বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু থেকেই ছাত্রদলের রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন এম. রাজিবুল ইসলাম তালুকদার বিন্দু। সংগঠনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে তিনি ছাত্রদল কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে মনোনীত হন। পরবর্তীতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
রাজনৈতিক জীবনে বারবার নিপীড়নের মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। ওয়ান ইলেভেনের সময় থেকে শুরু করে ছাত্রলীগ ও পুলিশের একাধিক হামলায় আহত হয়েছেন। ২০১১ সালের ভ্যাটবিরোধী আন্দোলনসহ প্রতিটি জাতীয় ও দলীয় আন্দোলনে তিনি রাজপথে সক্রিয় নেতৃত্ব দিয়েছেন। হাসিনা সরকারের ফ্যাসিবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশ নিতে গিয়ে একাধিকবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন, কিন্তু কখনো পিছু হটেননি।
সর্বশেষ ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সূচনালগ্ন থেকেই রাজপথে সক্রিয় রয়েছেন এই ছাত্রনেতা। দেশ ও জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তার সংগ্রামী ভূমিকা আজও অব্যাহত রয়েছে।

নয়া দিগন্ত : জুলাইয়ের আন্দোলনের সূচনা কিভাবে দেখছেন?
এম. রাজীবুল ইসলাম তালুকদার বিন্দু : আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল কোটা সংস্কার ও মেধাভিত্তিক নিয়োগের দাবিতে। শুরুটা ছিল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক। কিন্তু ১৭ জুলাই রাতেই সরকার সব বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে, শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেয়। পুলিশি অভিযান শুরু হয়। সেই মুহূর্তে আন্দোলন থেমে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। আমরা সিদ্ধান্ত নিই- এই শূন্যতা পূরণ করব।
নয়া দিগন্ত : বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদল কিভাবে সংগঠিত হয়?
বিন্দু : আমাদের ছাত্রদল দীর্ঘদিন ধরে ক্যাম্পাসভিত্তিক সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে তুলেছে। ১৬ জুলাই জাহাঙ্গীরনগরে ছাত্রলীগের হামলা এবং রংপুরে শহীদ আবু সাঈদের মৃত্যুর পর আমরা বুঝি, এটি আর শুধু কোটা আন্দোলন নয়, এটি রাষ্ট্রীয় দমননীতির বিরুদ্ধে এক সর্বাত্মক প্রতিরোধ। আমরা রাতেই জরুরি বৈঠক করি এবং প্রতিটি ক্যাম্পাসে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে দূর্বার আন্দোলন করার নির্দেশনা দেই।

নয়া দিগন্ত : আন্দোলনের কৌশল কী ছিল?
বিন্দু : আমরা আন্দোলনকে জোনভিত্তিক করি- বাড্ডা, বসুন্ধরা, গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, উত্তরা, আশুলিয়া, মিরপুর। প্রতিটি জোনে আমাদের ইউনিট সক্রিয় ছিল। আমরা ‘ফ্ল্যাশ মব’, ‘হিউম্যান চেইন’, ‘সাইলেন্ট মার্চ’- এই তিনটি কৌশল ব্যবহার করি। মিডিয়া ব্ল্যাকআউটের সময় আমরা নিজস্ব চ্যানেল দিয়ে তথ্য ছড়িয়ে দেই।
নয়া দিগন্ত : আন্দোলনের নেতৃত্ব কিভাবে গড়ে ওঠে?
বিন্দু : নেতৃত্ব আসে মাঠ থেকে। ইস্টার্ন, ড্যাফোডিল, সিটি, মানারাত, কানাডিয়ান, ইস্ট-ওয়েস্ট সব ক্যাম্পাসে ছাত্ররা নিজস্ব প্রতিনিধি নির্বাচন করে। আমরা একটি কেন্দ্রীয় স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করি, যার মাধ্যমে প্রতিদিনের কর্মসূচি নির্ধারিত হতো। সিদ্ধান্ত গ্রহণে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসরণ করা হতো।
নয়া দিগন্ত : আন্দোলনের মোড় ঘোরায় কোন মুহূর্তটি?
বিন্দু : ১৮ জুলাই দুপুরে, পুলিশের একটি দল প্রাণ বাঁচাতে ঢুকে পড়ে আমাদের এক ক্যাম্পাসে। আমরা তাদের আটকে রাখি। সেই দৃশ্য মুহূর্তেই ভাইরাল হয়। বাড্ডা, গুলশান, বসুন্ধরায় উত্তাল পরিস্থিতি তৈরি হয়। সাধারণ মানুষ আমাদের পাশে দাঁড়ায়। এরপর থেকে আন্দোলনের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি আমাদের হাতে চলে আসে।

নয়া দিগন্ত : সরকার তখন কী পদক্ষেপ নেয়?
বিন্দু : ১৯ জুলাই সকাল থেকে সারাদেশে কারফিউ জারি হয়, ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া হয়। বাংলাদেশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে বিশ্ব থেকে। কিন্তু আমরা থামিনি। স্কুলের শিশুরাও আমাদের সাথে যোগ দেয়। জুমার নামাজের পর রাজধানী জ্বলে ওঠে। আমরা ব্যারিকেড ভেঙ্গে এগিয়ে যাই। ভয় পাইনি, পিছু হটিনি।
নয়া দিগন্ত : আন্দোলনের তথ্য ও সমন্বয় কিভাবে হচ্ছিল?
বিন্দু : প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্ট অ্যালায়েন্স বাংলাদেশ ((PUSAB)) এবং ছাত্রদল একসাথে কাজ করছিল। পুসাবের মাধ্যমে আন্দোলনের তথ্য, ছবি, ভিডিও, বার্তা ছড়িয়ে দেয়া হতো। আমরা প্রতিটি জোনে ‘গ্রাউন্ড রিপোর্টার’ নিযুক্ত করি, যারা রিয়েল টাইমে তথ্য সরবরাহ করত।
নয়া দিগন্ত : আন্দোলনের রাজনৈতিক অভিঘাত কী?
বিন্দু : ৫ আগস্ট, আমরা গণভবনের দিকে যাত্রা করি। হাজার হাজার মানুষ আমাদের সাথে যোগ দেয়। সরকার প্রধান দেশ ছাড়েন। এটি ছিল একটি ছাত্র-নেতৃত্বাধীন অভ্যুত্থান। আমরা হারিয়েছি প্রায় ৩৫ জন সহযোদ্ধাকে। তারা শহীদ হয়েছেন একটি বৈষম্যহীন বাংলাদেশের স্বপ্নে। এই আন্দোলন প্রমাণ করেছে, ছাত্ররাই পারে ইতিহাস বদলাতে।
নয়া দিগন্ত : ভবিষ্যতের পরিকল্পনা কী?
বিন্দু : আমরা চাই, শিক্ষাখাতে বৈষম্য দূর হোক। কোটা সংস্কার, মেধার মূল্যায়ন, এবং ছাত্রদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হোক। আমরা আন্দোলন করেছি দেশের জন্য, নিজেদের জন্য নয়। ভবিষ্যতেও আমরা প্রস্তুত, যদি অন্যায় ফিরে আসে, প্রতিরোধও ফিরে আসবে।