আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনেই গণভোট আয়োজনে ‘গণভোট অধ্যাদেশ-২০২৫’-এর খসড়া নীতিমালার অনুমোদন দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। অধ্যাদেশে গণভোট কোন প্রক্রিয়ায় নেয়া হবে, গণনা বা প্রস্তুতি কেমন হবে সে বিষয়েও সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে সরকার।
বাংলাদেশে এর আগে তিনটি গণভোট হলেও জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন গণভোট আয়োজনের কোনো নজির নেই। এমন পরিস্থিতিতে প্রবাসী ভোটসহ একই দিনে প্রায় ১৩ কোটি ভোটারের নির্বাচন আয়োজনে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সক্ষমতা কতটুকু সেই প্রশ্নও সামনে আসছে।
কেননা গত শনিবার ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেছেন, একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট আয়োজন করতে ইসিকে অনেকগুলো অতিরিক্ত কাজ করতে হবে।
মঙ্গলবার অর্থাৎ ২৫ নভেম্বর গণভোটের অধ্যাদেশ জারির পর অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সেখানে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন যে সব কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হবে সে সব কেন্দ্রেই অনুষ্ঠিত হবে গণভোট। এবং জাতীয় নির্বাচনের ফলাফলের সাথেই গণভোটের ফলাফল ঘোষণা করা হবে।
এখন নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, সংসদ নির্বাচনের দিন সারাদেশে একসাথে দু’টি ভোট দেয়া ও সেটি গণনা করতে হলে একদিকে যেমন ভোটারদের দীর্ঘ লাইন তৈরি হবে, অন্যদিকে গণনা শেষে ফলাফল প্রস্তুত করতেও অনেক সময় লাগবে।
গণভোটের সিদ্ধান্ত হওয়ার আগেই জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে সারাদেশের ভোটকেন্দ্রের তালিকা ও সংখ্যা চূড়ান্ত করে ইসি নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করেছে বেশ কয়েকদিন আগে।
যেখানে একটি নারী বুথে ৫০০ জন, আর পুরুষ বুথে ৬০০ জন ভোট দেবে এমন হিসাব করে কেন্দ্র বিন্যাস করা হয়েছিল।
এখন গণভোটের সিদ্ধান্তের পর কেন্দ্রে ভোটারের দীর্ঘ লাইন ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরির শঙ্কাও দেখছেন বিশ্লেষকরা।
কিভাবে হবে গণভোট?
গত ১৩ নভেম্বর জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস একই দিনে দু’টি নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা দেন। এরপরই গণভোট নিয়ে অধ্যাদেশ বা তৈরির কাজ শুরু করে অন্তর্বর্তী সরকার। মঙ্গলবার সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে গণভোট অধ্যাদেশ-২০২৫ এর খসড়া নীতিমালার অনুমোদন দেয়া হয়।
পরে সংবাদ সম্মেলনে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, ‘প্রথমবারের মতো প্রবাসীর ভোট দেবে। আবার একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জটা অনেক বড়।’
আইন উপদেষ্টা জানান, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতকৃত ভোটকেন্দ্রেই গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। সেই বিষয়টিও যুক্ত করা হয়েছে অধ্যাদেশে। একই সাথে জাতীয় নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতকৃত ভোটার তালিকাই হবে গণভোটের ভোটার তালিকা।
সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সংসদ নির্বাচনের জন্য দায়িত্বে যে সব রিটার্নিং অফিসার, প্রিসাইডিং অফিসার বা পোলিং অফিসাররা থাকবেন, তারাই গণভোটের নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করবেন।
গণভোটের চারটি বিষয় উল্লেখ থাকলে হ্যাঁ বা না ভোট দেয়ার জন্য একটি মাত্র ভোট দিতে হবে বলেই জানিয়েছেন আইন উপদেষ্টা।
সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত পদ্ধতিতে গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। গণভোটের প্রশ্নটিতে হ্যাঁ/না ঘরে কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত সিল দিয়েই ভোট প্রদান করা হবে।’
এবার প্রথমবারের মতো প্রবাসীদের ভোট দিতে এরই মধ্যে নানা প্রস্তুতি শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন। যে কারণে জাতীয় নির্বাচনের মতো গণভোটেও ভোট দিতে পারবেন প্রবাসী ভোটাররা।
মঙ্গলবারের সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ। তিনি বলেছেন, সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের ব্যালটের জন্য আলাদা দুই রঙের কাগজ ব্যবহার করা হবে।
ইসি সচিব বলেন, ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য সাদা পেজে কালো প্রিন্টেড ব্যালট হবে, আর গণভোটের ক্ষেত্রে রঙিন ব্যালট ব্যবহার করব। রঙিন কাগজের ওপর যে কালি দৃশ্যমান হয় সে রকম কালিই ব্যবহার করা হবে।’
নির্বাচন কমিশন বলছে, এসব ব্যালট পেপার ছাপানো হবে গর্ভমেন্ট প্রিন্টিং প্রেস বা বিজি প্রেস থেকে। যে কারণে বিজি প্রেস এ নিয়ে প্রস্ততি রাখার জন্য বলা হয়েছে।
এক দিনে দুই ভোটে যত চ্যালেঞ্জ
জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোটের সিদ্ধান্ত সরকারের পক্ষ থেকে আগেই জানানো হয়েছিল। গণভোট আয়োজন কবে হবে এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও নানা মতপার্থক্য তৈরি হয়।
এমন সংকটের মধ্যেই জুলাই সনদ চূড়ান্তে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনই গণভোট আয়োজনে সরকারের সিদ্ধান্তের কথা গত ১৩ নভেম্বর জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে জানান প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
গত বৃহস্পতিবার এই ভোট আয়োজনের প্রস্তুতি নিতে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি পাঠায় সরকার।
সরকারের ওই চিঠি পাওয়ার গত শনিবার ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেন, ‘একই দিনে নির্বাচন ও গণভোট আয়োজন করতে হবে, একই রিসোর্স ব্যবহার করে। এটা আগে ছিল না। আগের কোনো কমিশনকে এই চ্যালেঞ্জ নিতে হয়নি। এজন্য অনেকগুলো অতিরিক্ত কাজ করতে হবে।’
নির্বাচন কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, আর কয়েকদিনের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে। যে কারণে আগেই ভোটকেন্দ্র চূড়ান্ত করা হয়েছে। কয়েক মাস আগে থেকে প্রশিক্ষণও শুরু হয়েছে।
ইসির সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এর আগে ৩০০টি সংসদীয় আসনের জন্য ইসির নির্ধারিত কেন্দ্রের সংখ্যা ছিল ৪২ হাজার ৭৬১টি। এরমধ্যে পুরুষদের জন্য এক লাখ ১৫ হাজার ১৩৭ এবং নারীদের জন্য এক লাখ ২৯ হাজার ৬০২ ভোটকক্ষ নির্ধারণ করা হয়েছিল।
এক্ষেত্রে গড়ে ৬০০ পুরুষ ভোটারদের জন্য একটি কক্ষ এবং ৫০০ নারী ভোটারদের জন্য একটি কক্ষ নির্ধারণ করা হয়েছিল।
কমিশনের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তারা বলছেন, এবারের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ফেব্রুয়ারির শুরুতে। তখন শীতকাল থাকবে। ভোট হবে সকাল ৮টা থেকে বিকেলে ৪টা পর্যন্ত।
সেক্ষেত্রে ৪৮০ মিনিটের মধ্যে একটি নারী বুথে ৫০০ জন এবং পুরুষ বুথে ৬০০ জনকে ভোট দিতে হবে। যেটিকে অনেকটা চ্যালেঞ্জিং বলে মনে করছে বিশ্লেষকরা।
সাবেক নির্বাচন কর্মকর্তা ও বিশ্লেষক জেসমিন টুলী বলেন, এমনিতেই শীতের দিন। তার ওপর দু’টি ব্যালটে ভোট দিতে হবে। আমাদের দেশের অনেক ভোটারই এটি নিয়ে খুব একটা সচেতন না। যে কারণে ভোট দিতে সময় লাগতে পারে। যাতে বিশৃঙ্খলাও বাড়তে পারে।
তিনি বলেন, ‘এক্ষেত্রে ৬০০ থেকে নামিয়ে ৩৫০ কিংবা সর্বোচ্চ ৪০০ ভোটারের জন্য একটি কক্ষ করলে সেটি ভালো হতো। নির্বাচন কমিশনকে এ সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা উচিত।’
মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে আইন উপদেষ্টা জানিয়েছেন, জাতীয় নির্বাচন ও গণভোটের ব্যালট যোগ করেই ফলাফল ঘোষণা করবে নির্বাচন কমিশন।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক নির্বাচনের ইতিহাস বলছে, একই দিনে ৩০০ আসনে একটি ব্যালটে ভোট অনুষ্ঠিত হওয়ার পর ফলাফল হতেই দীর্ঘ সময় লেগে যায়। এবার সেখানে বাড়তি একটি ব্যালট যুক্ত হচ্ছে যেটি ইসির সামনে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এছাড়াও এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিতে পারছে না সেটি অনেকটাই নিশ্চিত। সেক্ষেত্রে নির্বাচনকে প্রতিহত করতে দলটির কর্মী সমর্থকদের প্রচেষ্টা করতে পারে এমন শঙ্কার কথাও বলেছেন তারা।
চার বিষয়, একটি ভোট
ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা জানিয়েছিলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে চারটি বিষয়ের ওপর আলোকপাত করা হলেও সেখানে একটি প্রশ্নই থাকবে। এবং এতে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দেবেন ভোটাররা।
মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, জুলাই সনদের যে ৩০টি প্রস্তাব সেগুলো আমরা গণভোট অধ্যাদেশের অ্যাপেন্ডিক্সে দিয়ে দিচ্ছি। যাতে প্রতিটা মানুষের জানা থাকে।
সরকারের পক্ষ থেকে আগেই গণভোটের চারটি বিষয় জানানো হয়েছিল। মঙ্গলবারও নতুন করে সেই বিষয়গুলো তুলে ধরনে অধ্যাপক নজরুল।
গণভোটের ব্যালটে প্রশ্ন হিসেবে থাকবে- ‘আপনি কি জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এবং জুলাই জাতীয় সনদে লিপিবদ্ধ সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত নিম্নলিখিত প্রস্তাবগুলোর প্রতি সম্মতি জ্ঞাপন করছেন?’ এবং তার নিচেই থাকবে-
ক. নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান জুলাই সনদে বর্ণিত প্রক্রিয়ার আলোকে গঠন করা হবে।
খ. আগামী সংসদ হবে দুই কক্ষ বিশিষ্ট। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে ১০০ জন সদস্যবিশিষ্ট একটি উচ্চকক্ষ গঠিত হবে এবং সংবিধান সংশোধন করতে হলে উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের অনুমোদন দরকার হবে।
গ. সংসদে নারীর প্রতিনিধি বৃদ্ধি, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার ও সংসদীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমিতকরণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি, মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও স্থানীয় সরকারসহ বিভিন্ন বিষয়ে যে ৩০টি প্রস্তাবে জুলাই জাতীয় সনদে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নে আগামী নির্বাচনে বিজয়ী দলগুলো বাধ্য থাকবে।
ঘ. জুলাই সনদে বর্ণিত অন্যান্য সংস্কার রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি অনুসারে বাস্তবায়ন করা হবে।
এই চারটি প্রশ্নের নিচে ভোটারদের উত্তর দেয়ার জন্য দু’টি মাত্র অপশন থাকবে হ্যাঁ অথবা না।
মঙ্গলবারের সংবাদ সম্মেলনে আইন উপদেষ্টা জানান, গণভোটের প্রশ্নটিতে হ্যাঁ/না ঘরে কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত সিল দিয়েই ভোট প্রদান করতে হবে ভোটারদের।
সেক্ষেত্রে জাতীয় নির্বাচনের মতো এই ভোটেও ব্যালট বাতিল হতে পারে ত্রুটিজনিত কারণে।
তবে, দুই ভোটের জন্য আলাদা দু’টি ব্যালট বাক্স সরবারহ করা হবে কিনা সেটি এখনো নিশ্চিত করে জানানো হয়নি নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে।
সূত্র : বিবিসি



