চব্বিশের জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান চলাকালীন রাজধানীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালে আনা গুরুতর আহত ১৬৭ জনের বেশিভাগের মাথার খুলি ছিল না।
শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বুধবার (২০ আগস্ট) বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ এ সাক্ষ্য দেন হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক মো: মাহফুজুর রহমান।
জবানবন্দিতে চিকিৎসক মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে ৫৭৫ জন গুলিবিদ্ধ ও পিলেটবিদ্ধ রোগীকে বহির্বিভাগে চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। এদের মধ্যে অনেককেই হাসপাতালে ভর্তি করার প্রয়োজনীয়তা থাকলেও সিট সংকুলান না হওয়ায় এবং গুরুতর আহত রোগীর চাপ বেশি থাকায় তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। আর গুরুতর আহত ১৬৭ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাদের বেশিভাগেরই মাথার খুলি ছিল না। চারজনকে মৃত অবস্থায় আনা হয় এবং ২৯ জন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। আইসিইউতে চিকিৎসা নেয়া সাতজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ডে পাঠানো হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘৩৩টি অস্ত্রোপচার আমার নেতৃত্বে করেছি। ১৫টির মতো বুলেট ও পিলেট আহত আন্দোলনকারীদের শরীর থেকে বের করেছি। কিছু বুলেট বের করা যায়নি। অনেকগুলো গুলি ও পিলেট রোগীরা চেয়ে নিয়ে যায়।’
তিনি আরো বলেন, ‘গত বছরের ১৯ জুলাই যখন রোগীর সংখ্যা বাড়ছিল, তখন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) লোকেরা এসে নতুন গুলিবিদ্ধ ছাত্রদের ভর্তি না করার জন্য তাকে চাপ দেন। তারা (ডিবি) বলে, যাদের ভর্তি করেছেন, তাদের রিলিজ করবেন না। এ বিষয়ে ওপরের নির্দেশ আছে। তাদের (গুলি বিদ্ধদের) বিরুদ্ধে আইনিব্যবস্থা নেয়া হবে। তখন আমরা কৌশলে ভর্তি রেজিস্ট্রারে রোগীদের জখমের ধরন পরিবর্তন করে গুলিবিদ্ধের স্থলে রোড অ্যাক্সিডেন্ট বা অন্যান্য কারণ লিপিবদ্ধ করে ভর্তি করি।’
এ রকম অমানবিক ঘটনার জন্য মানবতাবিরোধী অপরাধের নির্দেশদাতা শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, ওবায়দুল কাদের ও সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী আরাফাত এবং যারা নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচার গুলি চালিয়ে নিহত ও আহত করেছেন তাদের বিচার ও প্রকাশ্যে ফাঁসি চেয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্র্যাইব্যুনালে সাক্ষ্য ও জেরা শেষ করেন এ চিকিৎসক।
আজ ট্র্যাইব্যুনালে প্রসিকিউটসন পক্ষে শুনানি করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম ও গাজী এস এইচ তামিম। এ সময় অপর প্রসিকিউটররা উপস্থিত ছিলেন। এদিকে এই মামলায় পলাতক শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে ছিলেন রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন। আর এই মামলায় গ্রেফতার হয়ে ট্রাইব্যুনালে হাজির হওয়া রাজসাক্ষী সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ।
মানবতাবিরোধী অপরাধের এই মামলায় শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে গত ১০ জুলাই অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
এই মামলাটি ছাড়াও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আরো দু’টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে একটি মামলায় আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে গুম-খুনের ঘটনায় তাকে আসামি করা হয়েছে। অন্য মামলাটি হয়েছে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়।
গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে আওয়ামী লীগ সরকার, এর দলীয় ক্যাডার ও সরকারের অনুগত প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি অংশ গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করে বলে একের পর এক অভিযোগ জমা পড়ে। দু’টি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এসব অপরাধের বিচার কাজ চলছে। বাসস