নিরাপদ সড়ক আন্দোলন থেকে ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন কিংবা চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান প্রতিটি আন্দোলনে সামনের সারিতে ছিলেন রাজিয়া সুলতানা ঈশিতা।
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে জন্ম নেয়া ঈশিতার বেড়ে ওঠা ও শিক্ষাজীবন কেটেছে ঢাকায়। শহীদ বীর উত্তম লেফটেন্যান্ট আনোয়ার গার্লস কলেজে। পরবর্তীতে লালমাটিয়া সরকারি মহিলা কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেন।
আছে সাহিত্যচর্চা ও লেখালেখির প্রতি প্রবল ঝোঁক, সাহিত্য সম্পাদনার পাশাপাশি লেখেন সাহিত্যের নানান শাখায়। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে বুকে সাহসের পারদ জ্বেলে নেমে পড়েন আন্দোলনের মাঠে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে করেছেন লেখালেখি। এর কারণে বহুবার হুমকির মুখে পড়তে হয়েছে তাকে।

জুলাই বিপ্লবে আবু সাঈদকে পুলিশের গুলিতে হত্যার পর মাঠে নেমে পড়েন তিনি। ২ আগস্ট লেখক-শিল্পী ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ব্যানারে অংশগ্রহণ ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কথা বলায় ছাত্রলীগের রোষের মুখে পরতে হয়েছে তাকে।
কমপ্লিট শাটডাউনের সেই ভয়াবহ দিনে একদিকে বাবার অসুস্থা, অন্যদিকে চাচার মৃত্যু সবকিছু ছাপিয়ে ঈশিতা ও তার ছোট ভাই থেকে যান রাজপথেই। সেই উত্তাল সময়ে চাচাকে হারান তিনি। তাকে দাফন করতে যেতে পারেননি দুই ভাই-বোন। সারাদেশের ভাই-বোন হারানোর শোকই যেন তাদের পারিবারিক শোককে আন্দোলনের শক্তিতে পরিণত করেছে। আহতদের চিকিৎসা ও খাবার সরবরাহ করে গেছেন ৫ আগস্ট পরবর্তীতে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্নে।
নয়া দিগন্ত অনলাইনের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে উঠে আসে আন্দোলনের মাঠে তার দেখা রক্তাক্ত দিন, নতুন দেশের আকাঙ্ক্ষা ও ভবিষ্যতের ভাবনা। বলেছেন, মানুষের আর্তনাদ ও তার স্বপ্নের দেশের কথা। যেই বাংলাদেশ একদিন সত্যিকার অর্থেই সবার হয়ে উঠবে।
নয়া দিগন্ত : জুলাইয়ের পর ‘নতুন বাংলাদেশ’ নিয়ে আপনার মন্তব্য কী?
ঈশিতা : আসলে এই প্রশ্নটার উত্তর জটিল। ঠিক বাংলাদেশটা নতুন নয়। ৫ অগাস্টের পর দিন ভোর থেকে মনে হতো নতুন বাংলাদেশ। কিছুই আর আগের মতো থাকবে না। ভাবছিলাম, দেশটা স্বর্গ হয়ে গেছে, স্বপ্নের মতো। প্রতিটি মানুষ বদলে গেছে, হানাহানি, রাহাজানি সব যেন মানুষ এক রাতেই ভুলে গেছে। আল্লাহ যেন নিজ হাতে আমাদের দেশের মানুষের হৃদয়কে বিগলিত করে পরিবর্তন করে দিয়েছে। সত্যিই ভেবেছি একটা রূপকথার রাজ্যে ঘুম থেকে জেগেছি।
যখন সংসদ ভবনে দেখভাল করার জন্য ছোট ছোট শিক্ষার্থীরা নিজ উদ্যোগে হাত লাগালো তখন মনে হলো আমাদের আর কেউ হারাতে পারবে না। এ হাল কেউ ছাড়বে না। কিন্তু বাস্তবতা কঠিন। দিন দিন সেই আবেগ আর স্বপ্ন সবাই হারাতে বসেছে।
আবারো পুরনো বাংলাদেশ ফিরে এসেছে। দুর্নীতি, খুন, চাঁদাবাজি সব হচ্ছে আগের মতই, শুধু দল পাল্টেছে। তো বুঝতেই পারছেন, বাংলাদেশ কেমন আছে, আর কেমন লাগছে এই সময়ে, আসলে বলা মুশকিল।
আবার এটাও ঠিক যে একটা স্বৈরাচার যুগের সমাপ্তি হওয়ার পর রিফর্ম করতে সময় লাগে এবং এই সময়টা দেশ ও দশের পরিস্থিতি নাজুক থাকে। কিন্তু আবার যদি সেই নাজুক অবস্থাতেই ফিরে যাই তাহলে এত রক্ত ঝরিয়ে কেন এ বিজয় আনা হলো, আমরা যদি মানুষই না হই।

নয়া দিগন্ত : আন্দোলনে যাওয়ার গল্পটা বলেন।
ঈশিতা : চব্বিশের জুলাইয়ে আমার মাস্টার্সের রেজাল্ট বের হয়। এর আগেই আমি একটা চাকরিতে যোগ দেই। সরকারি চাকরির প্রতি ফ্যাসিনেশন আমার কোনোকালেই ছিল না। ১৮ সালে যখন কোটা আন্দোলন হয় সে সময়েও প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ ছিল আমার। আমি সে সময় লালমাটিয়া সরকারি মহিলা কলেজে ইংরেজিতে অনার্স করছি। আমরা যখন ১৮ এর আন্দোলনে একাত্মতা পোষণ করি সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাথে। সে সময় কলেজ কর্তৃপক্ষ এক প্রকার বাধা দেয়। হয়তো রাজনৈতিক কারণে কলেজ কর্তৃপক্ষ আমাদের নিবৃত্ত করে থাকতে পারে।
তারই ধারাবাহিকতায় চব্বিশের আন্দোলন যখন কোটাবিরোধী ছিল আমার সমর্থন শুরু থেকেই। কিন্তু আমি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তোয়াক্কা করি না যেহেতু বিগত অভিজ্ঞতা আছে। আমি নিজে সরকারি চাকরি না-ই করতে পারি, কিন্তু দেশ থেকে বৈষম্য দূর হোক এটা মনেপ্রাণে চেয়েছিলাম। দেশের ছাত্র-জনতা তাদের অধিকার বুঝে পাক সেই জায়গা থেকে এবং নিজের নাগরিক অবস্থান থেকে আন্দোলনের শরীক হই।
আমি মাঠ পর্যায়ে অবস্থান নিতে থাকি ১৬ জুলাই থেকে, যখন দেখি অন্যায়ভাবে শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালানো হলো। আমি মাঠে নেমেছি যত না শিক্ষার্থীর জায়গা থেকে তারও বেশি নাগরিকত্বের অধিকারে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে।
নয়া দিগন্ত : সেই সময় তো অনেক ছাত্র-জনতা আহত হয়েছে বা শহীদও হয়েছে অনেকে এমন ঘটনা বলেন।
ঈশিতা : অনেকেই আহত হয়েছেন, এমন ঘটানা তো অনেক। কারো গুলি লেগেছে, কারো বুলেট, ইট-পাটকেল আর টিয়ারশেল লেগে প্রতিটা মানুষ যেন ঝলসে গেছে। সম্ভবত ১৮ জুলাই শংকর থেকে আই হসপিটালে পয়েন্টে অবস্থান নিয়েছে শিক্ষার্থী ও সাধারণ জনতা। অন্যদিকে ২৭ নম্বরে ছাত্রলীগ ও পুলিশ ধাওয়া-পালটা ধাওয়া দিচ্ছে, রাবার বুলেট ছুড়ছে।
আমাদের হাতে কিছু নেই, কপালে পতাকা বাঁধা। প্রচুর ইট-পাটকেল ছুটে আসছে আর মুর্হুমুহু টিয়ারশেল ছুঁড়ছে। পুরো এলাকা ধোয়ায় আচ্ছন্ন। ছোট ছোট বাচ্চা ছেলেগুলোকে সামলে রাখাই দায় হয়ে যাচ্ছিলো। কোনো শক্তিই ওদের আটকাতে পারছিল না। কী গভীর তেজ নিয়ে বারবার ২৭-এর দিকে চলে যাচ্ছিলো ওরা।
এর মধ্যে একটা ছেলের পুলিশের টিয়ারশেলে পুরো শরীর ঝলসে উঠছে। মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে চিৎকার করে উঠে বলছিল ‘আমার শরীর জ্বলে যাচ্ছে, আমি মরে যাব তবুও আমি পেছনে যাব না। আমার ভাইদের কেন মারলো, আমি যাব না।' আমরা তাকে ধরাধরি করে একটা গ্যারেজে নিয়ে পানি দেই ও প্রাথমিক চিকিৎসা দেই। কিন্তু নিজের আহত শরীরই যেন ওকে আরো বেশি বিপ্লবী করে তুলছিল, আটকে রাখা যাচ্ছিল না, বারবার উঠে দৌড়ে চলে যাচ্ছিল। ওর সেই আহত ও তেজস্বীতা নিয়ে মাটিতে গড়াগড়ি দেবার যে যন্ত্রণা তা এখনো আমার চোখে ভাসছে।
আরেকটা ঘটনা আমাকে আলোড়িত করে। ৪ আগস্ট সারাদিন আমাদের অবস্থান ছিল সাইন্সল্যাবে। অনেকেই গুলি খেয়ে আহত অবস্থায় হসপিটালে যায়৷ যে নেতৃত্ব দিচ্ছে, সে আহত হয়ে গেলে আবার অন্যজন নেতৃত্ব দিচ্ছে, এভাবেই আন্দোলন আগাচ্ছে। হতাহত ব্যাপক, যার দিকে তাকাচ্ছি হয় সেই গুলি খাচ্ছে, কেউ রাবার বুলেট খাচ্ছে, কারো পা থেকে স্রোতের মতো রক্ত ঝরছে, কারো কপাল, কারো শরীর।
বিকেল ৪টার দিকে কারা যেন ইয়েলোর শো-রুম জ্বালিয়ে দেয়। দাউদাউ করে আগুন পুরো এলাকা অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তোলে। পুলিশ গুলি করতে থাকে। ছররা গুলি লেগে আহত এক শিক্ষার্থীকে গলির মধ্যে ফাস্ট এইড দিতে নিয়ে যাই। মাথার তালুতে গুলি লাগে তার। সেই মুর্হুতে পুলিশ আবার আমাদের অবস্থানে দৌড়ে এসে গুলি করতে থাকলে সবাই দৌড়ে সরে যায়। আহত ভাইটারে তখন হারিয়ে ফেলি। ওর যে নিষ্পাপ রক্ত আমার হাতে লেগে থাকে, সেই হাত মনে হয় আজো ধুতে পারি না। ছেলেটাকে আমি মনে মনে এখনো খুঁজি, যার রক্তের দাগে বিজয় এসেছে নেমে।
নয়া দিগন্ত : একটা সময় পর তো ইন্টারনেট ছিল না তখন কীভাবে কাজ করেছিলেন, কী পরিকল্পনা করেছিলেন?
ঈশিতা : যখন ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে গেলো তখনকার মানসিক অবস্থার কথা বলে বোঝানো যাবে না। আমরা ইন্টারনেটের উপর এত বেশি নির্ভরশীল হয়ে গিয়েছি একটা মূহুর্তও কল্পনা করতে পারি না। ইন্টারনেট ছাড়া কীভাবে সবকিছু সামাল দেবো। তার উপর দেশের এই অবস্থা!
প্রথমে ফেসবুক ডাউন হলো, হোয়াটসঅ্যাপ ডাউন হলো, দেন আমরা টেলিগ্রাম ব্যবাহার করি। এরপর তো ইন্টারনেট একেবারেই শাট ডাউন হলো। আন্দোলনের খবরাখবর পাওয়া কষ্ট হচ্ছিল। মোবাইলে কথা বলে সব খোঁজ খবর নিচ্ছি। আন্দোলনে জনসাধারণের অংশগ্রহণে এক প্রকার ভাটা পড়ে যায়। আমি সব সময় উদ্বিগ্ন হয়ে থাকতাম ছোট ভাইয়ের জন্য। রাত হলে ফোনটা মনে হতো চোখের সামনে ধরে রাখি, এই না ভাই আমার ফোন করে। না জানি কোনো বিপদের খবর আসে বোনের কাছে। শুধু মনে হতো রাতেই হয়ত কোনো একটা দুর্ঘটনা কোথাও ঘটছে৷ কোথায় যে আমার ভাইগুলোকে মেরে ফেলছে!
আমি যেখানে থাকি সেখানকার সমমনাদের ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করি, কোনো খবর পেলে তা সাথে সাথে জানিয়ে দিতাম।
ওই সময়টাতে মনে হলো সেই ছোটোবেলায় ফিরে গিয়েছি। জীবনের তাড়া কমে গেছে। বিকেল হলেই গলির প্রতিটি বাসার ছেলেমেয়েরা নেমে আসছে, খেলছে। কিন্তু ঘরে বসে থাকবার সময় তো ওটা ছিল না। প্রতিদিন সকালে এবং বিকেলে রুটিন করে আমরা মোহাম্মদপুর, শংকর, ধানমন্ডি, সংসদ এসব এলাকা পর্যবেক্ষণ করতে বের হতাম। মোহাম্মদপুরে প্রতিদিনই হত্যার খবর পেতাম। এসব খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে পুলিশ ও ছাত্রলীগের ধাওয়ায় পরতে হয়েছে অনেকবার।
নয়া দিগন্ত : আন্দোলনের পার এখন কী মনে হয়, জুলাই আকাঙ্খার প্রতিফলন কতটুকু দেখতে পাচ্ছেন?
ঈশিতা : আমার তো মনে হয়, জনগণের আকাঙ্ক্ষার কোনো অংশই প্রতিফলন হয়নি। শুধু একজন মানুষের অবস্থার পরিবর্তন হয়ে ঢাকা ছেড়ে দিল্লীতে বসে দল পরিচালনা করছেন। একটা বিশাল চেয়ারের রদবদল হয়েছে। এখন অন্যজন এসে বসবে৷ সেও চেয়ার পেয়ে স্বৈরাচার হয়ে উঠবে না তার কোনো গ্যারান্টি নেই। আসলে জীবনটা তো অনিশ্চিয়তার।
শেখ হাসিনা চলে গেছে ঠিক আছে কিন্তু একটা পুরনো বটগাছের শাখা-প্রশাখায়, মূল কতটা গভীরে যেতে পারে তা তো ভাবতে পারেন। তেমনি এক যুগেরও বেশি সময় ধরে শাসন করে আসা দলকে কী শুধু একজন দিয়ে রুখতে পারবেন? তার রেখে ১৬ বছরের সিস্টেম কী ভেঙে দিতে পেরেছে? তার বসিয়ে যাওয়া লোকবল কি বদলে গেছে, সরে গেছে? যাইনি তো? তাহলে জনগণের আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন কীভাবে হবে? তারা করবে জনগণের আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন? এই হইলো অবস্থা।
তার উপরে আমাদের মরচে পড়া জাতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘুষ, দুর্নীতি, খুন, ক্ষমতা এসব তো আছেই। এসবের ভীড়ে এত মানুষের আত্নত্যাগ মিছে হয়ে গেছে। স্বজনপ্রীতির সিস্টেম এবং আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার যে তীব্র বাসনা আমরা চেপে রাখি তা ৫ অগাস্ট পরবর্তীতে বানের জলের মতো দুকূল ভাসিয়ে নিচ্ছে। হ্যাঁ, সরকারের বডিকে দেশপ্রেমিক হতে হবে, সেই সাথে জনগণকেও লোভ, লিপ্সা ছেড়ে দেশ বিনির্মাণে কাজ করতে হবে। তবেই এ বাস্তবায়ন সম্ভব হতে পারে।
নয়া দিগন্ত : ৫ আগস্ট (৩৬ জুলাই) কীভাবে পার করলেন?
ঈশিতা : ৫ আগস্ট সকালে মনস্থির করে বের হই আজ কিছু একটা হয়ে যেতে পারে। সাথে পরিবারের একজনের ফোন নাম্বার (বড় ভাই) কাগজে বড় করে লিখে ম্যানিবাগে নিয়ে বের হই। ফোন তো লক থাকে সেটা প্রয়োজনে অন্য কেউ নাও খুলতে পারে। আমার ধারণা ছিল, আজ কিছু একটা হবেই। হয় শেখ হাসিনা আরো রোলার কোস্টার চালিয়ে হত্যাযজ্ঞ করবে নির্বিকারে, নয়তো ক্ষমতা সেনাবাহিনী নিবে।

সেদিন আসলে প্রস্তুত ছিলাম যে সুস্থ অবস্থায় হয়তো ফিরব না। মোহাম্মদপুর থেকে কোনোদিকেই বের যাওয়া যাচ্ছিল না। সেনাবাহিনী আটকে দিচ্ছিল। বিভিন্ন রুট চেঞ্জ করে করে কখনো হেঁটে, কখনো রিকশা নিয়ে শহীদ মিনারের দিকে আগাতে থাকি। জিগাতলায় ছাত্রলীগের সাথে ধাওয়া-পালটা ধাওয়া হয় আমাদের। একপর্যায়ে শাহবাগ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারি। বেলা ১টার দিকে শহীদ মিনার থেকে খবর পাই শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছেন। বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না, বলি এটা আরেকটা চাল হতে পারে, এরমধ্যে দিয়ে সে ম্যাসাকার করে ফেলতে পারে আন্দোলনরতদের উপর। কারণ তখনো যাত্রাবাড়ীসহ কিছু জায়গায় শিক্ষার্থীদের উপর গুলি করা হচ্ছে।
ধীরেধীরে মানুষের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস আর আন্দোলনে শরীক হওয়াই বলে দিল তিনি ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছেন। মনে হলো বানের জলের মতো মানুষ ছিটকে বেরিয়ে আসছে টিএসসিতে। মানুষের বাঁধভাঙা আনন্দ আর কান্নায় টিএসসি প্রকম্পিত হয়ে গেলো মূহুর্তেই। অজস্র মানুষের সাথে আমরা বঙ্গভবনের দিকে যাত্রা করি। তখনো ওয়াকার সাহেব জাতির উদ্দেশ্যে বক্তব্য দেননি, সময়ক্ষেপণ করছেন।
বিজয়ের সে কি আনন্দ! যাকে পাচ্ছি জড়িয়ে ধরে কাঁদছি। কাঁদছি আমার ভাই হারানোর হাহাকারে। ভাইয়ের লাশের উপর দিয়ে যে বিজয় সেই বিজয় যন্ত্রণায়, সেই বিজয় গর্বের। রাস্তায় রাস্তায় সেনাবাহিনীদের চিৎকার করে বলছিলাম, 'কই মারবেন না আমার ভাইগুলোকে আর? দাঁড়িয়ে আছেন কেনো? মারেন, মারেন।'
এমনও ইতিহাস হয়, সেনাবাহিনী একটু আগেও গুলি করে যাচ্ছিলেন জনতার উপর, তারাই এখন ফুল ছড়াচ্ছে! সেদিনের কথা মনে পড়লে এখনো আনন্দাশ্রু ঝরে পড়ে। সেদিন হয়তো কোনো কাকপক্ষীও ঘরে ছিল না, নেমে এসেছিল বিজয়ের সামিল হতে। এমন ইতিহাস কখনো আসবে না। যাকেই পাচ্ছিলাম ফোনে বলছিলাম, '১৬ ডিসেম্বর যেমন একবারই এসেছে, ৫ আগস্টও একবারই। আর আসবে না। আসেন আসেন।'
গণ মানুষের সাথে যখন বঙ্গভবনে গেলাম, দু’ধরনের দৃশ্য দেখতে পেলাম। এক দল যেখানে যা পাচ্ছে তাই নিয়ে মহানন্দে চলে যাচ্ছে, যেন নিতেই হবে কিছু। সেনাবাহিনীর লোকেরা আমাদের রিকোয়েস্ট করায় সেদিন রাত ৯টা পর্যন্ত স্বেচ্ছাসেবীর কাজ করি। সবার কাছ থেকে জিনিসপত্র রেস্কিউ করে মাঠের মধ্যে জড়ো করি।
আরেক দল দেখতে পাই, বিজয়ের আনন্দে নফল নামাজ পরছে, কেউ চিৎকার করে কাঁদছে, যার স্বজন হারিয়েছে সে বুক চাপড়াচ্ছে। এমন এক দৃশ্য তা যেন কল্পনা করা যায় না। এমন দৃশ্য আর কোনো শাসক যেন তৈরি না করে।
নয়া দিগন্ত : আপনি কেমন বাংলাদেশ দেখতে চান?
ঈশিতা : গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে জনগণের স্বার্থ কায়েম হোক। ফ্যাসিবাদ দূর হোক, অন্যায়,নিপীড়ন, হত্যা, ছিনতাই, দুর্নীতিসহ সব মন্দ জিনিস ভুলে সাম্যের দেশ গঠন হোক। নাগরিক অধিকার নিশ্চিত হোক সকল জাতি, ধর্ম,বর্ণ ও দলমতের।
শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি করা জরুরি। নারীর প্রতি সকল সহিংসতা বন্ধ হোক। ভোটাধিকার ফিরে পাক। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, ২৪-এর গণঅভ্যুত্থান এবং সব রাজনীতি রোষানলে পতিত হয়ে অন্যায়ভাবে জীবন দিয়েছেন এমন সব শহীদ ও মৃত্যুবরণকারীদেরকে শ্রদ্ধায় রেখে দেশ গড়া। দেশের স্থাপত্য কথায় কথায় ভেঙে না ফেলা, কোটাবিহীন দেশ গড়া। বিশ্ব দরবারে দেশের মানুষ ও পতাকাকে সমুন্নত রাখা এটাই মূলত দেখতে চাই।
নয়া দিগন্ত : একটা আন্দোলনে সরকার পরিবর্তন হলো, কিন্তু সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গার কাজটা বাকি, এ নিয়ে পরিকল্পনা কী?
ঈশিতা : সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গা থেকে বেশ কিছু কাজ করার আছে আমাদের। এই চর্চাটা গোষ্ঠীকেন্দ্রিকতা থেকে বের হয়ে এসে দেশ ও দেশের মানুষের সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ ও বিকাশে কাজ করতে হবে। সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী শক্তির বিকাশ ঘটাতে হবে।
শিক্ষা ব্যবস্থা ও গবেষণার অভয়ারণ্য গড়ে তুলতে হবে আমাদের। দেশের প্রয়োজনেই আন্তঃসাংস্কৃতিক বোঝাপড়া ও সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা উন্নত করতে হবে। সব ধর্মের মানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধের সহাবস্থান তৈরি করতে হবে আমাদের।
নয়া দিগন্ত : জুলাইকে টিকিয়ে রাখতে এখন কী করা দরকার মনে করেন?
ঈশিতা : দেখেন দেশের প্রয়োজনে কোনোকিছুকেই বাদ দেয়া যাবে না। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, ২৪ এর গণঅভ্যুত্থান সবগুলোই অনেক বেশি গুরুত্ব বহন করে বাংলাদেশীদের জন্য। সবকিছুকে সাথে নিয়েই আমাদের আগাতে হবে।
সবগুলো আন্দোলনই এত ওতপ্রোতভাবে জড়িত যে একটা ছাড়া অন্যটা সাধন হতো না। ধারাবাহিকভাবে দেশের প্রয়োজনে দেশের ছাত্র-জনতা যৌক্তিক দাবি নিয়ে হাজির হয়েছে।
এখানে মুক্তিযুদ্ধকে জুলাই আন্দোলনের সাথে তুলনা করা যাবে না। মানুষের শরীরের সবগুলো অঙ্গপ্রত্যঙ্গই জরুরি। একটা ছাড়া অন্যাগুলো প্রায় অচল। তাই জুলাই জারি রাখা মানে, জুলাই থেকে শিক্ষা নিতে হবে। জুলাইয়ের যা কিছু ভালো তা জারি রাখতে হবে। জুলাইয়ের প্রেরণায় একটি বৈষম্যহীন বাংলাদেশ সাজাতে হবে।