জুলাই অভ্যুত্থানে সরাসরি অংশ নিয়ে কওমি মাদরাসার প্রায় অর্ধশত শিক্ষক-শিক্ষার্থী শহীদ হয়েছেন, আর আহত হয়েছেন কয়েক শ’। আহতদের দীর্ঘ তালিকার অন্যতম একটি নাম মুস্তাঈন বিল্লাহ হাবিবী। অভ্যুত্থান চলাকালে তিনি রাজধানীর উত্তরায় অবস্থিত দেশের অন্যতম প্রসিদ্ধ কওমি মাদরাসা জামিয়া আরাবিয়া বাইতুস সালামে (বাইতুস সালাম মাদরাসা) মেশকাত জামাতে পড়তেন। সেখান থেকেই সাহসিকতার সাথে আন্দোলনে যুক্ত হন এবং একপর্যায়ে তৎকালীন সরকার সমর্থিত সন্ত্রাসী বাহিনীর ছোড়া গুলিতে আহত হন তিনি।
বর্তমানে যাত্রাবাড়ী বড় মাদরাসায় (জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়া) পড়ুয়া এই যুবক এখনো ওই গুলি দেহে বয়ে বেড়াচ্ছেন।
সম্প্রতি তিনি কথা বলেছেন নয়া দিগন্ত অনলাইনের সাথে। যেখানে ফুটে উঠেছে অভ্যুত্থানে তার অংশ নেয়ার কারণ, অভ্যুত্থানের উত্তাল সময়ে মাঠের বাস্তব চিত্র ও তার অভিজ্ঞতার বর্ণনা এবং অভ্যুত্থান পরবর্তী তার আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন সংক্রান্ত নানা বিষয় নিয়ে।
নয়া দিগন্ত : একজন শিক্ষার্থী হিসেবে জুলাই অভ্যুত্থানে আপনি সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন- আপনি আন্দোলনের সাথে কিভাবে জড়িত হলেন, সেই দিনগুলোর স্মৃতি আমাদের সাথে শেয়ার করার অনুরোধ করছি।
মুস্তাঈন বিল্লাহ : এই আন্দোলনে আমার যুক্ত হওয়াটা কোনো কাকতালীয়ভাবে হয়নি। আমি প্রথমে এ আন্দোলন সম্পর্কে বিস্তারিত জেনেছি, পড়েছি, পরামর্শ করেছি—তারপরেই যুক্ত হয়েছি। যদি বিস্তারিত বলি, আমার আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার ঘটনাটি এভাবে—
জুলাইয়ের শুরু দিকে (২ বা ৩ জুলাই) ব্যক্তিগত কিছু কাজের কারণে আমি নীলক্ষেতে যাই। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় তুমুল আন্দোলন চোখে পড়ে। তখনো পর্যন্ত আমি জানতাম না যে দেশে ‘কোটা-বিরোধী আন্দোলন’ চলছে (কারণ, তখন আমার কাছে অ্যান্ড্রয়েড ফোন ছিল না)। আশেপাশের লোকজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, দেশে কোটা-বিরোধী আন্দোলন চলছে।

মাদরাসায় ফিরে আসার পর বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত জানলাম এবং ২০১৮ সালের কোটা-বিরোধী আন্দোলন সম্পর্কেও পড়াশোনা করলাম—কী ঘটেছিল, কেন ঘটেছিল ইত্যাদি। আমার কাছে এটি একটি যৌক্তিক আন্দোলন মনে হলো।
আসলে আমার একটা অভ্যাস আছে—প্রতি যৌক্তিক আন্দোলনে কিছু না কিছু অংশগ্রহণের চেষ্টা করি। যেমন- ২০১৩ সালের শাপলা চত্বরে, ২০২১ সালের মোদি-বিরোধী আন্দোলনে আমি অংশ নিয়েছিলাম; এমনকি সেই সময় মারাত্মকভাবে আহত হয়ে মাথায় চারটি সেলাইও পড়েছিল।
সেই সূত্র ধরে আমার মনে হলো, ২০২৪ সালের কোটাবিরোধী আন্দোলনে সাধারণ ছাত্র-জনতার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করা জরুরি। আর এইভাবেই আমি এ আন্দোলনের সাথে যুক্ত হই।
নয়া দিগন্ত : আপনি যে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন- ঘটনাটির বিস্তারিত জানতে চাই। কার গুলিতে আহত হলেন, কিভাবে তা ঘটল এবং এর পরবর্তীতে কী হয়েছিল?
মুস্তাঈন বিল্লাহ : উত্তরায় মূলত ১৬ তারিখ থেকে আন্দোলন জোরদার হয়। তো ১৬/১৭ তারিখ আমি কিছু সময়ের জন্য আন্দোলনে যোগদান করি, তবে ১৮ তারিখ থেকে মূলত আন্দোলনে বেশ সরব ছিলাম।
১৯ জুলাই ছিল শুক্রবার। সেদিন জুমার নামাজের পর রাস্তায় থাকি কিছুক্ষণ, তারপর মাদরাসায় ফিরে আসি। আসরের নামাজ পড়ে সেদিন আবার আন্দোলনে যোগ দিই। আমার ক্যাম্পাস র্যাব-১-এর পূর্ব পাশে। আমি যখন পশ্চিম পাশে রাজলক্ষ্মীর দিকে এগুচ্ছিলাম, তখন ছাত্রলীগের গুন্ডা বাহিনী আমাকে ধরে প্রথমে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। পরে যখন জানতে পারে আমি আন্দোলনে যোগ দিতে যাচ্ছি, তখন আমাকে লাঠি দিয়ে মারধর শুরু করে। একপর্যায়ে নিচে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। তারা ভেবেছিল এতে আমি ভয় পেয়ে হয়তো আর ওদিকে যাব না।
কিন্তু আমাকে মেরে তারা যাওয়ার পর আমি উঠে বসে একটু সময় নিয়ে আবার আন্দোলনে যোগ দিতে সামনে এগোই। আমি আগেই জানতাম সাধারণ ছাত্র ভাইদের যেই সমাগমটা আছে, সেটা আজমপুরের দিকে। তাই আমিও সেই দিকেই এগোই ধীরে ধীরে। একপর্যায়ে আমি আজমপুর ছাত্র ভাইদের সাথে যোগ দিই। তখন থেকেই সেখানে বেশ ব্যাপকভাবেই গোলাগুলি চলছিল।

গুলির পরিমাণ বেশ ভয়ানক ছিল। পুলিশ ইউনিফর্ম পরা লোক থেকে শুরু করে সিভিল ড্রেসে গুন্ডা হেলমেট বাহিনী, যুবলীগ—কেউ বাদ ছিল না। ধাপে ধাপে ৭-৮ জন করে এসে গুলি চালাতেই থাকত। আমি তখন ক্রিসেন্ট রোডের দিকে ছিলাম। এই রোডেই মুগ্ধ ভাইও শহীদ হয়েছিলেন।
একটু পরপর তারা ব্যাপক গুলি করে আমাদেরকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়ার চেষ্টা করতে লাগল, আর আমরা পেছনে যেতে লাগলাম। আমাদের মিছিলে আহতের সংখ্যা বাড়তে থাকল, কিন্তু তাদের গুলির জন্য সামনে অগ্রসর হওয়া যাচ্ছিল না। আমরা পিছিয়ে যেতে থাকলাম। তখন অনেকবার পিছিয়ে আসার পর আমাদের দলে থাকা এক ভাই আমাদের সবাইকে একত্রে করে বললেন, ‘ভাই, আমরা এভাবে পিছিয়ে যেতে থাকলে আসলে কোনো লাভ নেই। কিন্তু একটা কিছু করে ওদেরকে ভয় দেখাতে হবে, আর আমাদেরকে আমাদের অন্য ভাইয়েরা, যারা বিএনএস সেন্টারে আছেন তাদের সাথে যোগ দিতে হবে। আমাদের এখানে কোনো লাভের লাভ হচ্ছে না, শুধু আহতের সংখ্যা বাড়ছে।’
তখনই আরেকজন বলে উঠলেন, ‘ভাই, আপনি তো এত সহজে বলছেন যে এগোতে হবে, আমরা তো শুধু শুধু পিছাচ্ছি না। একটা গুলি এসে আপনার গায়ে লাগলে তখন আর এত সহজে আগানোর কথা বলতে পারতেন না।’
ঠিক ওই মোমেন্টে ওই ভাইটা তার শার্ট খুলে দেখায় যে তার পিঠে কয়টা গুলি লেগেছে। আমরা অবাক হয়ে সবাই তাকিয়ে রইলাম। তার পিঠ পুরো ঝাঁঝরা হয়ে গেছে গুলির দাগে। তবুও তিনি কোনো শব্দ করেননি, উল্টো সবাইকে সাহস দিচ্ছেন। মহান আল্লাহর নামে কসম, এই দৃশ্য দেখে মনে হলো আমরাও এগিয়ে যাব। আমি তখন সাথে সাথে বললাম, ‘ভাই, আমি এগোবো আপনার সাথে।’
তখন পেছন থেকে আরো দুইজন বলে উঠল, ‘ভাই, আমরাও এগোবো।’ বাকি সবাইও সম্মতি দিলো। তখন একটা অদ্ভুত মুহূর্তের সাক্ষী হলাম। এতগুলো মানুষের চোখে পানি, কিন্তু সবাই তা আটকানোর চেষ্টা করছে আর মুখে একটা হাসি ছিল। আমরা চারজন তখন হাতে হাত রেখে সামনে এগোতে থাকলাম। পেছনে কম হলেও ৬০-৭০ জন মানুষ হবে।
একটা খুব ইন্টারেস্টিং ঘটনা ঘটে তখন, যা না বললেই নয়। আমাদেরকে সামনে এগোতে দেখে তখন ফুটপাত থেকে একটা ছেলে দৌঁড়ে আসে আর আমাদেরকে বলে, ‘ভাই, সামনের দিকে যাইতেছেন নাকি আপনারা?’ আমি বলি, ‘হ্যাঁ।’ তখন সে বলে, ‘তাইলে একটু খাঁড়ান, একটা জিনিস নিয়ে যান, কাজে লাগবো।’ এই বলে সে বড় একটা ভারী টিনের টুকরো নিয়ে আসে টেনে টেনে আর আমাদেরকে দেয়।

তারপর আমরা ওটা মিছিলের সামনে রেখে এগোতে থাকি। আজমপুরের দিকে আগানোর সময় ব্যাপকভাবে আবার আমাদের মিছিল লক্ষ্য করে গুলি বর্ষণ করা হয় চারদিক থেকে। কয়েক রাউন্ড গুলি আমাদের ওই সামনে রাখা টিনে লাগানোর পর আমাদের মিছিলের সামনে থাকা দুইজন ভাই ভয় পেয়ে টিন ছেড়ে দেয়।
তখন আমাদের ওই প্রতিরোধটাও ভেঙে যায়, আর অনেক ছররা গুলি এসে সবার গায়েই লাগতে থাকে। আমার গায়েও অনেকগুলো ছররা গুলি এসে লাগে। তার একটু পরেই একটা অরিজিনাল বুলেট, প্রায় ১ ইঞ্চি সাইজের আসল বুলেটগুলো আমার হাতে এসে লাগে। আমার হাত দিয়ে রক্ত পড়তে থাকে, কিন্তু তাও আল্লাহর রহমতে গুলি লাগলে অনেকে যেমন বেহুঁশ হয়ে যায় বা আরো যা সমস্যা হয়, আমার তেমন জ্ঞান হারানোর মতো কিছু হয়নি। জানি না আল্লাহ কোথা থেকে এমন শক্তি দিয়েছিলেন সেদিন।
আমার এখনো মনে আছে- আমি মুঠির মধ্যে কোষ কোষ করে ৪-৫ বার রক্ত ফেলছি, হাত দিয়ে পানির মতো রক্ত পড়ছিল। তারপর আমার অবস্থা অনেক খারাপ দেখে ৪-৫ জন ভাই এসে আমাকে ধরে হাসপাতালে নিয়ে যায়। তারপর যা হয়েছে তা আসলে অনেক দুর্ভাগ্যের আর জাহেলিয়াতের মতো। তারা যে কতটা অমানবিক আর তাদের আচরণ যে কতটা পশুর মতো ছিল সেটা বুঝতে পারবেন এখন।
হাসপাতালে যাওয়ার পর আমরা সেখানে ৩০-৪০ জন গুলিবিদ্ধ ছিলাম। ২০ জনের তো কোনো জ্ঞানই নেই। হাসপাতালের অবস্থা খুবই ভয়ানক। ঠিক ওই মুহূর্তে ছাত্রলীগের ক্যাডার প্রায় ২৫-৩০ জন রামদা, দা, বটি, ছুরি, গুলি—যে যা পারছে তা নিয়ে হাসপাতালের ওপর হামলা করে।
এটা হচ্ছে ৭ নম্বর সেক্টর ‘হাই কেয়ার হাসপাতাল’। এই হাসপাতালটা সামনের দিকের বেশিরভাগটাই কাঁচ দিয়ে ঘেরা, তারা সব ভাঙচুর করে। আমার কানে এখনো স্পষ্ট বাজে তাদের কথাগুলো, তারা বলছিল, ‘এই রাজাকারগুলারে (মানে আমরা যারা আহত) শেষ করতে হবে। এই রাজাকারের বাচ্চাগুলোর কোনো জায়গা নেই এই দেশে। হাসপাতালে পুঁতে রেখে শেষ করে যেতে হবে এগুলারে আজকে।’
তাদের এই ত্রাসের মাঝে ওই হাসপাতালের ডাক্তার আর নার্সরা তাদের অনেক অনুরোধ করে, তাদের হাতে-পায়ে ধরে বসে থাকে, কান্না করে। তাদের অনেক অনুরোধে শেষমেশ তারা চলে যায়। তারপর সেখানে সবাইকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়, কিন্তু প্রপার ট্রিটমেন্টটা কারো আর সেখানে নেয়া সম্ভব হয়নি। পাছে আবার হামলা হয় কিনা এই ভয়ে সবাই তাড়াতাড়ি হাসপাতাল ছাড়ছিল।
আমিও ক্যাম্পাসে ব্যাক করি। আমার হাতে শুধু ব্যান্ডেজ করে দেয়, গুলি আর বের করতে পারেনি। তারপর থেকে তো অবস্থার আরো অবনতি হয়। আমি অনেক শারীরিক জটিলতা নিয়ে ছিলাম এতদিন। পরে ২৬ জুলাই আমার গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনা চলে যাই।
তখনো আমার হাতে গুলি, খুব কষ্ট পেয়েছি। কারণ, সবসময় ব্যথা করতো, হাত সোজা করা যেত না। এখনো এই গুলি বের করা সম্ভব হয়নি।
নয়া দিগন্ত : আন্দোলনে অংশ নেয়ার পেছনে আপনার মূল প্রেরণা কী ছিল? কওমি ছাত্র হিসেবে আপনার দায়বদ্ধতা কোথায় অনুভব করেছিলেন?
মুস্তাঈন বিল্লাহ : আন্দোলনে অংশ নেয়ার পেছনে আমার মূল প্রেরণা ছিল—সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নেয়ার দায়বদ্ধতা। আমি যখন দেখি, রাষ্ট্রীয় নীতির নামে সাধারণ ছাত্রদের প্রতি অবিচার করা হচ্ছে, তখন সেটা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের বিষয় হয়ে থাকে না; বরং সমগ্র ছাত্রসমাজের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
একজন কওমি ছাত্র হিসেবে আমি সবসময় বিশ্বাস করি, ইসলাম শুধু ইবাদতের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং সমাজে ইনসাফ কায়েম করাও আমাদের দ্বীনি দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। আলেম হওয়া মানেই নিপীড়নের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া। আর সে দায় থেকেই আমার মনে হয়েছিল, নির্যাতিত, বঞ্চিত ছাত্রসমাজের পাশে দাঁড়ানো আমার ঈমানী দায়িত্ব।
কোনো রাজনৈতিক পরিচয় বা গোষ্ঠীগত স্বার্থ নয়; বরং একজন শিক্ষার্থী, একজন মানুষ এবং একজন কওমি ছাত্র হিসেবে আমার নৈতিক অবস্থান থেকেই এই আন্দোলনের পাশে দাঁড়িয়েছি।
নয়া দিগন্ত : আন্দোলনের সময় আপনি যে স্বপ্ন নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন, এখন কি মনে হয় তা বাস্তবায়নের পথে রাষ্ট্র ও সমাজ এগিয়ে যাচ্ছে?
মুস্তাঈন বিল্লাহ : আমি যে স্বপ্ন নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলাম, তা ছিল একটি ন্যায়ভিত্তিক, বৈষম্যহীন রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন—যেখানে মেধা, পরিশ্রম আর ন্যায্যতার ভিত্তিতে সবাই সমান সুযোগ পাবে।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, সেই স্বপ্ন এখনো অনেকটাই অধরা। রাষ্ট্র কিছুটা পরিবর্তনের কথা বললেও, বাস্তবিক অগ্রগতি খুবই সীমিত, যা খুবই হতাশাজনক।
তবুও আমি পুরোপুরি হতাশ নই। কারণ, ইতিহাস বলে, ন্যায়ের লড়াই কখনোই একদিনে ফল দেয় না। সমাজে সচেতনতা বাড়ছে, প্রশ্ন করার সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে—এই ধারাবাহিকতায় আমরা যদি আদর্শ না ভুলে এগিয়ে যাই, তবে সেই স্বপ্ন একদিন বাস্তব হবেই ইনশাআল্লাহ।
নয়া দিগন্ত : আপনার দৃষ্টিতে জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী কেমন বাংলাদেশ দেখতে চান?
মুস্তাঈন বিল্লাহ : আমি চাই, জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশ হোক একটি ন্যায়ভিত্তিক, মানবিক এবং বৈষম্যহীন রাষ্ট্র। যেখানে কোনো ছাত্রকে তার প্রাপ্য অধিকার পেতে রাস্তায় নামতে না হয়, যেখানে মেধা ও যোগ্যতা হবে অগ্রগতির একমাত্র মাপকাঠি।
আমি এমন একটি বাংলাদেশ দেখতে চাই, যেখানে মত প্রকাশ, প্রতিবাদ কিংবা প্রশ্ন করাকে রাষ্ট্রদ্রোহ নয়; বরং গণতান্ত্রিক অধিকার হিসেবে সম্মান করা হবে। যেখানে মাদরাসার ছাত্র, কলেজের ছাত্র কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, সবাই সমানভাবে রাষ্ট্রের সম্পদ ও উন্নয়নের অংশীদার হবে।
সবচেয়ে বড় কথা, আমি এমন এক বাংলাদেশ দেখতে চাই, যেখানে রাষ্ট্র জনগণের, আর ছাত্র সমাজ হবে দেশের বিবেক—নট বন্দুকের মুখে নিরব শ্রোতা; বরং সত্য ও ইনসাফের কণ্ঠস্বর
নয়া দিগন্ত : কওমি মাদরাসার ছাত্র ও শিক্ষকদের আপনি ভবিষ্যতের রাষ্ট্রে কী অবস্থানে দেখতে চান? তাদের ভূমিকা, অধিকার ও সম্মান নিয়ে আপনার ভাবনা কী?
মুস্তাঈন বিল্লাহ : আমি ভবিষ্যতের রাষ্ট্রে কওমি মাদরাসার ছাত্র ও শিক্ষকদের এমন অবস্থানে দেখতে চাই, যেখানে তারা শুধু ধর্মীয় জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রেই সীমাবদ্ধ থাকবেন না; বরং সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের নেতৃত্বে এগিয়ে আসবেন—নৈতিকতা, ইনসাফ ও জনকল্যাণের মানচিত্র রচনায় অগ্রণী ভূমিকা রাখবেন।
কওমি অঙ্গন হাজার বছর ধরে আমাদের সমাজে আলো ছড়িয়েছে—তাদের হাতেই সমাজ পেয়েছে নৈতিকতা, আত্মিক শুদ্ধতা ও স্বাধীনতার স্বপ্ন। অথচ আজও তারা অনেকক্ষেত্রে অবমূল্যায়নের শিকার। আমি এমন একটি বাংলাদেশ চাই, যেখানে কওমি ছাত্র-শিক্ষকদের সম্মান কেবল আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না; বরং রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাদের চিন্তা ও মূল্যবোধ বাস্তব প্রভাব ফেলবে।
আমি চাই, কওমি ছাত্ররা হবে সমাজের আদর্শ মানুষ—যারা নৈতিক নেতৃত্ব দেবে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলবে, মানুষকে সত্য ও সুবিচারের পথে ডাকবে। আর শিক্ষকগণ হবেন রাষ্ট্রীয় জ্ঞানের বাতিঘর, যাদের চিন্তা-ভাবনায় সমাজ খুঁজে পাবে পথনির্দেশনা।
এককথায়, আমি এমন একটি রাষ্ট্র কল্পনা করি—যেখানে কওমি ছাত্র-শিক্ষকরা থাকবেন মর্যাদার সর্বোচ্চ স্থানে, কারণ, তারা শুধু জ্ঞানী নন; তারা নৈতিকতা ও ইনসাফের প্রতীক।
নয়া দিগন্ত : আপনি বর্তমানে যাত্রাবাড়ী বড় মাদরাসায় মেশকাত জামাতের ছাত্র। একজন জুলাইযোদ্ধা হিসেবে আপনার প্রতি এখানের শিক্ষক ও সহপাঠীদের আচরণ কেমন?
মুস্তাঈন বিল্লাহ : আলহামদুলিল্লাহ, আমি যাত্রাবাড়ী বড় মাদরাসার একজন সাধারণ ছাত্র হিসেবেই থাকি—তবে জুলাই আন্দোলনের সাথে যুক্ত থাকার কারণে কিছু ভাইয়ের ভালোবাসা ও সম্মান অবশ্যই পেয়েছি। আমার শিক্ষকগণ সবসময় আমাদের নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ববোধ জাগ্রত করতে উদ্বুদ্ধ করেন, এবং তারা কখনোই আমাকে কোনোভাবে নিরুৎসাহিত করেননি; বরং দায়িত্বশীলতার সাথে চলার জন্য উৎসাহ দিয়েছেন।
সহপাঠীরা অনেকেই আমাকে ‘জুলাইযোদ্ধা’ হিসেবে দেখে ভালোবাসা ও সাহস জুগিয়েছে, কিন্তু আমি সবসময় চেষ্টা করি নিজেদের মধ্যে একতা ও সৌহার্দ্য বজায় রাখতে। আমি কাউকে আলাদা করে ভাবতে দেইনি, আমিও নিজেকে কখনো আলাদা ভাবিনি। কারণ, আমাদের সবার পরিচয়—আমরা একজন তলবুল ইলম, একজন দায়ী, এবং একজন ন্যায়ের পথযাত্রী।
এই মাদরাসার পরিবেশে আমি যে আন্তরিকতা, সম্মান ও ভালোবাসা পেয়েছি, সেটা আমার চলার পথকে সহজ করেছে, ধৈর্য ও সাহস জুগিয়েছে। এজন্য আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি, এবং এই ভাইদের ভালোবাসার প্রতিদান যেন আমি আদর্শ জীবন গড়ার মাধ্যমে দিতে পারি—এই আমার কামনা।