মুফতি জামিল সিদ্দিকী কওমি পড়ুয়া আলেম হয়েও মূলধারার রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। এর ফলে কওমি মাদরাসা সংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ে তিনি জাতীয় নেতৃবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেন খুব সহজে। এরই মধ্যে কওমি মাদরাসার সনদের স্বীকৃতি, স্বীকৃতির বাস্তবায়নসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে তিনি একাধিক সেমিনারের আয়োজন করেছেন, যেখানে ইসলামী নেতাদের পাশাপাশি জাতীয় অঙ্গনের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারাও উপস্থিত ছিলেন। এসব সেমিনারে কওমি মাদরাসা কেন্দ্রীক বিভিন্ন সঙ্কট দূরীকরণে ইতিবাচক পরামর্শে এসেছে, যা কওমি অঙ্গনে বেশ সাড়া ফেলে।
তবে, তার আসল পরিচয়—তিনি মাঠের একজন সক্রিয় তরুণ রাজনীতিবিদ। কওমি মাদরাসার তরুণ আলেমদের নিয়ে গঠিত ‘বাংলাদেশ কওমি ছাত্র ফোরাম’ সভাপতি মুফতি জামিল সিদ্দিকী ইসলাম, দেশ ও জাতির কল্যাণে রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রামে সবসময় সামনের কাতারে থাকেন এবং নেতৃত্ব দেন। জুলাই অভ্যুত্থানেও ছিল তার সরব উপস্থিতি।
নয়া দিগন্ত অনলাইনের সাথে তিনি কথা বলেছেন অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে নানা বিষয়ে।

নয়া দিগন্ত : জুলাই অভ্যুত্থানে কওমি মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদের অংশগ্রহণ ছিল অত্যন্ত লক্ষণীয়। আপনি কিভাবে এর সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন?
মুফতি জামিল সিদ্দিকী : আমি বাংলাদেশ কওমি ছাত্র ফোরামের সভাপতির পাশাপাশি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে শুরু থেকেই এই আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলাম। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সূচনালগ্নে আমি ব্যক্তিগতভাবে শাহবাগে গিয়ে সমর্থন জানাই। একইসাথে ১৪ জুলাই রাতে টিএসসিতে যাই এবং বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক ছাত্রলীগের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে ভাই-বোনদের সাথে রাজপথে নেমে পড়ি। এদিন রাত থেকেই আমি সরাসরি আন্দোলনের অংশ হয়ে যাই এবং ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশ কওমি ছাত্র ফোরামের সদস্যদের সুসংগঠিত করার আহ্বান জানাই। নিয়মিত যোগাযোগ ও পরিকল্পনার মাধ্যমে ঢাকাসহ সারা দেশের কওমি ছাত্রদের সাহস, দিকনির্দেশনা ও অনুপ্রেরণা দিয়ে আমি আন্দোলনের ময়দানে সক্রিয় রাখি।
নয়া দিগন্ত : মাঠপর্যায়ে আপনার প্রত্যক্ষ ভূমিকা ও অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাই। আর এই অংশগ্রহণকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করেন?
মুফতি জামিল সিদ্দিকী : ১৪ জুলাই রাত থেকে শুরু করে টানা ২২ দিন আমি রাজপথে সক্রিয়ভাবে ছিলাম। কখনো মিছিলের সামনের ভাগে, কখনো আহতদের পাশে, আবার কখনো দিকনির্দেশনা দিচ্ছি মাঠে। ঘুমহীন রাত, জীবনের অনিশ্চয়তা, জলকামান, গুলি—সব কিছুর মধ্যেও হাল ছাড়িনি। আমার কাছে এই অংশগ্রহণ শুধু রাজনৈতিক ছিল না; বরং একটি ঈমানি দায়িত্ব মনে করেছি। কেননা, আমরা গত দেড় দশক ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম এই জালিম শাসকের পতনের জন্য।

১৫ জুলাই যাত্রাবাড়ীর কাজলায় স্থানীয় কিছু মানুষ যখন আন্দোলনে নামে, আমরাও তৎক্ষণাৎ নামি এবং আন্দোলনকারী ভাইদের জন্য পানি ও জুস সরবরাহ করি। ১৬-১৭ তারিখ যাত্রাবাড়ী-কাজলা কেন্দ্রিক অবস্থান করি, মাঝে মাঝে শাহবাগ ও টিএসসিতে অংশ নিই। ১৮-১৯ জুলাই পল্টন এলাকায় আমরা সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিলাম, যেখানে কওমি ছাত্র ফোরাম ছাড়াও অন্যান্য ছাত্রসংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ একত্রিত হয়ে অবস্থান করতেন।
নেট বন্ধ থাকায় আমি ফোনে রিচার্জ দিয়ে, থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে ভাইদের পাশে ছিলাম। এমনকি আমার নিজ বাসায় প্রতিদিন ১০-১৫ জন করে আন্দোলনকারী ভাই এসে রাত যাপন করেছেন। বাড়িওয়ালা প্রশ্ন তুললেও আমি বুঝিয়ে তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করি। এভাবেই ৫ আগস্ট পর্যন্ত আন্দোলন সংগ্রাম চলতেই থাকে আমাদের।
নয়া দিগন্ত : অভ্যুত্থানে কওমি অঙ্গনেই অন্তত ৪২ জন শহীদ হয়েছেন। শহীদদের স্মরণে কী করা উচিত?
মুফতি জামিল সিদ্দিকী : তাদের ত্যাগের প্রকৃত মূল্য কোনো রাষ্ট্রীয় ঘোষণায় নির্ধারণ করা যাবে না। আল্লাহই তাদের প্রকৃত প্রতিদান দেবেন। আমরা বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্ন নিয়ে এই অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছিলাম, কিন্তু এখনো সমাজের প্রতিটি স্তরে বৈষম্য ও উপেক্ষা বিদ্যমান। কওমি শহীদদের নিয়ে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না।
আমি চাই, কওমী অঙ্গনে ‘গণজাগরণ শহীদ ফাউন্ডেশন’ গঠন হোক, শহীদ দিবস পালিত হোক, পরিবারগুলোকে আর্থিক সহায়তা দেয়া হোক এবং শহীদদের স্মরণে প্রতিটি অঞ্চলে ‘শহীদ স্মৃতি পাঠাগার’ প্রতিষ্ঠিত হোক।
নয়া দিগন্ত : হেফাজতে ইসলাম অভ্যুত্থানে নিহতদের ‘শহীদ’ আখ্যা দেয়। এই ঘোষণা কি আন্দোলনে বিশেষ কোনো প্রভাব ফেলেছিল?
মুফতি জামিল সিদ্দিকী : নিঃসন্দেহে এই ঘোষণা আন্দোলনে নতুন শক্তি ও প্রেরণা যোগায়। ‘শহীদ’ শব্দটি ঈমানদারদের জন্য সবচেয়ে বড় মর্যাদার বিষয়। এই ঘোষণায় রাজপথের মানুষ নতুন আত্মবিশ্বাসে উজ্জীবিত হয়। একজন খাঁটি মুসলিমের জন্য শহীদ হওয়া তার সর্বোচ্চ তামান্না। এভাবেই আন্দোলন আদর্শিক এক শক্তিতে পরিণত হয়।
নয়া দিগন্ত : রাজনৈতিক ব্যানারের বাইরে কওমি আলেমদের উপস্থিতি জনগণের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছে কি?

মুফতি জামিল সিদ্দিকী : অবশ্যই, বহুগুণে বেড়েছে। মানুষ এখন কওমি আলেমদের শুধু শিক্ষক নয়; বরং জাতির রাহবার হিসেবে দেখতে শুরু করেছে। তবে কিছু কুচক্রী মহল আবারো আলেমদের আগের অবস্থানে ফেরাতে চাচ্ছে। কিন্তু আমরা, নতুন প্রজন্মের সচেতন আলেমরা, এটা কখনোই হতে দেব না। আমরা বিশ্বাস করি, ২০২৪ পরবর্তী বাংলাদেশ ইসলামপন্থা ও বাংলাদেশপন্থার সমন্বয়ে পরিচালিত হবে, যেখানে কওমি নেতৃত্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
নয়া দিগন্ত : রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের ক্ষেত্রে আপনার অভিজ্ঞতা কী ছিল?
মুফতি জামিল সিদ্দিকী : রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন ছিল ভয়াবহ। নিরীহ ছাত্রদের ধরে নিয়ে যাওয়া, নির্যাতন, মিথ্যা প্রচার—সবই দেখেছি। আমিও কয়েকবার ফোন চেকিংয়ের সম্মুখীন হই, বাটন ফোন নিয়ে চলাফেরা করতাম। আমার যাত্রাবাড়ীর আড্ডার জায়গায় পুলিশ কয়েকবার খুঁজতে আসে। আমি কৌশলে কখনো মাদরাসা, কখনো বোনের বাসায় থেকেছি। আমার ব্যাচেলর বাসায় প্রতিদিন ১০-১৫ জন আন্দোলনকারী থাকতো, একদলকে অন্য বাসায় পাঠিয়ে আবার অন্যদের আনতাম—এইভাবেই ভিন্ন রুমমেট পলিসিতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করি। এখানে একসাথে থাকতো বিভিন্ন দলের ছাত্ররা, তবে তা সত্ত্বেও সকরের লক্ষ্য ছিল একটাই—আন্দোলনের সফলতা।
নয়া দিগন্ত : আন্দোলনে অংশগ্রহণের নৈতিক ও আদর্শিক প্রেরণা কী ছিল?
মুফতি জামিল সিদ্দিকী : প্রেরণা ছিল ইনসাফ প্রতিষ্ঠা ও বৈষম্যবিরোধী ঈমানি দায়িত্ব। জুলুম যখন চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে যায়, তখন আল্লাহ বিচার করেন। ১৯ জুলাই জুমার বয়ানে দেশের শত শত আলেম জাতিকে আন্দোলনের জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। তবে দুঃখের বিষয়—আমি কাজলা বিশ্বরোড মসজিদের খতিবকে সরকারপন্থী বয়ান দিতে শুনেছি। তিনি তিনটি জুমায় হাসিনার পক্ষ নিয়েছেন। এখন অনেক দরবারি আলেম খোলস পাল্টিয়ে সুবিধা নিচ্ছেন, অথচ সেই সময় তারা নিরব ছিলেন। এ সময় মাওলানা মূসা আল হাফিজের একটি কলাম পুরো কওমি অঙ্গনে নাড়াচাড়া দিয়ে দেয়।
নয়া দিগন্ত : নেটওয়ার্ক বন্ধ থাকা অবস্থায় কিভাবে যোগাযোগ হতো?
মুফতি জামিল সিদ্দিকী : আমরা প্রাচীন কৌশল অনুসরণ করি—সংকেত নির্ভর বার্তা, মুখোমুখি বার্তা, রুটিন তৈরি ইত্যাদি।
বাটন ফোন একাধিকজন শেয়ার করতাম, নারী সদস্যদের নামে রেজিস্ট্রার্ড সিম ব্যবহার করতাম। সংকেত চিহ্ন ব্যবহার করে কথা বলতাম। প্রতিদিন রাতে পরদিনের পরিকল্পনা হতো। এমনকি আমি হাসপাতালে থেকেও ময়দানে তথ্য আদান-প্রদান করেছি।
নয়া দিগন্ত : আন্দোলন কিভাবে পরিচালিত হতো? নির্দেশনা কিভাবে পৌঁছতো?
মুফতি জামিল সিদ্দিকী : একটি ক্ষুদ্র নেতৃত্ব পর্ষদ সিদ্ধান্ত নিত, যা সিনিয়র ছাত্রদের মাধ্যমে চেইন সিস্টেমে ছড়িয়ে পড়ত। রাতে বৈঠক, দিনে বাস্তবায়ন—এই ছিল কাঠামো। ইসলামী ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সুসম্পর্ক থাকার কারণে সিদ্ধান্ত কার্যকর করা সহজ ছিল। অফলাইন-অনলাইন সভা দু’টিই চলত।
নয়া দিগন্ত : কওমির বিভিন্ন দল ও তাদের মধ্যেমতভেদ থাকা সত্ত্বেও ঐক্য সম্ভব হলো কিভাবে?
মুফতি জামিল সিদ্দিকী : ঐক্যসূত্র ছিল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য অন্যায়ের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হওয়া। ইসলামী দলগুলো একত্রে ময়দানে নেমেছে। কওমি আলেমরা কোনো ব্যক্তিগত লাভের আশায় নয়; বরং বিবেক ও দায়িত্ববোধে মাঠে নেমেছে। শাহাদাতের তামান্না ও আদর্শিক দায় তাদের ঐক্যবদ্ধ করেছে।
নয়া দিগন্ত : আগামীর বাংলাদেশ ও কওমি নেতৃত্বের ভবিষ্যৎ কেমন দেখছেন?
মুফতি জামিল সিদ্দিকী : আমি এমন বাংলাদেশ দেখতে চাই, যেখানে দ্বীন ও দুনিয়া পরস্পরের সহযাত্রী হবে। ইসলামী মূল্যবোধে গঠিত সমাজ, ইনসাফ, শিক্ষায় সমতা ও কওমি স্বীকৃতির পূর্ণ বাস্তবায়ন হবে। বাংলাদেশপন্থা ও ইসলামপন্থা একাকার হয়ে দেশকে নেতৃত্ব দেবে। আমরা শুধু দোয়া নয়, দাওয়াহ ও নেতৃত্বের মাধ্যমে দেশের ভবিষ্যৎ গড়তে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। ইনশাআল্লাহ, আমরা চূড়ান্ত ইসলামী বিজয়ের লক্ষ্যেই এগিয়ে যাচ্ছি।