আসাদুজ্জামান আসাদ

দেশের ৮০ ভাগ শিল্পীই ফ্যাসিস্টের দোসর হিসেবে কাজ করেছেন

বাচ্চা স্টুডেন্টদের পাখির মতো হত্যার কারণে মানুষের ক্ষোভ চরমে ওঠে

আসাদুজ্জামান আসাদ একজন সফল মডেল ও অভিনেতা। জুলাই অভ্যুত্থানের উত্তাল সময়ে ছাত্র-জনতার সাথে সরাসরি আন্দোলনে অংশ নিয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন তিনি।

বেলায়েত হুসাইন
আসাদুজ্জামান আসাদ
আসাদুজ্জামান আসাদ |সংগৃহীত

আসাদুজ্জামান আসাদ একজন সফল মডেল ও অভিনেতা। দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে বিজ্ঞাপনচিত্রে অভিনয় করছেন। পাশাপাশি তাকে দেখা গেছে বেশকিছু নাটক ও সিনেমাতেও। অথচ কাজের বিবেচনায় তিনি ততটা আলোচিত হননি। তবে জুলাই অভ্যুত্থানের উত্তাল সময়ে ছাত্র-জনতার সাথে সরাসরি আন্দোলনে অংশ নিয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। একইসাথে সে সময় তিনি একটি ‘বিস্ফোরক’ বক্তব্য দেন, যা স্বাধীনতাকামী সকল শ্রেণির মানুষের কাছে তাকে প্রিয় করে তোলে।

অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে তিনি কথা বলেছেন নয়া দিগন্ত অনলাইনের সাথে, যেখানে ফুটে উঠেছে তার অব্যক্ত নানা কথা।

নয়া দিগন্ত : আপনি তো একজন প্রতিষ্ঠিত মডেল ও বিজ্ঞাপন অভিনেতা। বয়সের বিবেচনায় আপনার তো কোটাবিরোধী আন্দোলনে সরাসরি লাভের কিছু ছিল না। তাহলে কী বোধ আপনাকে আন্দোলনের রাস্তায় টেনে নিয়ে এলো?

আসাদুজ্জামান আসাদ : ধন্যবাদ আপনার প্রশ্নের জন্য। দেখেন- আমি বিজ্ঞাপনের মডেল বা বিজ্ঞাপন করছি অনেক বছর ধরে। সেটার সাথে কোটা বিরোধী আন্দোলনের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এটা আমার একটা প্রফেশন। দ্যাটস ইট। আর কোটা বিরোধী আন্দোলনে আমার ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থও ছিল না ঠিক আছে, কিন্তু সবার আগে আমি একজন বাংলাদেশী নাগরিক এবং আমার দেশের স্বার্থে, দেশের মানুষের স্বার্থে, দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে আমি তো শুধু দর্শকের ভূমিকা পালন করতে পারি না। আমার নিজের একটা দায়িত্ববোধ আছে, সেই দায়িত্ববোধ থেকে আমার কাছে মনে হয়েছে যে এটা অন্যায় এবং এটা মানবধিকার লঙ্ঘন, যেটা দেখে আমি চুপ করে টিভি স্ক্রিনে নিউজ দেখতে কিংবা ফেসবুকে স্ক্রল করে শুধু পরিস্থিতি দেখতে পারি না। বলা যায়- ওই তাগিদ থেকে, ওই চেতনা থেকে আমার কাছে মনে হলো যে- আমার অবশ্যই রাস্তায় নামা উচিত। আমি আল্টিমেটলি রাস্তায় নেমেছি। ধন্যবাদ আপনাকে।

Asaduzzaman-02

নয়া দিগন্ত : অভ্যুত্থান চলাকালীন আপনার ভাইরাল সেই বক্তব্যে ‘আপনাদের দাবি কী?’ প্রশ্নে যে ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছিল, সেটা কি আপনার দীর্ঘদিনের ভেতরে জমে থাকা ক্ষোভ ও যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ ছিল? সেই মুহূর্তে আপনার মনে কী চলছিল?

আসাদুজ্জামান আসাদ : আসলে এটা তো অবশ্যই ছিল। যেহেতু অনেক বছর ধরে আমরা দেখছিলাম যে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন ছিল না, ফের বাকশাল কায়েমের চেষ্টা চলছিল এবং যেকোনো গণমাধ্যম বলেন কিংবা সাধারণ মানুষ- কারো কোনোরকম রাইটস ও অধিকার ছিল না, কেউ কিছু বলতে পারছে না; যেটাই চাপিয়ে দিয়েছিল সেটাই আসলে মেনে নিতে হচ্ছিল। এগুলো আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছিল আইন ও প্রশাসন দিয়ে কিংবা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় আওয়ামী লীগের গুন্ডা বাহিনীর মাধ্যমে। আসলে বিগত ১৬-১৭ বছর ধরে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই দমনপীড়ন এবং গুম-খুন সবকিছুই স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল। সো এভাবেই মানুষের ক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে এবং সেটা চরমে উঠল, যখন কোটা বিরোধী আন্দোলনকে ইস্যু করে বাচ্চা স্টুডেন্টদের পাখির মতো এই মারা হলো। সেই মুহূর্তে আমার মনে হয়েছিল যে আমার বহিঃপ্রকাশটা আসলে এখনই করা উচিত এবং এই মুহূর্তে করা উচিত। যে কারণে আমি আমার বহিঃপ্রকাশটা বোধ হয় এই পর্যায়ে গিয়েছিল, যেটা আসলে ভাইরাল। অনেকের কাছে মনে হয়েছিল যে, উনি আসলে একদম সঠিক কথাই বলছেন এবং জনগণের ও সমগ্র দেশের মানুষের কথাই আমার কথার মাঝখান দিয়ে বের হয়ে এসেছিল।

নয়া দিগন্ত : আপনি বলেছিলেন, ‘শিক্ষার্থীরাই আমাদের উদ্ধার করেছে।’ আপনি নিজেকে কিভাবে তাদের একজন ভাবতে শুরু করলেন? আন্দোলনের সময় ছাত্রদের মধ্যে কী এমন দেখলেন, যা আপনাকে এতটা নাড়া দিলো?

আসাদুজ্জামান আসাদ : অবশ্যই শিক্ষার্থীরা আমাদেরকে উদ্ধার করেছে। জনবহুল একটা দেশে রাজনৈতিক যেই প্র্যাকটিস- বড় বড় দলগুলো একপ্রকার নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল, তাদেরকে কোনোভাবে মাঠে নামতে দেয়া হচ্ছিল না, সংসদে তাদের কোনো জায়গা ছিল না, গণতান্ত্রিক প্র্যাকটিস ব্যাহত হচ্ছিল বহু বছর ধরেই- এমন একটা পর্যায়ে এরকম বড় আন্দোলনের ক্ষেত্র তৈরি করেছিল শিক্ষার্থীরাই। আমাদের এই ভবিষ্যৎ প্রজন্মই জালিমের বন্দুকের সামনে বুক পেতে দিয়েছিল। তাদের এই অনুপ্রেরণা ও সাহস দেখেই আমরা রাস্তায় নেমেছি।

আর এটাও আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয় যে, আমিও বাংলাদেশের একজন নাগরিক এবং এই বাচ্চারাও এই দেশের ভবিষ্যৎ, তারা যেটা করছে সেটা আমরা করতে পারিনি এবং এটা আমাকে প্রচণ্ড রকমের মানসিক অশান্তি দেয়া শুরু করল। আমার মনে হচ্ছিল যে, আমি আসলে অথর্ব একজন মানুষ। এভাবেই কি বেঁচে থাকব নাকি বাচ্চাদের সাথে দাঁড়িয়ে যাব?- সো সেই তাগিদ থেকে ও বিবেকের তাড়না থেকে আমি আন্দোলনে অংশ নিই। এজন্য আমি শিক্ষার্থীদের প্রতি কৃতজ্ঞ। তাদের সাথে আমি সবসময় ছিলাম, আছি এবং জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত থাকব।

Asaduzzaman-03

নয়া দিগন্ত : আপনি বলছেন, ‘অপরাধ দেখে চুপ থাকা, সেটাও অপরাধ।’ আপনাদের শোবিজে কি কোনো অনিয়ম-অপরাধ নেই? ওই অনিয়মের বিরুদ্ধে শিল্পীমহলে কোনো ঐক্য গড়ে তোলা কি সম্ভব?

আসাদুজ্জামান আসাদ : অবশ্যই অনিয়ম আছে এবং আমি সে অনিয়ম নিয়ে কথা বলেছি, এখনো বলছি। আসলে শিল্পী মহলে যে ধরনের ঐক্য গড়ে ওঠার কথা ছিল, সেটা গড়ে ওঠেনি। পাশাপাশি আমরা জানি যে, বাংলাদেশের শিল্পী সমাজ- সেই ৭১ পরবর্তী বলেন, আবার ৭৫ পরবর্তী বলেন কিংবা এই বিগত ১৬-১৭ বছর বলেন না কেন- তাদের প্রায় বেশিরভাগই ফ্যাসিবাদের দোসর। বাংলাদেশের শিল্পাঙ্গনের প্রায় ৮০ ভাগ শিল্পীই- আওয়ামী লীগ ও ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর হিসেবে কাজ করেছেন, সুবিধা নিয়েছেন, ফায়দা লুটতে গিয়ে দেশদ্রোহী কাজও করেছেন। অনেকে জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে মানুষকে ধোঁকা দিয়েছেন এবং ফ্যাসিবাদের সাথে আঁতাত করে একপ্রকার দেশের বিরুদ্ধে কাজ করেছেন।

নয়া দিগন্ত : আপনার মতো একজন অভিনেতা, যিনি সম্ভবত সাত শতাধিক বিজ্ঞাপনচিত্রে কাজ করেছেন, অথচ মূলধারার গণমাধ্যমে আপনি তেমন আলোচিত নন- এর কারণ কী?

আসাদুজ্জামান আসাদ : দেখেন আমি কতগুলো কাজ করেছি, কতটা আলোচনায় এসেছি- এটা আমার কাছে কখনোই মুখ্য ছিল না। আমি আমার মতো করে কাজ করে গিয়েছি। আর আপনার কাজটাকে আমি অবশ্যই শ্রদ্ধা করি, ভালোবাসি। আসলে এটার অ্যান্সার মিডিয়া ভালো দিতে পারবে যে, তারা কেন আমাকে ওভাবে প্রকাশ করেনি? তবে এটা নিয়ে আমি মোটেও দুঃখ করছি না; বরং আমি আমার কাজটুকুন করতে পারছি এবং তা করতে পারলেই আমি স্যাটিসফাইড। সো এটাকে নিয়ে আলোচনায় আসতে হবে, মেইনস্ট্রিমে আমাকে নিয়ে প্রচণ্ড কাভারেজ দিতে হবে- আমি এটা মনে করি না। আর আলোচনায় না থাকা নিয়ে আমি কখনোই বিচলিত ছিলাম না এবং আমার কাছে এটা মুখ্য বিষয়ও না।

নয়া দিগন্ত : আপনি তো শুরুর দিকে সহকারী পরিচালক ছিলেন। আজ এই দীর্ঘ যাত্রাপথ পেরিয়ে নিজের অবস্থানকে কিভাবে মূল্যায়ন করেন? এই লম্বা পথচলায় আপনার সবচেয়ে বড় শিক্ষা কী?

আসাদুজ্জামান আসাদ : অবস্থান আমার কাছে মনে হয় যে, এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া। কতদূর যেতে পেরেছি সেটা আসলে আমাকে যারা পছন্দ করেন; আমার ফ্যান-ফলোয়ার্স কিংবা দেশের মানুষরাই বলতে পারবেন। তবে আমি এখনো পর্যন্ত নিজে পজিটিভ থাকার চেষ্টা করি। সো আমি যদি নিজে পজিটিভ থাকার চেষ্টা করি, তাহলে আমার দর্শক এবং আমার দেশের মানুষ আমাকে সেভাবে সাপোর্ট দেবেন- সেই বিশ্বাসটা আমার আছে। এবং সেটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় শিক্ষা মনে হয়।

নয়া দিগন্ত : আপনি বলছেন, ‘কাজ বন্ধ হয়ে গেলেও সমস্যা নেই’, তাহলে যদি আন্দোলনের জন্য ভবিষ্যতে পেশাগত ঝুঁকি আসে, আপনি কি তবুও একইভাবে সরব থাকতে প্রস্তুত থাকবেন?

আসাদুজ্জামান আসাদ : হ্যাঁ কাজ বন্ধ হয়ে গেলে সমস্যা নেই। পেশাগত ঝুঁকি এসেছে, আসছে। মাঝখানে এক ধরনের ঝামেলা চলছিল। একটু ঠিক হয়েছে। আবার হয়তো সামনে আসবে, পট পরিবর্তন হওয়ার সাথে সাথে। কিন্তু তাই বলে কি আমি আমার দেশের জন্য কথা বলবো না। রুটি-রুজি হচ্ছে আল্লাহ প্রদত্ত, সো আমি সেটা নিয়ে চিন্তা করি না। আমি বিশ্বাস করি- সবকিছুই সময়ের সাথে সাথে ঠিক হয়ে যায় এবং যেকোনো পরিস্থিতির জন্য আমি প্রস্তুত আছি এবং এটাই হচ্ছে আমার মনোবল, আর আমার দেশপ্রেমটা হচ্ছে চালিকা শক্তি। দ্যাটস ইট!