয়ার মুখোমুখি হয়েছিলাম। তারা লাঠি দিয়ে মারতে উদ্যত হয়েছিল। আমি কোনোমতে অন্য আরেক গলি দিয়ে দৌঁড়ে এসে নিরাপদ আশ্রয় গ্রহণ করেছিলাম। এই ধরনের নানান মানসিক তিক্ত অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে আমাদেরকে যেতে হয়েছে। মুহাম্মদপুরে হেলিকপ্টার থেকে যখন গুলি করা হচ্ছিল তখন আমি বেড়িবাঁধের মোড়ে। সুস্পষ্টভাবে দেখছিলাম হেলিকপ্টারের খোলা দরজা দিয়ে বন্দুক তাক করা একজন র্যা ব সদস্য টিয়ারশেল ছুড়ে এবং গুলি করে আন্দোলনকারীদেরকে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করছিলেন। আমরা দৌড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাই। সেদিন সন্ধ্যায় বসিলা ব্রিজের গোড়ায় ব্যাপক সংঘর্ষ হয় এবং র্যা বের গুলিতে বেশ কয়েকজন নিহত হন। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি গ্রেফতার এড়িয়ে চলতে সক্ষম হওয়ায় নির্যাতনের শিকার হওয়া থেকে রক্ষা পাই।
নয়া দিগন্ত : আন্দোলনে অংশগ্রহণের পেছনে কওমি ছাত্র-শিক্ষকদের নৈতিক ও আদর্শিক প্রেরণা কী ছিল? তারা কেন এই অভ্যুত্থানের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করলেন?
আবদুল্লাহ আল মাসউদ : কওমি মাদরাসার ছাত্র শিক্ষকদের একটি ঐতিহাসিক সিলসিলা আছে। যেই সিলসিলাতে অন্যায়ের বিপক্ষে দাঁড়ানো ও মজলুমের পক্ষে কথা বলার চেতনা গভীর থেকে প্রথিত আছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই দেখবেন কওমি মাদরাসার ছাত্ররা যেকোনো অন্যায়ের বিপক্ষে, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে অথবা কওমের স্বার্থের ব্যাপারে সর্বাগ্রে মাঠে নেমে আসে। এটা মূলত কওমি মাদরাসাগুলোর শিক্ষাধারার যে প্রাচীন সিলসিলা, সেই সিলসিলারই একটি চেতনা। যেটা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের দুই শ’ বছরের সময়কালের ভেতর দিয়ে প্রজন্ম পরম্পরায় প্রবাহিত হয়েছে। এর পাশাপাশি যেহেতু তারা ধর্মীয় দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে থাকে আর ইসলাম ধর্ম সবসময় ন্যায়ের পক্ষে এবং অন্যায়ের বিপক্ষে থাকার কথা বলে, এমনকি মানুষকে যেকোনো ধরনের কষ্ট থেকে মুক্ত করাকে ঈমানের অন্যতম শাখা বলে শেখায়, ফলে এই শিক্ষাগুলো তাদেরকে মূলত এই আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে ছিল। হাদিসের মধ্যে বলা হয়েছে, তুমি তোমার ভাইকে সাহায্য করো। চাই সে জালেম হোক অথবা মজলুম। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করেছিলেন, মজলুমকে সাহায্য করবো এটা তো বুঝে আসে। কিন্তু জালেমকে কিভাবে সাহায্য করবো? তখন নবীজি বলেছিলেন, জালেমকে তার জুলুম থেকে বারণ করার দ্বারা সাহায্য করো। এই দিকগুলো কিন্তু তাদের মন-মগজে এবং মস্তিষ্কের মধ্যে গেঁথে যায়। তারা জুলুমের বিপক্ষে হাতে লাঠি তুলে নিতে কিংবা মাথায় কাফনের কাপড় বেঁধে নিতে দ্বিধা করে না। ১৩ সালের শাপলা চত্বরের ঘটনা এর জ্বলন্ত সাক্ষী। ২১ সালের মোদি বিরোধী আন্দোলনের জলজ্যান্ত ইতিহাস। এতো গেল নৈতিকতার কথা। এর বাইরে একটা ক্ষোভও ছিল কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীদের মনে। যেহেতু শেখ হাসিনার হাতে বহু ভাইদের রক্তের দাগ লেগে আছে, ফলে এই জালিমশাহীকে হটাতে না পারলে শহীদদের আত্মা শান্তি পাবে না- এই ধরনের একটা অনুভূতিও তাদের মধ্যে কাজ করেছে। ফলে দেখবেন এই আন্দোলন কোটার বৈষম্য থেকে সরে গিয়ে যখন আস্তে আস্তে সরকার পতনের দিকে এগিয়েছে, মাদরাসা শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের অংশগ্রহণের মাত্রাও তত বৃদ্ধি পেয়েছে।
নয়া দিগন্ত : আন্দোলন কিভাবে একসাথে পরিচালিত হতো? কেন্দ্র থেকে আপনাদের দিকনির্দেশনা দেয়া হতো কিভাবে? আর এই দিকনির্দেশনাগুলো মাঠপর্যায়ের কর্মীদের কাছেই বা কিভাবে পৌঁছে দিতেন?
আবদুল্লাহ আল মাসউদ : দেখুন, ২৪-এর গণঅভ্যুত্থান কোনো কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অধীনে পরিচালিত হয়নি; বরং প্রত্যেকটা এলাকায় মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যার যার মতো করে আন্দোলন করেছেন। কিছু কিছু জায়গায় দলীয় নেতাকর্মী যারা ছিলেন, তারা তাদের মধ্যে এক ধরনের যোগাযোগ রক্ষা করে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন সত্য। তার মানে কিন্তু এই না যে, আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সবাই কেন্দ্রীয় কোনো নির্দেশনা মেনে আন্দোলন করতেন। আমরা যারা কোনো দলের সাথে সম্পৃক্ত না, আমরা কিন্তু কেন্দ্রীয় কোনো নির্দেশনা ছাড়াই যে যার মতন করে মাঠে নামতাম। কেন্দ্রীয় নির্দেশনা বলতে শুধু এতোটুকু যে, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা কী কর্মসূচি দিচ্ছেন- এটা সংবাদমাধ্যম মারফত জেনে নিতাম। এর বাইরে বিভিন্ন এলাকাতে কোন জায়গায় কিভাবে আন্দোলন পরিচালিত হবে এই জাতীয় নির্দেশনা সরাসরি আমাদের কাছে আসতো না; বরং আমরা আমাদের মতো করেই মাঠে নেমে আসতাম। নিজেদের মতো করেই রাস্তা ব্লক করা, পুলিশের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এবং আন্দোলনকে সফল করার জন্য যা যা করা দরকার সেটা করতাম। এই কারণেই কিন্তু মূলত এই আন্দোলন সফল হয়েছে। যদি পুরো আন্দোলন কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অধীনে থেকে পরিচালিত হতো তাহলে মনে হয় না শেখ হাসিনাকে হটানো এতটা সহজ হতো। এমনটা হলে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান হতো না। সবাই ধরে নিত এটা অমুক দলের আন্দোলন, ফলে অন্য দলের নেতাকর্মীরা পিছিয়ে আসতেন।
নয়া দিগন্ত : কওমি অঙ্গনের মধ্যে বিভিন্ন মত ও সংগঠন থাকা সত্ত্বেও এই অভ্যুত্থানে ঐক্য দেখা গেছে। এর পেছনে মূল ঐক্যসূত্র কী ছিল?
আবদুল্লাহ আল মাসউদ : জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শুধু কওমি অঙ্গনে নয়; বরং কওমি অঙ্গনের বাইরেও বাংলাদেশের যেই বিশাল জনগোষ্ঠী আছে, যাদের মধ্যে আবার নানান রাজনৈতিক বিভক্তি আছে, আদর্শগত দ্বন্দ্ব আছে, তাদের মধ্যেও ঐক্য ছিল। এর পেছনে মূল কারণ হলো সবার কমন ফোকাসের জায়গা ছিল স্বৈরাচারকে হটানো। ফলে বিরোধগুলোর দিকে তাকানোর চেয়েও স্বৈরাচার হটানোর দিকে সবার নজর ছিল বেশি। আর আরেকটা বিষয় হচ্ছে যেহেতু এটা কোনো রাজনৈতিক দলের দলীয় ব্যানারে হয়নি, ফলে সবাই এই আন্দোলনের সাথে একাত্ম হতে পেরেছিল। যদি নির্দিষ্ট কোনো দলের ব্যানারে হত তাহলে হয়তো অন্য দলগুলো সেখানে অংশ নিতে স্বচ্ছন্দ্যবোধ করত না। এটাও একটা বড় কারণ বলে আমার মনে হয়। ফলে পারস্পরিক ঐক্যের এই বিষয়টা আসলে শুধু কওমি অঙ্গনের বিভিন্ন সংগঠনের ক্ষেত্রেই না; বরং এটা ব্যাপকভাবে সবার ক্ষেত্রে সমান সত্য। অভ্যুত্থান সফল হওয়ার পরে যেহেতু নানান হিসাব নিকাশের ব্যাপার সামনে চলে এসেছে, ফলে আবারো বিভিন্ন মতবিরোধ মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে এটাই স্বাভাবিক।
নয়া দিগন্ত : ভবিষ্যতের বাংলাদেশ কেমন দেখতে চান? ইসলামী নেতৃত্ব ও কওমি আলেমদের ভূমিকা আপনি কিভাবে কল্পনা করেন?
আবদুল্লাহ আল মাসউদ : ভবিষ্যতের বাংলাদেশ আমরা শোষণমুক্ত ও বৈষম্যহীন দেখতে চাই। যেখানে রাষ্ট্র পরিচালিত হবে ইসলামের নির্দেশিত পন্থায়। ইসলাম যেহেতু কল্যাণের কথা বলে, সমতার কথা বলে, বৈষম্যহীনতার কথা বলে, ফলে ইসলাম যখন রাষ্ট্রীয়ভাবে কায়েম হবে তখনই কেবল পরিপূর্ণভাবে সমতা এবং বৈষম্যহীনতা প্রতিষ্ঠা পাবে। এর আগে পরিপূর্ণভাবে সমতা এবং বৈষম্যহীনতা প্রতিষ্ঠা পাওয়া সম্ভব নয়। এখন যেই খুচরা একটু আধটু সফলতা আমরা দেখছি এটা সাময়িক চিত্র। এই সমস্ত বিষয়ের মাধ্যমে হয়ত বৈষম্য কিছুটা দূর হবে, সমতা কিছুটা আসবে, কিন্তু শতভাগ সফলতা ইসলাম এবং শরীয়ত ছাড়া কখনোই সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে ইসলামী নেতৃত্ব; বিশেষ করে কওমি আলেমদের ব্যাপক ভূমিকা রাখতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। কারণ, তারা জাতির রাহবার এবং এ দেশে ইসলামের ধারক বাহক। তারা মসজিদের মিম্বার-মেহরাব ও মাহফিলের মঞ্চ থেকে ইসলামী শাসনব্যবস্থার সৌন্দর্যের কথা মানুষের সামনে যত বেশি তুলে ধরবেন, তত বেশি মানুষ শরীয়াহ সম্পর্কে জানবে। ইসলামী শরীয়ার আদর্শ-সৌন্দর্য সম্পর্কে অবগত হবে। ইসলামী শরীয়াহ সম্পর্কে তাদের ভুল ধারণাগুলো দূর হবে। এর সুফল সম্পর্কে তাদের আগ্রহ বৃদ্ধি পাবে। এভাবেই গণসচেতনতার মাধ্যমে ধীরে ধীরে মানুষকে শরীয়াহমুখী করে তোলা সম্ভব। যতদিন আলেমরা এই ব্যাপারে উদ্যোগী না হবেন, সচেতন না হবেন, ততদিন পর্যন্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ খুবই ক্ষীণ।