আব্দুল আজিজ

মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছি, নতুন দেশ বিনির্মাণে কাজ করব

অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই ও প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর ছিলেন আগে থেকেই। ২০২৪ সালের কোটা নিয়ে নাটকের শেষ দেখার জন্য নিজের ভেতরে একটা জেদ কাজ করে, সেই জেদ থেকেই আন্দোলনে যোগ নেন আব্দুল আজিজ।

মিজান ফারাবী
আব্দুল আজিজ ভূঁইয়া
আব্দুল আজিজ ভূঁইয়া |সংগৃহীত

আব্দুল আজিজ ভূঁইয়া ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ও কোটা সংস্কার আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়ার মাধ্যমে রাজপথে সরব হন। নেতৃত্ব দিয়েছেন মিছিলের সামনে থেকে। ২০২০ সালেও ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। দেশ ও জনতার ন্যায্য দাবিতে যখনই প্রয়োজন হয়েছে রাজপথে নেমেছেন তিনি।

অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই ও প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর ছিলেন আগে থেকেই। ২০২৪ সালের কোটা নিয়ে নাটকের শেষ দেখার জন্য নিজের ভেতরে একটা জেদ কাজ করে, সেই জেদ থেকেই আন্দোলনে যোগ নেন আব্দুল আজিজ। বর্তমানে ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশের (আপ বাংলাদেশ) কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও জুলাই স্মৃতিবিষয়ক কমিটির প্রধান হিসেবে কাজ করছেন।

চব্বিশের কোটা থেকে শুরু করে জুলাইয়ের রাজপথে নয়া বন্দোবস্তের আন্দোলনে সরব ছিলেন তিনি। একটি বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশের স্বপ্নে ঝাঁপিয়ে পড়েন আন্দোলনে। হয়ে উঠেন তারুণ্যের কণ্ঠস্বর। জুলাইয়ে সামনে থেকে দেখেছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে তরুণ প্রজন্মের বাঁধ ভাঙা জোয়ার।

পুলিশের গুলি উপেক্ষা করে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছেন উত্তাল আন্দোলনের দিনে। সহযোদ্ধাদের নিঃস্বার্থ সেবা ও ডাক্তারদের একান্ত প্রচেষ্টায় তিনি ফিরে এসেছেন মৃত্যুর দুয়ার থেকে। এখনো তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে সহযোদ্ধাদের রক্তাক্ত মুখ ও শহীদদের ছবি।

সম্প্রতি দৈনিক নয়া দিগন্ত অনলাইনের সাথে এক সাক্ষাৎকারে রক্তাক্ত দিনের স্মৃতি জানালেন জুলাই আন্দোলনের এই যোদ্ধা। বলেছেন কীভাবে একটা আন্দোলন তরুণ প্রজন্মের হৃদয়ে দানা বেঁধে উঠেছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে। এক দফা দাবিতে স্রোতের মতো নারী ও পুরুষ নেমেছিল ঢাকার রাজপথে।

নয়া দিগন্ত : জুলাইয়ে সামনের সারিতে থেকে আন্দোলন করলেন, এখন বাংলাদেশকে কেমন দেখছেন?

আব্দুল আজিজ : সত্যিকার অর্থে নতুন বাংলাদেশ কেমন হয় তা নিয়ে বহুদিন ভেবেছি, আগে মনের মধ্যে একটা ফ্যান্টাসি কাজ করতো। হয়তো আমরা মুক্ত হলে এমন এমন দেখবো, বিভিন্ন কাজ করবো। আজ তা নিজ চোখে দেখতে পাচ্ছি, আলহামদুলিল্লাহ। সবচেয়ে বেশি ভালো লাগছে বুক ভরে শ্বাস নিতে পারছি। কোনো ডরভয় নেই। মুক্ত পাখির মতো চলতে পারছি, মন প্রাণ খুলে কথা বলতে পারছি। এখন নিজেকে গোলাম মনে হচ্ছে না। এ যেন এক অনাবিল আনন্দ ও পরম সুখের অনুভূতি, বলে বোঝানো যাবে না।

নয়া দিগন্ত : আন্দোলন কীভাবে শুরু করলেন?

আব্দুল আজিজ : ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ও কোটা সংস্কার আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছি। সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়ার সুযোগ হয়েছিল। তারপর ২০২০ সালে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেই। এগুলোতে সম্পৃক্ত থাকায় দেশের ন্যায্য দাবিতে যখনই প্রয়োজন হয়েছে রাজপথে নেমে এসেছি।

Abdul-Aziz-02

অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করা আমার স্বভাবজাত কাজ হয়ে উঠেছিল। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৪ সালে কোটা নিয়ে নাটকের শেষ দেখার জন্য নিজের ভেতরে একটা জেদ কাজ করে, সেই জেদ থেকেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করি। জুলাই আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছি। অতীতের সকল অভিজ্ঞতা ছাড়িয়ে এ এক অন্যরকম রোমাঞ্চকর ও সাহসী অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে দিন পার করেছি।

নয়া দিগন্ত : জুলাইয়ে অনেক ঘটনার সাক্ষী আপনি নিজেও, যদি আপনার দেখা স্মৃতি বলেন।

আব্দুল আজিজ : আমার নিজের চোখের সামনে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ জন শহীদ হয়েছে। এর মধ্যে একজন শহীদের কথা না বললেই নয়। তিনি স্লোগান দিতে দিতে সামনে এগিয়ে পুলিশের এপিসির ওপরে উঠে যান। পুলিশ তাকে গুলি করে ফেলে দেয় এবং তার গলার উপর দিয়ে এপিসি চালিয়ে নেয়া হয় এবং তার মাথা শরীর থেকে আলাদা হয়ে যায়। এটা এখনো আমার চোখে ভাসে। কত বীভৎস হত্যাযজ্ঞ তারা চালিয়েছে। পরে সেই শহীদের মাথাবিহীন লাশ টঙ্গীর তুরাগ নদীতে ভেসে উঠে।

এছাড়া অনেক শহীদ চোখের সামনে শাহাদাতের অমীয় শুধা পান করেছেন যাদেরকে মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। কয়েকজনকে তো দেখেছি, বুকে গুলি করা হয়েছে। এমন অনেকজনকে আহত দেখেছি রক্তাক্ত অবস্থায় তাদের চেহারা দেখা যাচ্ছিল না, অনেকের জামার রঙ পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল রক্তে।

ওই সময় আমাকেও গুলি করা হয় টার্গেট করে। প্রায় মৃত্যু দুয়ার থেকে ফিরে এসেছি সহযোদ্ধাদের নিঃস্বার্থ সেবায় ও ডাক্তারদের একান্ত প্রচেষ্টায়। আমার চোখের সামনে এখনো ভেসে উঠে কীভাবে আমার সহযোদ্ধাদের হত্যা করা হয়েছে। সহযোদ্ধার রক্তাক্ত মুখ ও শরীর এখনো চোখের সামনে ভাসছে। এগুলো মনে হলে এখনো ট্রমাটাইজ হয়ে যাই। রাতে ঘুমাতে পারি না ঠিক মতো।

নয়া দিগন্ত : আপনি কারো দ্বারা হুমকি পেয়েছেন বা কেউ নজরদারি করেছে এমনটা মনে হয়েছে?

আব্দুল আজিজ : সামনে থেকে কেউ ওভাবে হুমকি দেয়নি। তবে নিশ্চিতভাবেই শুরু থেকে নজরদারিতে ছিলাম এটা মনে হয়। প্রথমে আওয়ামী লীগের থানা ও মহানগর নেতারা নজরদারি করতো এটা বুঝতাম। আমার পেছনে লোক পাঠাতো আমি কী করি, কোথায় যাই এসব জানতে। আমিও সেভাবে কাজ করতাম যাতে আমার অ্যাক্টিভিটি কেউ ধরতে না পারে। এমনকি আমার বাসায়, আমরা কী কথা বলতাম তা আওয়ামী লীগের নেতারা দরজায় কান পেতে শোনার চেষ্টা করতো। এটা আমার মা কয়েকবার দেখেছেন। পরে আমাকে জানান।

এছাড়া গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর হাসপাতালে আমার খোঁজে গার্ড থেকে শুরু করে আয়া, ওয়ার্ডবয় ও নার্সসহ অনেক লোক নিয়োগ করা হয়েছিল। হাসপাতাল পরিবর্তন করে অন্য একটা হাসপাতালে গেলে সেখানে পৌঁছার ১০ মিনিটের মধ্যে পাঁচ থেকে সাতজন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন আমার খোঁজে আসে। তারা জানায়, তথ্য আছে, আমি এখানে আছি। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাকে লুকিয়ে রাখে। অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজি করে আমাকে না পেয়ে চলে যায়। পরে অনেকবার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে এ নিয়ে চাপ সৃষ্টি করে যেন তারা স্বীকার করে আমি এখানে আছি। সেখানে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমার নাম, বাবার নাম, চিকিৎসার কারণ পরিবর্তন করে ভর্তি রেখে চিকিৎসা দেয়। বিভিন্ন সংস্থার লোকজন ও আওয়ামী লীগের লোকজন আমার পরিবারের উপর নজরদারি করেছিল তাই আমার মা তার সন্তানের এই জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণেও আমার পাশে থাকতে পারেনি। ৩৬ জুলাই পর্যন্ত আমার উপর নজরদারি চলেছিল।

নয়া দিগন্ত : আন্দোলনের একপর্যায়ে তো নেট বন্ধ ছিল, ওই সময়ে আন্দোলন কীভাবে এগিয়ে নিলেন?

আব্দুল আজিজ : ইন্টারনেট বন্ধ হবে বা ডাউন করে দিবে এটা আগেই মোটামুটি অনুমান করতে পেরেছিলাম। আমার যে সিমকার্ডগুলো ব্যবহার হতো না সেগুলো চালু করে নেটওয়ার্ক তৈরি করি। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দুই থেকে তিনজন প্রতিনিধি নিয়ে এই নেটওয়ার্ক গঠন হয়। আমরা কোড ও সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহার করতাম। একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কথা বলে রেখে দিতাম যাতে ফোন ট্র্যাক না করতে পারে। চেষ্টা করতাম দ্রুত মূল মেসেজ বা নির্দেশনা দিয়ে দিতে। এভাবেই পুরোটা সময় পার করেছি।

নয়া দিগন্ত : তারুণ্যের যে আশার আন্দোলন তার প্রতিফলন কতটুকু হচ্ছে বলে মনে করেন?

আব্দুল আজিজ : আসলে আমাদের প্রথম মোটিভ ছিল কোটা সংস্কার। কোনোপ্রকার বৈষম্য আমরা মানতে রাজি ছিলাম না। এরপর এই আন্দোলন কমপ্লিট শাটডাউন, ৯ দফা থেকে ১ দফায় রূপ নেয়। যেখানে আমাদের সহযোদ্ধাদের উপর কেন মরণঘাতি বুলেট ব্যবহার করে হত্যা করা হয়েছে তার বিচার ও রাষ্ট্র সংস্কার অন্যতম।

দেখেন, কোটা সংস্কার হলেও আমার মনে হয়, বাকি আকাঙ্খাগুলো এখনো স্বপ্ন। বিচারের কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখছি না। অপরাধীরা এখনো বুক ফুলিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে ঘুরে বেড়ায়, তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে না। সংস্কার সংস্কার খেলা হলেও সব আগের মতো বহাল তবিয়তেই আছে। আহতদের চিকিৎসার অগ্রগতি নাই, তাদের উন্নত চিকিৎসা দেয়ার আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। যাদের বিদেশে নেয়া লাগবে তাদের বিদেশে নিচ্ছে না। এগুলো নিয়ে তালবাহানা চলছে। অথচ পতিতাদের দুই কোটি ১০ লাখ টাকা দেয়া হয় খুশিমনে খরচ করতে, যা তাদের পুনর্বাসনের জন্য না।

আহত অনেকে লাখ লাখ টাকা চিকিৎসা বাবদ খরচ হলে তার খরচের অর্থের ভাউচার সংযুক্ত করে আবেদন করলেও সাত থেকে আট মাস পার হয়ে গেছে কিন্তু সেই অর্থ সরকার ফেরত দিচ্ছে না। ভয়াবহ অর্থকষ্টে তারা দিন অতিবাহিত করছে। বিপ্লবের সম্মুখসারির নেতারাই আজ দুর্নীতি ও অর্থ কেলেঙ্কারিতে যুক্ত হয়ে মানুষের বিশ্বাস ভঙ্গ করছে। ভাই ও বন্ধুবান্ধব নিয়ে দল তৈরি করছে বিপ্লবের শক্তিদের দল নামে, যেখানে প্রকৃত বিপ্লবী ও যোদ্ধাদের স্থান নাই। এজন্য এদের কাছে পুরো জার্নির কোনো গল্প নাই তারা কী হয়েছে কিছু বলতে পারবে না কিন্তু পদ পদবি নিয়ে বিপ্লবী সেজে বসে আছে।

নতুন বন্দোবস্তের কথা বলে তারা পুরোনো বন্দোবস্ত কায়েম করছে। চাঁদাবাজি আর টেন্ডারবাজি তাদের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এখন এসে ক্রেডিটবাজির এক ভয়ঙ্কর খেলা দেখতে পাচ্ছি, যেন তারা ছাত্রশক্তি ভাই-ব্রাদার ছাড়া কেউই ছিল না এই লড়াইয়ে এবং তারাই সর্বেসর্বা। আর আমরা যারা জীবন দিয়েছি, রক্ত দিয়েছি, হাত-পা-চোখ-কানসহ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ বিসর্জন দিয়েছি তারা যেন কিছুই করি নাই ছাত্রশক্তির কেউ না হওয়ায়। এই বিপ্লবকে শেষ করে দেয়ার দায় তাদের নিতেই হবে এবং এজন্য জনগণের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। আজো আমরা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন পাইনি, এই স্বার্থবাদী লোভী নির্লজ্জ গোষ্ঠীর জন্যই।

নয়া দিগন্ত : আন্দোলনের শেষদিকে পরিস্থিতি কী মনে হয়েছে, ৫ আগস্ট (৩৬ জুলাই) কোথায় ছিলেন?

আব্দুল আজিজ : আগের দিন গভীর রাত পর্যন্ত অনলাইনে দীর্ঘক্ষণ প্রস্তুতি মিটিং করার পর সারারাত উত্তেজনায় ঘুম হয়নি। মনে হয়েছে জীবনের দীর্ঘতম রাত পার করেছি তখন। তার উপর সেই রাত ছিল লাইলাতুল গুজবের রাত। সারারাত চলেছে একের পর এক গুজব। সকাল থেকে ঢাকার অবস্থা জানতে চেয়ে যোগাযোগ করতে থাকি। আপডেট একে একে পাচ্ছিলাম, কোথাও পুলিশ ও আর্মি দাঁড়াতে দিচ্ছে না। আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হচ্ছে এবং হত্যা করা হচ্ছে। এর মধ্যে নামলো বৃষ্টি, চিন্তা বেড়ে গেল যে সবাই নামবে তো! দু’রাকাআত নফল নামাজ পড়ে বেরিয়ে পড়লাম।

কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের সামনে অবস্থান নেই। কিছুক্ষণের মধ্যে মানুষ বাড়তে থাকে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ১১টার দিকে গণভবনের উদ্দেশে মার্চ করার কথা থাকলেও সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সাড়ে ১১টার দিকে সবদিক থেকে বেরিয়ে এসে, সকল বাধা মাড়িয়ে এগোতে থাকি। লাখো জনতার ঢল নামে রাজপথে। আমরা মহাখালী গিয়ে নিশ্চিত হই হাসিনা পালিয়েছে। সবাই উচ্ছ্বাস করতে থাকি, একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে কাঁদি। সেজদায় পড়ে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাই। আল্লাহ বিশেষ রহমত দিয়ে আমাদের মুক্ত না করলে আমরা মুক্তি পেতাম না। সেখান থেকে গণভবনে প্রবেশ করি। কত মানুষকে দেখি গণভবনে শুকরানা নামাজ পড়ছে, আল্লাহকে শুকরিয়া জানিয়ে সিজদা করছে। তাদের সাথে আমিও শুকরিয়া জানাতে নামাজে অংশ নেই।

কত মানুষ হাত তুলে আল্লাহর কাছে কাঁদছে। আবার সবাই মুক্তির আনন্দে উল্লাসও করেছে।

গণভবনের ভেতরে প্রবেশ করে অবাক হয়ে যাই। দেশের মানুষকে কষ্টে রেখে কী আরাম আয়েশে ছিল। এসির বাতাস তখনো গায়ে লাগছিল, বড় বড় দুইটা রাজকীয় ডিজাইনের দোলনা, তিন তলা ওঠা-নামার জন্য লিফট। রান্নাঘর যেন একটা মধ্যবিত্ত পরিবারের ফ্ল্যাটের সমান। দামি দামি আসবাব, ওয়াশরুমের ফিটিংস, ফ্রিজ ভর্তি মাংস, নদীর বড় বড় মাছ, বিশাল সাইজের ইলিশ আরো কত কী। অথচ সে পেঁয়াজ ছাড়া তরকারি, কুমড়ো দিয়ে বেগুনি, গোশতের বদলে কাঁঠাল খেতে বলত। আর তিনি এদিকে রাজকীয় জীবন অতিবাহিত করছিলেন।

সন্ধ্যার দিকে গণভবন থেকে বের হই। গণভবনে যতক্ষণ ছিলাম নেটওয়ার্ক ছিল না, বের হয়ে সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের সামনে এসে বসলে নেটওয়ার্ক ফিরে আসে। আমার মা ফোন দিয়ে জানায় উত্তরায় ভয়ঙ্কর গোলাগুলি হচ্ছে এবং আমার কাছের ও পরিচিত অনেকের শাহাদাতের খবর পাই। একে একে অনেকেই ফোন দিতে থাকে। তারা উত্তরার অবস্থা জানাচ্ছিল এবং আমার ফোন বন্ধ পাওয়ায় আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করছিলো সবাই। এমনকি ছয় বছরের শিশুকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে বলে জানতে পারি।

আমাকে তখন উত্তরা যেতে নিষেধ করা হয়। রাত ৮টার দিকে আমি উত্তরা যাই এবং দেখি চারদিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত অবস্থা। উত্তরা পূর্ব থানা জ্বলছে আগুনে। নাকে বারুদের ও টিয়ারগ্যাস এর গন্ধ লাগে। চোখ জ্বালাপোড়া শুরু হয়। এদিকে সারাদিন না খাওয়ায় ও ঔষধ না খাওয়ায় অসুস্থ বোধ করছিলাম। সবাই আমাকে নিরাপদে বাসায় পৌঁছে দেয়। বাসায় ঢোকার আগে দুইজন শহীদের লাশ দেখি ভিন্ন ভিন্ন মহল্লায় জানাজার পর রাখা হয়েছে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছিল এসব দেখে। কত রক্তের বিনিময়ে আমরা এই স্বাধীনতা পেলাম তাই চিন্তা করতে থাকি, ভাবতে থাকি স্বাধীনতা শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো!

নয়া দিগন্ত : বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার যে আন্দোলন করলেন এখন কি তা পূরণ হচ্ছে?

আব্দুল আজিজ : গণঅভ্যুত্থানে আমাদের প্রত্যাশা আকাশসম। একটা বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশা আমাদের। সমাজের কোথাও চাঁদাবাজি, লুটপাট, হত্যা, নিরাপত্তা সমস্যা থাকবে না। রাষ্ট্র যন্ত্র ব্যবহার করে কেউ নাগরিকদের হত্যা করতে পারবে না। মানুষ বুক ভরে শ্বাস নিবে, মন খুলে কথা বলবে, হাসবে, গাইবে।

কোনো সেক্টরে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির সুযোগ থাকবে না। সরকার হবে জনতার সেবক, জনতার কাছে থাকবে দায়বদ্ধ। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রতিরক্ষা ও গবেষণায় বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে বাংলাদেশ। কিন্তু এখনো তার বিপরীত দেখছি, কিছু সময় পর বুঝা যাবে প্রত্যাশার সাথে প্রাপ্তির মিল কতটা। সেই পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চাই। জাতি হিসেবে আমাদেরও দায়িত্ব আছে। সেই দায়িত্ব পালন করে যেতে চাই।

নয়া দিগন্ত : গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন বাংলাদেশ কেমন দেখতে চান যদি বলেন।

আব্দুল আজিজ : যদি আলাদা করে বলি, আমাদের মানুষদের নৈতিক শিক্ষা দিতে হবে তবেই তারা সোনার মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে এবং দেশটাও সোনার দেশ হবে। নৈতিক স্খলন আমাদের উন্নতির প্রধান অন্তরায়। বাংলাদেশকে সকল প্রকার আধিপত্যবাদ মুক্ত থাকতে হবে। নাহলে আধিপত্যবাদের ছোবলে আমরা স্বাধীনভাবে কিছু করতে পারবো না। আমাদের শিক্ষা ও গবেষণা খাতে বাজেট বাড়াতে হবে। যাতে করে শিক্ষার পাশাপাশি গবেষণার ফিল্ড বিস্তৃত হয় এবং আমাদের শিক্ষার্থীরা সেখানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করতে পারে। আমাদের সুযোগ দেয়া হলে বিশ্বের বুকে আমরাও সেরা হতে পারি।

আমাদের মেধা আছে তা ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত স্পেস দরকার। দেশের মানুষের স্বাস্থ্যখাতে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে এজন্য উন্নত সেবা, মানবিকতা, ভালো ব্যবহার, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি জোগান দিতে হবে ও উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিরক্ষা খাতে বাজেট বাড়াতে হবে এবং অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র ও যুদ্ধযান ক্রয় করে সামরিক সক্ষমতা বাড়াতে হবে। আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে হবে, উন্নত রাডার, ফাইটার জেট ও ড্রোন দিয়ে সমৃদ্ধ করতে হবে। যাতে আমাদের দিকে কেউ চোখ তুলে তাকাতেও দু’বার চিন্তা করে।

সকল ক্ষেত্রে মেধাবী ও যোগ্যতাসম্পন্নদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। তেলবাজির সংস্কৃতি থেকে মুক্ত হতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর স্বচ্ছতা ও সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। জনগণের কাছে তাদের সকল অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে। কেউ জনবান্ধব রাজনীতি করতে না পারলে বাংলাদেশে তার রাজনীতি স্থান যেন না পায়। সংবিধান ও আইনব্যবস্থায় জনগণের আস্থার প্রতিফলন থাকতে হবে। রাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের সত্যিকারের পেশাদারিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। পরিবহন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা আনা জরুরি। মাদকের বিরুদ্ধে সবাইকে সোচ্চার থাকতে হবে। তাহলেই বাংলাদেশ একটি সুখী সমৃদ্ধ, ন্যায়-নীতি ও ইনসাফভিত্তি রাষ্ট্র হিসেবে হিসেবে পরিচালিত হবে।

নয়া দিগন্ত : একটা আন্দোলন হলো পরিবর্তনের জন্য, এখন জুলাই পরবর্তী দেশ নিয়ে কী ভাবছেন?

আব্দুল আজিজ : জুলাই স্পিরিটকে সকলের কাছে ছড়িয়ে দিতে হবে। জুলাই শুধু হাসিনার পতন নয়, জুলাই আমাদের মুক্তির সনদ। এজন্য কয়েকজন জুলাইয়ে সামনের ফাঁসির যোদ্ধারা মিলে এই বছর একটি রাজনৈতিক প্লাটফর্ম প্রতিষ্ঠা করেছি যার নাম ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশ (আপ বাংলাদেশ)।

গত ৯ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে এ প্লাটফর্মের যাত্রা শুরু হয়। আমরা সত্যিকার অর্থে জুলাই স্পিরিটকে ধারণ করে ও জুলাই আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে বদ্ধ পরিকর। জুলাই নিয়ে যেন কেউ একক মালিকানা দাবি না করতে পারে এবং জুলাই বেঁচে স্বার্থ উদ্ধার করতে না পারে তাই এটি জুলাইয়ের একটি বৃহৎ রাজনৈতিক উদ্যোগ।

এখানকার প্রতিটি সদস্য দেশপ্রেমিক ও দেশকে নিয়ে দেশের মানুষকে নিয়ে চিন্তা করে। তারা বাংলাদেশকে সত্যিকারের নতুন বন্দোবস্ত উপহার দিতে চায়। আমিও প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে এই পথচলায় সঙ্গী হয়েছি। ক্ষমতা ও স্রোতের বিপরীতে চলে এক নয়া সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ার বুনিয়াদ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি।

আমি বিশ্বাস করি, শেষ পর্যন্ত এই শক্তি জুলাইকে ধারণ করে টিকে থাকবে, কোনো ভাই-ব্রাদার পার্টি নয় বরং বাংলাদেশের গণমানুষের দলে পরিণত হবে, ইনশাআল্লাহ।

নয়া দিগন্ত : আপনারা তো রাজনৈতিক দল গঠন করলেন, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গা থেকে পরিকল্পনা কী?

আব্দুল আজিজ : বাংলাদেশের মানুষকে বিগত প্রায় দেড় যুগ ধরে ভারতীয় ও বিজাতীয় সংস্কৃতি গেলানো হয়েছে। আমাদের পরিবারগুলোতে ভাঙ্গনের সৃষ্টি করা হয়েছে খুব পরিকল্পিতভাবে। এজন্য আমাদের নিজেদের আবহমান সংস্কৃতির বিকাশ করতে হবে। ধর্মীয় শিক্ষাকে গুরুত্ব দিতে হবে। সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও এলাকাভিত্তিক সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।

আমাদের সংস্কৃতির সাথে পরিচয় ঘটাতে হবে এই প্রজন্মকে। তারা আমাদের সংস্কৃতি আঁকড়ে ধরলে এই সমৃদ্ধ সংস্কৃতিকে আবারও সবার মাঝে পৌঁছে দেয়া সম্ভব। আবার একইভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক কাজগুলো করে যেতে হবে। যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ভালোভাবে জানানোর প্রচেষ্টা করতে হবে। আমাদের প্রজন্মকে ইতিহাস সম্পর্কে পরিষ্কার জ্ঞান অর্জন করতে হবে। অন্তত বিগত ২০০-৩০০ বছরের ইতিহাস জানাতে হবে।

এজন্য সকল বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক পাঠচক্র, আলোচনা সভা ও বিশেষ সেশন করাতে হবে। এখানে এই দু’টো বিষয়েই আমাদের রাজনৈতিক প্লাটফর্ম আপ বাংলাদেশ কাজ করে যাচ্ছে। আমরা ইতিমধ্যে দেশব্যাপী জুলাই ঘোষণাপত্র ও সনদ নিয়ে পাঠচক্র ও আলোচনা সভা করেছি। মানুষকে বুঝাতে চেষ্টা করেছি এটা কি এবং কেন আমাদের লাগবে। বাংলাদেশের আবহমান সংস্কৃতিকে সকলের কাছে পৌঁছে দিতে কাজ করে যাচ্ছে আপ বাংলাদেশ।

নয়া দিগন্ত : জুলাই তো এখনো শেষ হয়নি, দেশের প্রয়োজনে আবারো রাজপথে যাবেন?

আব্দুল আজিজ : আমি আগেই বলেছি, জুলাই আমাদের মুক্তির ঠিকানা, মুক্তির সনদ। তাই যতক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষের চূড়ান্ত মুক্তি ও বিজয় না আসবে আমাদের জুলাই চলবে। এই দেশ থেকে অন্যায় জুলুম-অবিচার দূর না হলে দুর্নীতি মুক্ত না হলে সত্যিকারের মানবতা প্রতিষ্ঠা হবে না। আমাদেরকে সমাজের জঞ্জাল সাফ করতে কাজ করে যেতে হবে। ফ্যাসিবাদ, স্বৈরাচার, একনায়কতন্ত্র ও ক্ষমতা লোভীদের সমূলে উৎপাটন না করা পর্যন্ত জুলাইয়ের চেতনা ধারণ করে কাজ করতে হবে।