মুফতি নিজাম উদ্দিন আল আদনান

হেফাজতের প্রতিটা পদক্ষেপ অভ্যুত্থানে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে

অভ্যুত্থানের নানা অভিজ্ঞতা, স্মৃতিচারণ ও অভ্যুত্থান পরবর্তী কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ নিয়ে তিনি কথা বলেছেন নয়া দিগন্ত অনলাইনের সাথে। যেখানে ফুটে উঠেছে আন্দোলনে কওমি ছাত্র-শিক্ষকদের অসীম সাহসিকতা, দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের আবেগঘন বর্ণনা।

বেলায়েত হুসাইন
মুফতি নিজাম উদ্দিন আল আদনান
মুফতি নিজাম উদ্দিন আল আদনান |সংগৃহীত

মুফতি নিজাম উদ্দিন আল আদনান। গত দেড় দশকে কওমি অঙ্গনের যেসব তরুণ সামনের কাতারে থেকে ফ্যাসিবাদ বিরোধী প্রায় প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম। তরুণ এই আলেম জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য ও ছাত্র জমিয়ত বাংলাদেশের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি। জুলাই অভ্যুত্থানেও ছিল তার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও অংশগ্রহণ। আন্দোলন-সংগ্রামের সেই উত্তাল দিনগুলোতে নানা ভয়াবহতার সম্মুখীন হয়েছেন এই তরুণ আলেম।

অভ্যুত্থানের নানা অভিজ্ঞতা, স্মৃতিচারণ ও অভ্যুত্থান পরবর্তী কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ নিয়ে তিনি কথা বলেছেন নয়া দিগন্ত অনলাইনের সাথে। যেখানে ফুটে উঠেছে আন্দোলনে কওমি ছাত্র-শিক্ষকদের অসীম সাহসিকতা, দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের আবেগঘন বর্ণনা।

নয়া দিগন্ত : জুলাই অভ্যুত্থানে কওমি মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকের অংশগ্রহণ ছিল অত্যন্ত লক্ষণীয়। আপনি কিভাবে এর সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন?

মুফতি নিজাম উদ্দিন আল আদনান : আমি সরাসরি মাঠে থেকেই আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলাম। আমি তখন ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠন ছাত্র জমিয়ত বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নেতৃত্বে গঠিত ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র ঐক্যের সমন্বয়ক সদস্য এবং কওমিপন্থী ও সমমনা ১৪টি ছাত্র সংগঠনের সম্মিলিত একক প্লাটর্ফম সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের মুখপাত্র।

আমরা সাংগঠনিকভাবে শিক্ষার্থীদের বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনে একাত্মতা পোষণ করি। সেই সাথে সহযোদ্ধাদের নিয়ে একদম শুরু থেকেই মাঠপর্যায়ে তৎপর থাকার চেষ্টা করেছি নানা প্রতিকূলতার মাঝেও। সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য এবং ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র ঐক্যের সুবাদে শুরু থেকেই সব বিষয়ে খোঁজখবর ছিলো আমার কাছে, এবং আমার সাথে প্রায় সকল ঘরনার কেন্দ্রীয় শীর্ষ নেতৃবৃন্দের সাথে কন্টিনিউ যোগাযোগ ছিল। আমরা পরিস্থিতি কখন কোন দিকে যাচ্ছে- এটি আদান-প্রদান করতাম।

Rafiqul-Islam-Khan-02

যৌক্তিক ফ্যাসিবাদবিরোধী এ আন্দোলনকে কিভাবে বেগবান করা যায়, সে বিষয়ে আমাদের ছাত্র জমিয়ত বাংলাদেশ ও সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য এবং ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র ঐক্যের বৈঠকে বারবার আলোচনা হতো। আমরা হেকমত হিসেবে ব্যানার বিহীন মাঠে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছি।

নয়া দিগন্ত : মাঠ পর্যায়ে আপনার প্রত্যক্ষ ভূমিকা ও অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাই! আর আপনার এই অংশগ্রহণকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করেন?

মুফতি নিজাম উদ্দিন আল আদনান : জুলাইয়ে প্রতিদিন আন্দোলনে বিশেষ করে জাতীয় শহীদ মিনার, শাহবাগ, পল্টন, প্রেসক্লাব, সেগুনবাগিচা, বিজয়নগর পানির ট্যাঙ্ক সংলগ্ন, কালভার্ট রোডে শিক্ষার্থীদের সাথে সরাসরি আন্দোলনে অংশগ্রহণ করি। সংগ্রামমুখর সে সময়ে গভীর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন-রাত পার করতে হতো।

১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র সমাজের কেন্দ্রীয় সভাপতি এহতেশামুল হক সাখি ভাইসহ আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম পল্টন মোড় ব্লক করবো। যেই কথা সেই কাজ। মাগরিবের আগেই পল্টন মোড়ে আমরা ছাত্রজনতা অবস্থান নিলাম। সেখানেই মাগরিবের জামাত হলো। মাগরিবের নামাজের ইমামতি করলেন আমাদের সহযোদ্ধা আমীর জিহাদী। নামাজের পর থেকেই ছাত্রজনতার সাহসী স্লোগান চলছিল। কিছুক্ষণ পর পর ছাত্রলীগের কর্মীরা আমাদের দিকে ধেয়ে আসছিলো। আমরাও তাদেরকে মোকাবেলা করছিলাম। সেই রাতে পল্টন মোড়ে আমার সাথে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের নেতা আহমেদ ইসহাক, মোশাররফ হোসেন, ছাত্র জমিয়তের বর্তমান সভাপতি খালেদ মাহমুদ, আমাদের বন্ধু জামিল সিদ্দিকী ও আহমদ আব্দুল্লাহ মুসাসহ আরো অনেকেই ছিলেন।

১৯ জুলাই শুক্রবার। আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম পুনরায় পল্টন মোড়ে জমায়েতের। সকাল থেকেই পল্টন মোড়ে বিভিন্ন দল ঝটিকা মিছিল সহকারে অবস্থান নিতে থাকে। দুপুর ১২টার দিকে পুলিশের বেপরোয়া আক্রমণে আমরা বিভিন্ন গলিতে অবস্থান নিই। পুলিশ অনবরত টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ছে। এমনকি জাতীয় মসজিদের ভেতরেও প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। আন্দোলনকারী বলে তাড়িয়ে দিচ্ছিলো তারা। তবে মসজিদের ভেতরে কিছু ভাইদের সহযোগিতার কারণে আমরা কোনোভাবে মসজিদে প্রবেশ করতে পেরেছিলাম। কিছুক্ষণ পরে আমরা পল্টন মোড় হয়ে বিজয়নগর পানির ট্যাঙ্ক এলাকায় যেতে চাইলে পুলিশের সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ারগ্যাসে চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসছে, এবং ধাওয়া করায় দৌড়ে পল্টন মসজিদে অবস্থান নিতে চাইলে টিয়ারগ্যাসে চোখ অন্ধকার হয়ে পড়ে যাই। কেউ একজন টেনে মসজিদের গেটের ভেতরে নিয়ে যায়। যদি না মসজিদের ভেতরে না নিয়ে যেত, তাহলে পেছনের পুলিশের ফায়ারে তখনি হয়ত শেষ হয়ে যেতাম।

Rafiqul-Islam-Khan-03

একদিন পল্টন কালভার্ট রোডে আমাদের জমিয়তের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা ওয়ালী উল্লাহ আরমান ভাই বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন নাছিরসহ দায়িত্বশীলদের নেতৃত্বে তুমুল প্রতিরোধ গড়ে তুলি। সেখানে রক্তপিপাসু পুলিশের বড়সড় একটি দল গুলি ছুড়তে ছুড়তে আমাদের দিকে এগিয়ে আসে। বাধ্য হয়ে আমাদেরকে পিছু হটতে হয়। পুলিশের গুলিতে পল্টন টাওয়ারের সামনে অন্তত তিনজন আন্দোলনকারী শহীদ হন। তাদের মাথার খুলি উড়ে যায়।

প্রতিজ্ঞা করেছিলাম ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতন নিশ্চিত না করে পিছু হটবো না ইনশাআল্লাহ। ফ্যাসিবাদের পতনের লক্ষ্যে একজন সচেতন নাগরিক ও ছাত্রনেতা হিসেবে জুলাই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করা আমার নৈতিক দায়িত্ব ছিল।

আমার ঢাকাস্থ বাসা মুগদা, মানিকনগর পুকুরপাড়। আমার বাসার পাশেই বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র মজলিসের কেন্দ্রীয় সভাপতি বিলাল আহমদ চৌধুরীর বাসাও। সুতরাং আমরা দু’জন প্রায়দিনই পরিকল্পনা করে একসাথে বের হতাম আন্দোলন-সংগ্রামে। যখন আন্দোলন চরম উত্তাল সেই সময়ে একদিন আছরের পরে মানিকনগর বিশ্বরোডে পুলিশের সাথে আমাদের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হচ্ছে। একপর্যায়ে আমরা একটি হোটেলে আশ্রয় নিই। বাইরে তখন পুলিশ ফায়ার করছে। আমরা ভেতর থেকে শুনতে পাচ্ছি দু’জন জায়গায় শেষ। এমন সময় পুলিশ হোটেলের সাটার ওঠায়, এবং আমি এবং বিলাল ভাইকে লক্ষ্য করে গুলি করে, আল্লাহ রহমতে আমরা বেঁচে যাই। হোটেলের ভেতরে পুলিশ সব তচনচ করছে, তখন আমরা জীবন বাঁচাতে টেবিলের নিচে আশ্রয় নিই, পুলিশ টেবিলের নিচে থেকে টেনে হিচড়ে তুলে আনে, এবং বন্দুকের নল দিয়ে আমাদের পিটায়। এখানেই শেষ নয়, তখন আমাদের নিয়ে যেতে চায় এবং নিয়েই যাবে। তখন আল্লাহ রহমতে এবং হোটেল ম্যানাজার পুলিশের হাত থেকে একপ্রকার টেনেহিঁচড়ে আটকে রাখে আমাদেরকে। এরপর সাটার নামিয়ে তালা মারা হয়। অনেকক্ষণ পরে বাইরের অবস্থা কিছুটা স্বাভাবিক হলে আমরা বের হই।

Rafiqul-Islam-Khan-04

জুলাই আগস্টের আন্দোলনে সরাসরি উৎসাহ উদ্দীপনা এবং সার্বক্ষণিক খোঁজখবর রাখতেন আমাদের জমিয়ত মহাসচিব মাওলানা ড. গোলাম মহিউদ্দিন ইকরাম ভাই। তখন দিন অথবা রাতে সময় করে মহাসচিবের কাছে আমি যেতাম, এবং তিনি আন্দোলনের হেকমত, গতিপথ নিয়ে দিকনির্দেশনা দিতেন।

প্রায় গভীররাতে খোঁজখবর রাখতেন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র ঐক্যের মুখপাত্র আমাদের রাজপথের সহযোদ্ধা সাইফ মাহমুদ জয়েল ভাই।

হোয়াটসঅ্যাপ, স্কাইপ বা অন্যান্য মাধ্যমে ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সভাপতি শরীফুল ইসলাম রিয়াদ, ছাত্রশিবিরের সভাপতি মঞ্জুরুল ইসলাম, জাগপা ছাত্রলীগের সভাপতি আব্দুর রহমান ফারুকি, ছাত্র মিশনের সভাপতি সৈয়দ মিলন, এনডিমের সভাপতি মাসুদ রানা জুয়েল, ছাত্র মজলিস সভাপতি খালেদ সাইফুল্লাহসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সাথে আন্দোলনের গতিপথ নিয়ে কথা হতো।

জাতীয় শহীদ মিনার, ঢাবি এলাকায় মিছিলে স্লোগানে স্লোগানে উদ্দীপ্ত করতাম আমি নিজাম উদ্দিন আল আদনান ও ছাত্র ফোরামের সাবেক সভাপতি মুহাম্মদুল্লাহ মধু ভাই, মিছিলে কোরাস কণ্ঠ ধরতেন ছাত্র জমিয়ত বাংলাদেশের সভাপতি খালেদ মাহমুদ, সিনিয়র সহসভাপতি আহমদ ইসলামাবাদী, ছাত্র ফোরামের সভাপতি সানজিদ রহমান শুভ, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র মজলিসের সেক্রেটারি জেনারেল কে এম ইমরান হুসাইন প্রমুখ নেতৃবৃন্দ।

পল্টন থেকে ছাত্র জমিয়ত বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক ফেরদাউস রুম্মানকে সাথে নিয়ে মতিঝিল নটরডেমর দিকে যাওয়ার সময় আমাদেরকে পুলিশ ফায়ার করে, তখন আমরা কোনোভাবে ব্যাংক কলনীতে গিয়ে আত্মরক্ষা করি।

ছাত্র জমিয়ত ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি, প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির ছাত্র আরাফত আল মিসবাহ রামপুরায় প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের নিয়ে আন্দোলন চাঙ্গা রাখেন। একদিন ফোন করে বলেন- ভাই এদিকে একটু আসুন, আমাদের সাহস দিয়ে যান। আমি আল্লাহ ভরসা করে রামপুরার দিকে রওয়ানা হই, এবং পৌঁছাই, সেখাসে গিয়ে দেখি পুলিশ স্নাইপার দিয়ে ছাত্রদের শহীদ করছে। আহত কয়েকজনকে রামপুরা বেটার লাইফ হসপিটালে ভর্তি করে স্থান পরিবর্তন করতে বাধ্য হই।

আসল কথা, শুধু জুলাই-আগস্ট নয়, গত কয়েকবছর আমি সরাসরি ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রামে সম্মুখ সারি থেকে অংশগ্রহণ করেছি। বিশেষ করে ২১-২২-২৩-২৪ এই চার বছর সরাসরি জমিয়ত মহাসচিব মাওলানা ড. গোলাম মহিউদ্দিন ইকরামের নেতৃত্বে কখনো জমিয়তের ব্যানারে, কখনো ১২ দলীয় জোটের ব্যানারে আমরা রাজপথে ফ্যাসিস্ট হাসিনার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি। এখনো মনে আছে ২৪ সালের ৭ জানুয়ারি হাসিনার ডামি নির্বাচনের দিন আমরা মুখে কালো পট্টি বেঁধে ‘বয়কট নির্বাচন’ স্লোগান দিয়ে মিছিল করেছি প্রেস ক্লাব থেকে পল্টন মোড় পর্যন্ত। তখন বয়কট মিছিল দূরের কথা, বের হওয়াই ছিলো চ্যালেঞ্জের বিষয়। আমি যদি আরো সহজে সংক্ষেপে বলি- আমার এই বয়সে গত ১২-১৪ বছর সরাসরি রাজধানীতে ফ্যাসিবাদের আন্দোলনে সময় ব্যায় করেছি। আমরা যখন ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে মিছিল-সমাবেশ করতাম তখন এখনের স্টেক দাবিকরা অনেক দল নিরবতা বা ‘হেকমত’ অবলম্বন করে চলতেন।

Rafiqul-Islam-Khan-05

নয়া দিগন্ত : অভ্যুত্থানে শুধু কওমি অঙ্গনেই প্রায় অর্ধশত শহীদ হয়েছেন, তাদের এই ত্যাগের বিনিময় কি আপনারা পেয়েছেন এবং তাদের স্মরণে ও সম্মানে কী পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন?

মুফতি নিজাম উদ্দিন আল আদনান : প্রকৃত অর্থে কওমি অঙ্গনের শিক্ষার্থীরা কোনো বিনিময়ের জন্য সংগ্রাম করেনি। শুধুমাত্র দেশের ভালোবাসায় দেশকে জালেমের শাসন থেকে উদ্ধার করতেই লড়াই করেছেন, সংগ্রাম করেছেন। তবে সকল ত্যাগেরই একটি মর্যাদা ও স্বীকৃতি থাকাটা নীতিসঙ্গত। কিন্তু সত্যিকার অর্থে তেমন কিছুই আমরা পাইনি।

ইতোমধ্যে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের অবদান স্মরণে সরকার একটি দিবস ঘোষণা করেছে। সেদিনকে ঘিরে সারাদেশে তাদের স্মরণে দোয়া মাহফিল ইত্যাদি কিছু আনুষ্ঠানিকতা হবে (এরই মধ্যে দিনটি অতিবাহিত হয়ে গেছে)। আমি মনে করি- শুধু এতোটুকুতেই সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। শাহাদাতবরণকারী ভাইদের জন্য রাষ্ট্রীয় সম্মাননা, স্থায়ী আর্থিক সুবিধা এবং কওমি অঙ্গনকে বিশেষ সম্মাননায় ভূষিত করতে হবে। জুলাই ঘোষণা ও জুলাই সনদে আলেমসমাজ ও মাদরাসা শিক্ষার্থীদের আত্মত্যাগ ও বলিষ্ঠ অবদানের মর্যাদাপূর্ণ স্বীকৃতি থাকতে হবে।

নয়া দিগন্ত : আন্দোলন চলাকালে হেফাজতে ইসলাম অভ্যুত্থানে নিহতদের ‘শহীদ’ আখ্যা দিয়েছিলো। এই ঘোষণা আন্দোলনের গতি বাড়ানোর ক্ষেত্রে কিংবা আন্দোলনে ইতিবাচক কোনো প্রভাব ফেলেছিলো কিনা?

মুফতি নিজাম উদ্দিন আল আদনান : আন্দোলন চলাকালে প্রতিমুহূর্তে হেফাজতে ইসলাম সাহসিকতার সাথে কাজ করেছে। সেই সময় হেফাজতে ইসলাম চৌকস ও সাহসী অভিভাবকের ভূমিকায় ছিল। হেফাজতের প্রতিটা পদক্ষেপ আন্দোলনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

নয়া দিগন্ত : রাজনৈতিক কোনো ব্যানারের বাইরে গণ-অভ্যুত্থানে কওমি আলেমদের এই যে বৃহৎ অংশগ্রহণ, তাতে দেশের মানুষের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা ও মূল্যায়ন বৃদ্ধি পেয়েছে নাকি অবনতি হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?

মুফতি নিজাম উদ্দিন আল আদনান : ব্যানার বিহীন আন্দোলন দেশের মানুষের একটা জোরালো দাবি ছিল। তেমনই আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন ও স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করে কওমি আলেমগণ মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছেন।

নয়া দিগন্ত : আন্দোলনের সময় রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন, গ্রেফতার, নির্যাতন ইত্যাদি নিয়ে কী ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে আপনাদের?

মুফতি নিজাম উদ্দিন আল আদনান : আন্দোলন চলাকালে প্রতিমুহূর্তে গ্রেফতার আতঙ্কে থাকতে হতো। কোনোদিন রাতে বাসায় থাকা হতো না। প্রতিরাতে ফ্লাটের ভেতরে পরিবারকে রেখে বাইরে তালা মেরে আমি চলে যেতাম বিভিন্ন জায়গায়, সর্তকার জন্য একেকদিন একেক জায়গায় রাত পার করতাম।

নয়া দিগন্ত : আন্দোলনে অংশগ্রহণের পেছনে কওমি ছাত্র-শিক্ষকদের নৈতিক ও আদর্শিক প্রেরণা কী ছিল? তারা কেন এই অভ্যুত্থানের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করলেন?

Rafiqul-Islam-Khan-06

মুফতি নিজাম উদ্দিন আল আদনান : আন্দোলনে অংশগ্রহণের পেছনে তাদের নৈতিক ও আদর্শিক প্রেরণা ছিলো বৈষমমুক্ত, ইনসাফভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণে ইসলামের শিক্ষা ও স্বচ্ছ দেশপ্রেম। কওমি মাদরাসায় খুব গুরুত্বের সাথে এ বিষয়গুলো শেখানো হয়।

নয়া দিগন্ত : ইন্টারনেট ও মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ থাকার সময়ও মাঠে উপস্থিত জনশক্তির মধ্যে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ কিভাবে বজায় রাখা হয়েছিল?

মুফতি নিজাম উদ্দিন আল আদনান : ইন্টারনেট, মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ থাকাকালীন বিভিন্ন বিকল্প অ্যাপস ব্যবহার করে নেট সচল রাখার চেষ্টা করতাম। কিন্তু কখনো সব কিছু বন্ধ হয়ে গেলে ধৈর্য ধরে পরবর্তী সংবাদের অপেক্ষায় থাকতাম। বাটন ফোনে কিছু যোগাযোগ হতো, যাদের সাথে সম্ভব। তবে তখন কল রের্কডের ভয় পেতাম না। মনে হতো ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে আমরা ক্ষমতা থেকে নামিয়েই ছাড়বো। আলহামদুলিল্লাহ তাই হয়েছে।

নয়া দিগন্ত : ভবিষ্যতের বাংলাদেশ কেমন দেখতে চান? ইসলামী নেতৃত্ব ও কওমি আলেমদের ভূমিকা আপনি কিভাবে কল্পনা করেন?

মুফতি নিজাম উদ্দিন আল আদনান : ফ্যাসিবাদ ও বৈষম্যমুক্ত একটি বাংলাদেশ চাই। আর আল্লাহ জমিনে আল্লাহ নেযাম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই সম্ভব তেমন বাংলাদেশ গড়া। ইসলামী দলগুলো যেকোনো বৈধ পন্থায় সংসদে উল্লেখযোগ্য প্রতিনিধিত্ব করার মাধ্যমেই সে পথ সুগম করতে হবে বলে আমি মনে করি।