জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের গণভোটের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর একমত হলেও ভোটের দিনক্ষণ নিয়ে এক জায়গায় আসতে পারেনি। এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে অন্তর্বর্তী সরকারকে একটি প্যাকেজ প্রস্তাব করবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
মতামতের থাকছে, প্রথমে বিশেষ আদেশ জারি করা যার ভিত্তিতে গণভোট অনুষ্ঠিত হবে এবং পরবর্তী জাতীয় সংসদকে দ্বৈত ভূমিকা- যারা একই সাথে সংবিধান সংস্কার পরিষদ সভা এবং নিয়মিত জাতীয় সংসদের ভূমিকা পালন করবে। তবে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পরিষদকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করবে। কিন্তু গণভোটের দিনক্ষণ কমিশন সরকারের ওপর ছেড়ে দেবে বলে জানা গেছে।
সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে বুধবার (৮ অক্টোবর) কমিশনের সাথে সংলাপে এ রাজনৈতিক দলগুলো একমত হতে পারেনি। বিকেল ৩টায় বিরতি দিয়ে রাত সোয়া ১১টায় বৈঠক শেষ হয়। শুরু হওয়া বৈঠকে সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে গণভোট কখন ও কি আদেশে হবে সেটি নিয়ে বিভক্তি দেখা যায়। বিএনপি ভোটের দিন গণভোট চেয়েছে। জামায়াত এবং এনসিপি চায় সংবিধান বা জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের ভিত্তিতে জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট।
বৈঠকের সমাপনী বক্তব্যে কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা আজ সারাদিনের আলোচনার সারাংশ নিয়েছি এবং বিশেষজ্ঞদের মতামতের আলোকে সরকারকে দ্রুত পরামর্শ দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি।’
তিনি জানান, বিশেষজ্ঞরা সর্বসম্মতভাবে পাঁচটি প্রস্তাব দিয়েছেন— জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের জন্য একটি বিশেষ আদেশ জারি করতে হবে; ওই আদেশের মাধ্যমেই গণভোট আয়োজন করতে হবে; গণভোটে দুটি আলাদা প্রশ্ন রাখতে হবে, যাতে ঐকমত্য ও মতবিরোধ উভয় বিষয় স্পষ্ট হয়; নির্বাচনের মাধ্যমে সংবিধান সংস্কার পরিষদ ও ১৩তম জাতীয় সংসদ গঠন করতে হবে; গণভোটে অনুমোদনের পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জুলাই সনদে বর্ণিত সংস্কার সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
কমিশনের আলোচনায় রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে দুটি প্রস্তাব উঠে এসেছে। একাধিক দল জাতীয় নির্বাচনের দিনই পৃথক ব্যালটে গণভোট নেয়ার পক্ষে, আর কয়েকটি দল নির্বাচনের আগে গণভোট আয়োজনের প্রস্তাব দিয়েছে। তবে কমিশনের মতে, সবাই একমত যে সংসদকে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য সংবিধানের কাঠামোগত পরিবর্তনের ক্ষমতা দেয়া উচিত।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘আমরা আগামী এক-দুই দিনের মধ্যে চূড়ান্তভাবে মতামত সমন্বয় করে সরকারকে পরামর্শ দেব। পাশাপাশি অংশগ্রহণকারী সব রাজনৈতিক দল ও জোটকে অবহিত করা হবে।’
তিনি আরো জানান, কমিশনের মেয়াদ শেষ হবে ১৫ অক্টোবর। এর মধ্যে তারা জুলাই সনদের ওপর একটি সাক্ষরদান অনুষ্ঠান আয়োজন করতে চান।
এর আগে জাতীয় নির্বাচনের দিন একইসাথে গণভোট দেয়ার পক্ষে মত তুলে ধরে বিএনপি। দলটির বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের অল্প সময় বাকী আছে। এর আগে গণভোটের মত মহাযজ্ঞ আয়োজন করা সম্ভব নয়। এতে অতিরিক্ত অর্থও খরচ হবে। তারা মনে করেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট করার প্রস্তাব জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত করার প্রয়াস হবে।’
আর সনদের অঙ্গিকারে একটি বিষয় যুক্ত করতে হবে যে, যেসব দলের যে যে বিষয়ে ভিন্নমত আছে সেগুলো তারা নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখ করবে। জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী হলে সে দল তাদের ভিন্নমত অনুসারে প্রস্তাব বাস্তবায়ন করতে পারবে।
জাতীয় নির্বাচনের দিন একইসাথে গণভোট দেয়ার পক্ষে মত তুলে ধরে বিএনপির বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের অল্প সময় বাকী আছে। এর আগে গণভোটের মত মহাযজ্ঞ আয়োজন করা সম্ভব নয়। এতে অতিরিক্ত অর্থও খরচ হবে। তারা মনে করেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট করার প্রস্তাব জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত করার প্রয়াস হবে।’
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘জুলাই জাতীয় সনদের গাঠনিক ক্ষমতা জনগণের কাছ থেকেই আসবে, এবং সেই ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যম হবে গণভোট। তার মতে, গণভোটের মাধ্যমে জনগণ যদি সনদ অনুমোদন করে, তাহলে পরবর্তী সংসদের দায়িত্ব হবে সনদের ঘোষিত দফাগুলো বাস্তবায়ন করা।’
তিনি বলেন, ‘গণভোটের মাধ্যমে জনগণ যে অনুমোদন দেবে, সেটাই সংসদের ওপর বাধ্যতামূলক ম্যান্ডেট তৈরি করবে।’
তবে তিনি স্পষ্ট করেন যে, এর মানে এই নয় যে ভবিষ্যৎ সংসদ অন্য কোনো সংস্কার করতে পারবে না—তবে জুলাই সনদের ধারাগুলো অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে।
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সংসদের প্রথম অধিবেশনের মধ্যে সনদ বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা দিলে তা বাস্তবে জটিল হতে পারে। তিনি প্রস্তাব দেন, ‘যথাশীঘ্র সম্ভব’ বাক্যটি উল্লেখ করে সংসদকে প্রয়োজনীয় সময় দেয়ার সুযোগ রাখতে হবে, যাতে নিয়ম পরিবর্তন ও আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা যায়।’
তিনি আরো বলেন, ‘আপার হাউস গঠন বা সেকেন্ড হাউস প্রতিষ্ঠার বিষয়টি সনদ গৃহীত হওয়ার পরই বিবেচনা করা যেতে পারে।’
নোট অব ডিসেন্ট প্রসঙ্গে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ভিন্নমত বা আপত্তি থাকলেও তা জুলাই সনদের অংশ হিসেবেই গণভোটে যাবে, এবং ভবিষ্যতে কোনো দল জনগণের ম্যান্ডেট পেলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারবে।’
তিনি বলেন, ‘একই দিনে নির্বাচন ও গণভোট হলে জনগণ একাধিক ব্যালটে ভোট দিতে পারবে—এটা আমাদের নির্বাচনী সংস্কৃতিতে নতুন কিছু নয়। এতে সময়, অর্থ ও প্রশাসনিক জটিলতা—সবই কমে যাবে। জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে, এবং সেই প্রজ্ঞাপনের ভিত্তিতেই গণভোট আয়োজন করা হবে। গণভোট আইন বা অধ্যাদেশে উল্লেখ থাকবে যে, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য জনগণের সম্মতি নেওয়া আবশ্যক। প্রয়োজনে নির্বাচন কমিশন ও সরকারের মধ্যে আলোচনা করে গণভোটের বিধিবিধান নির্ধারণ করা হবে ‘
আলোচনায় অংশ নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর প্রতিনিধি আইনজীবী শিশির মনির বলেন, ‘বিশেষ সংবিধান আদেশ বা জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের প্রয়োজন আছে। এই আদেশে গণভোটের কথা বলা থাকবে। তফসিলে জুলাই সনদ থাকবে। আদেশের ভিত্তিতে গণভোট হবে। আর আগামী সংসদের দুটি ক্ষমতা থাকবে। একটি সাধারণ সংসদের ক্ষমতা অন্যটি কনস্টুয়েন্ট পাওয়ার বা গাঠনিক ক্ষমতা। সংসদের প্রথম অধিবশেনে এই ক্ষমতা থাকবে। দি্বতীয় অধিবেশন থেকে সাধারণ সংসদ কাজ করবে। এভাবে হলে সংস্কার টেকসই হবে।’
তিনি বলেন, ‘যে কয়টি বিষয়ে ভিন্নমত আছে সেগুলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো না হলে সংষ্কার মুখ থুবড়ে পড়বে। তিনি বলেন, গণভোট জাতীয় নির্বাচনের আগে হতে হবে। এখন সিদ্ধান্ত নিলে আগামী নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে গণভোট করা সম্ভব।’
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন বলেন, ‘সংস্কারগুলো আগামীতে প্রশ্নবিদ্ধ হবে বা বাতিল হবে এমন প্রক্রিয়ায় যাওয়া ঠিক হবে না। টেকসই করার বিষয়ে মনযোগ দিতে হবে। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ নামে একটি আদেশ দেয়া উচিত। জুলাই সনদ বাস্তববায়ন করা হবে কি না, এই প্রশ্নে গণভোট দেওয়া এবং আগামী সংসদকে বিশেষ কনস্টুয়েন্ট পাওয়ার দেয়া লাগবে। কারণ সংবিধানের মৌলিক কাঠামোতে হাত দেয়া হচ্ছে। এজন্য সংসদকে বিশেষ ক্ষমতা দিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট হতে হবে। জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোট হলে গুরুত্ব হারাবে।’
দলটির আরেক যুগ্ম আহ্বায়ক সরোয়ার তুষার বলেন, ‘নোট অব ডিসেন্ট কমিয়ে আনতে পারলে বিশেষ করে উচ্চকক্ষে পিআর ভিত্তিতে হবে কিনা। জামায়াতে ইসলামী যদি নিম্নকক্ষে পিআরের দাবি ছেড়ে দেয় আর বিএনপি যদি উচ্চকক্ষে পিআর মেনে নেয় এটা একটা ভাল ট্রেড হতে পারে।’
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটের দিন গণভোটের আয়োজনের পক্ষ মত দিয়ে গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, সিপিবি, বাসদ, বাংলাদেশ জাসদ, এলডিপি। গণতন্ত্র মঞ্চ সংবিধান বা জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের ভিত্তিতে গণভোট চেয়েছে। একই সাথে সনদের উল্লেখ থাকবে আগামী জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশের নাম হবে সংবিধান সংস্কার সভা এবং নোট অব ডিসেন্টের বিষয়টি আলোচনার মাধ্যমে সমাধান। সিপিবি-বাসদসহ সমমনা দলগুলো সংবিধান আদেশের বিপরীতে ১৯৯১ সালের গণভোট আইন অনুযায়ী ভোটের দিন গণভোট করার প্রস্তাব করে।
বিএনপির সমমনা দলগুলো অধ্যাদেশের মাধ্যমে ভোটের দিন গণভোট করার প্রস্তাব দেন এবং নিয়মিত সংসদের সংবিধান সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলো সুরাহা করার প্রস্তাব দেয়।
এদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকের আগে বুধবার দুপুর ১২টা থেকে প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী বিশেষজ্ঞদের সাথে বৈঠক করে কমিশন। সেখানে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের বিভিন্ন উপায় নিয়ে কথা বলেন।
বিশেষজ্ঞরা জানান, অধ্যাদেশের অধীনে গণভোটের আয়োজন করলে জটিলতা তৈরি হতে পারে। কারণ অধ্যাদেশ পরবর্তী সংসদ অধিবেশনের ৩০ দিনের মধ্যে সংসদে পাশ করতে হয়। কোনো কারণে সেটি না হলে অধ্যাদেশটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে অধ্যাদেশ বাতিল হয়ে যাবে। তাই জুলাই ঘোষণাপত্রের অধীনে সংবিধান বা জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের অধীনে গণভোট করার পক্ষে মত দেয়। পরবর্তী সংসদকে নিয়মিত সংসদের সংবিধান সংস্কার পরিষদের ক্ষমতা দিতে পরামর্শ দেওয়া হয়। যেটিই সমাধান বলে মনে করে বিশেষজ্ঞরা।
কমিশনের একজন বিশেষজ্ঞ নাম প্রকাশ না করার শর্তে আজকের পত্রিকাকে জানান, শুরুতে কমিশন একসাথে গণভোট ও সংসদ নির্বাচন আয়োজনের পরামর্শ দিলেও এখন তারা বিষয়টিকে ‘প্র্যাক্টিক্যাল ইস্যু’ হিসেবে সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দিতে চাইছে।
তিনি বলেন, ‘প্রথম দিকে মনে হয়েছিল একসাথে করলেই সহজ হবে, কিন্তু এখন অনেকে বলছেন এতে জটিলতা বাড়তে পারে। তাই আমরা এখন আর আগে বা একই দিনে করার কথা বলছি না। সরকার প্র্যাক্টিক্যাল বাস্তবতা দেখে সিদ্ধান্ত নেক—এটাই এখন আমাদের অবস্থান।’
কমিশনের এই বিশেষজ্ঞ জানান, গণভোটে কয়টি প্রশ্ন থাকবে তা নিয়েও বলেন, ভিন্ন মত বা দ্বিমত থাকা বিষয়গুলো আলাদাভাবে রাখতে হতে পারে। তাই একাধিক প্রশ্নের সম্ভাবনাও আছে।
তিনি আরো জানান, কমিশনের পরামর্শগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে চলমান আলোচনার ভিত্তিতেই 'ইভলভ' বা পরিবর্তিত হচ্ছে।
কমিশন সূত্রে জানা গেছে, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মতামত নিয়ে আজকে কমিশন নিজেদের মধ্যে বৈঠক করবে। সেখানে তারা জুলাই সনদ বাস্তবায়নে সরকারকে দিতে যাওয়া সুপারিশের লিখিত চূড়ান্ত করবে। যেটি আগামী ১২ অক্টোবরের আগে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে হস্তান্তর করবে। যেখানে চূড়ান্ত জুলাই সনদ থাকবে।