জুলাইয়ে আন্দোলনের যে জোয়ার এসেছিল তার মধ্যে নারী শিক্ষার্থীরা রেখেছিল অনন্য অবদান। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে আন্দোলনে প্রেরণা যুগিয়েছিলেন স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নুসরাত জাহান টুম্পা। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের নারী কবিতার একটা লাইন আছে এমন-
‘কোনকালে একা হয়নিকো জয়ী, পুরুষের তরবারী;
প্রেরণা দিয়েছে, শক্তি দিয়াছে, বিজয়ালক্ষী নারী।’
এমন প্রেরণাই বোধহয় শাসক গোষ্ঠীর কোনো রক্তচুক্ষু নারীদের দূরে সরাতে পারেনি। আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছেন পুলিশ ভ্যানের সামনে। সূর্যের হাসি রাঙানো এই নতুন বাংলাদেশ বিজয়ের মুখ দেখেছিল এমন অদম্য সাহসী নুসরাতরা পুরুষের সাথে দাঁড়িয়েছিল বলেই।
আন্দোলনের শুরু থেকে রাজপথে না থাকলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরব ছিলেন নুসরাত। ধীরে ধীরে আন্দোলন রূপ নেয় রণক্ষেত্রে। ১৫ জুলাইয়ের দিকে শিক্ষার্থীরা নির্মমভাবে হামলার শিকার হন। উত্তাল সেই সময়ে রাজপথে নামার পরিকল্পনা করেন তিনি।
একটি বৈষম্যহীন, স্বপ্নের নতুন বাংলাদেশ গড়তে ঝাঁপিয়ে পড়েন আন্দোলনে। হয়ে উঠেন অপ্রতিরোধ্য। পুলিশের ভ্যান আটকে দিয়ে তারুণ্যের প্রাণে সঞ্চার করেছিলেন আন্দোলনের নয়া জোয়ার।

ঠিক ১৮ জুলাইয়ে মাঠে নামেন নুসরাত। দেশে যখন ভাই-বোনদের উপর হত্যা, জেল ও জুলুম নেমে আসে তখন বিবেকের তাড়নায় মাঠে নামেন তিনি। ভাই-বোন হত্যার প্রতিবাদ ও ন্যায়বিচারের দাবিতে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন আন্দোলনের এই দুঃসাহসিক অভিযাত্রী।
সম্প্রতি নয়া দিগন্ত অনলাইনের সাথে এক সাক্ষাৎকারে নুসরাত জাহান টুম্পা বলেছেন জুলাই জাগরণের সেই বিভীষিকাময় স্মৃতি, সামনে থেকে দেখা উত্তাল দিনে রাজপথের অভিজ্ঞতা।
নয়া দিগন্ত : জুলাই আন্দোলনে বদলে যাওয়া বাংলাদেশ কেমন দেখছেন?
নুসরাত : আসলে জুলাইয়ের পর নতুন বাংলাদেশকে ভালোভাবে দেখছি, কতটা বললেছে। যারা দেশ পরিচালনায় আছেন, তারা কতটুকু সঠিকভাবে কাজ করতে পারছে এগুলো নিয়ে। ভালো-মন্দ সবকিছুই দেখছি। তবে যেমনই হোক, ফ্যাসিস্ট আমলের চেয়ে ভালো আছি। অন্তত স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারছি। সাদা কে সাদা এবং কালোকে কালো বলতে এখন কোনো ভয় কাজ করে না।
নয়া দিগন্ত : আন্দোলনে যাওয়া তো কঠিন ছিল, নারী হয়েও আন্দোলনে গেলেন প্রেরণা কী ছিল?
নুসরাত : আসলে সাহস তো নারীদের অলঙ্কার। পৃথিবীর ইতিহাসে নারীরাই পুরুষদের প্রেরণা এবং সাহস যুগিয়েছে। নারীরা তো স্বভাবতই লড়াকু। তারা কখনো অন্যায় ও অবিচারের কাছে মাথা নত করে না। পুরুষের সাহস ও প্রেরণা হতেই ঢাল হয়ে পাশে থাকে। আমার প্রেরণাও এখানে।
নয়া দিগন্ত : পুলিশের ভ্যান আটকিয়ে যে প্রতিরোধ করলেন তখন ভয় কাজ করেনি?
নুসরাত : একদমই কোনো ভয় কাজ করেনি। ওই সময় ভয় শব্দের সাথে পরিচয়ই হয়নি। নিজের জন্য ভুলে গিয়েছিলাম ভয় নামে কোনো শব্দ পৃথিবীতে এক্সিস্ট করে। শুধু আমি না। আমি বিশ্বাস করি, জুলাই আন্দোলনে নামা সাবার মনে ছিল অযুত সাহস। ভয়কে জয় করেই তারা রাজপথে নেমেছিল।

নয়া দিগন্ত : আন্দোলনে কখন গেলেন শুরুর দিকের গল্পটা বলেন।
নুসরাত : আমি আন্দোলনে যোগ দেই ১৮ জুলাই থেকে। এর আগে কোটা আন্দোলন নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অ্যাক্টিভ ছিলাম। যখন দেখলাম আমার ভাইদের ওপর হত্যা করা হচ্ছে, জুলুম করা হচ্ছে তখন আর ঘরে বসে থাকতে পারিনি। বিবেকের তাড়নায় আন্দোলনে যাবার সিদ্ধান্ত নেই। এসব ঘটনা আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। সেই তাড়না থেকেই আমার ভাই-বোনদের হত্যার প্রতিবাদ ও ন্যায়বিচারের দাবিতে রাস্তায় নামি।
নয়া দিগন্ত : আপনার সামনে কেউ আহত হয়েছিল, ওই সময়ের দৃশ্য কেমন ছিল?
নুসরাত : আমার পাশে অনেক সহযোদ্ধাকে রাবার বুলেট, স্প্লিন্টার এবং টিয়ার গ্যাসে আহত হতে দেখেছি। কী ভয়াবহ দৃশ্য এসব তো বর্ণনা করে বুঝানো যাবে না। পুলিশ ও পেটুয়া লীগরা নিরীহ শিক্ষার্থীদের ওপর যে হামলা করেছে তা তো দেখলাম। আর হত্যা দেখিনি বললে তো ভুল হবে, আমরা অসংখ্য ভিডিওতে দেখেছি, কীভাবে আমার ভাইদেরকে হত্যা করছে। আমার ভাই সাঈদ, ইশামিন, মুগ্ধকে হত্যা করেছে। সারা দুনিয়া তো এগুলো দেখেছে।
নয়া দিগন্ত : আন্দোলনের একপর্যায়ে তো নেট ছিল না, তখন কীভাবে যোগাযোগ করতেন?
নুসরাত : ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যায় ১৮ জুলাই রাতে। ওই সময়ে আর কারো সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছিল না। কোথায় কী হচ্ছে, পরে কোথায় সবাই একত্রিত হবো এ নিয়ে কোনো ইনফরমেশন পাচ্ছিলাম না। তখন ফোন করে বন্ধুদের কাছ থেকে খবর নিতাম। তাদের এলাকার কী পরিস্থিতি হচ্ছে। আজ বের হবে কিনা ইত্যাদি।
বন্ধুরা কেউ বের হলে আমিও বের হতাম। ১৯ থেকে ২৫ জুলাই পর্যন্ত দুয়েকদিন একা একা বের হয়েছি। কিন্তু পরিস্থিতি এতোটাই খারাপ ছিল যাত্রাবাড়ীর পরিচিত কাউকে পেতাম না, কে কোথায় আছে জানতে না পেরে বাসায় চলে আসি। পরে ইন্টারনেট চালু হলে প্রথমে বাড্ডা, রামপুরা এবং পরে আামার ক্যাম্পাসের সাথে আন্দোলনে যোগ দেই।
নয়া দিগন্ত : এই যে হাজার হাজার নারী, শিক্ষার্থীরা রাজপথে নেমে এলো আপনার কী মনে হয়?

নুসরাত : ওই যে বলেছি, নারীরা সবসময় লড়াকু। ছেলেদের মতো তারাও দেশের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত। ফ্যাসিস্ট হাসিনার বিরুদ্ধে তার ভাইদের লড়াইকে আরো বেগবান করার জন্য নারীরাও ভাইদের শক্তি হয়ে পাশে নেমে আসে। আসলে ঢাকা তো বটেই, সারা দেশে এমন একটা অবস্থা তৈরি হয়েছিল ঘরে কেউ ছিল না। যেদিকে দেখি লোকে লোকারণ্য হয়ে আছে রাজপথ।
নয়া দিগন্ত : আপনি কারো দ্বারা হুমকি পেয়েছেন বা নজরদারি করেছে এমনটা মনে হয়েছে?
নুসরাত : আমি সরাসরি হুমকি না পেলেও ওই সময় আমার বাবাকে এলাকার পাতি নেতারা হুমকি দিয়েছিল। আমাকে যেন আটকায়, যাতে আন্দোলনে না যাই। গেলে ক্ষতি হবে এসব কথা বলতো। এসব তো কেয়ার করিনি, কোনোকিছুকে ভয় না করেই আন্দোলনে গিয়েছিলাম।
নয়া দিগন্ত : ৫ আগস্ট (৩৬ জুলাই) কী পরিস্থিতি দেখলেন, ওই সময়টাতে কোথায় ছিলেন?
নুসরাত : ৫ আগস্ট সকালে বাসা থেকে বের হতে গেলে বাবার পক্ষ থেকে বাধা আসে। কারণ ওই দিন কারফিউ ছিল। সকালের দিকে অবস্থা অনেক ভয়াবহ ছিল। এজন্য বাবাও বাইরে থেকে বাসায় চলে আসেন। বাবা আমাকে বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তত হতে দেখলে বাধা দেয়ার চেষ্টা করে। একপর্যায়ে বাবাকে বুঝিয়ে আমি বেরিয়ে পড়ি।
ওই সময় একটা বাইকে (উবারে) করে শাহবাগে যাই। সেখানে পৌঁছানোর কিছু সময় পরেই শুনতে পাই সেনাপ্রধান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন। তখনই আমরা আন্দাজ করি, শেখ হাসিনা পদত্যাগ করবেন। কিছু সময় পরে গুঞ্জন শুরু হয়- ‘হাসিনা পালাইছে, হাসিনা পালাইছে’। তখনই ওখানে যারা ছিলেন সবাই স্লোগান দেয়া শুরু করে ‘পালাইছে রে পালাইছে, খুনি হাসিনা পালাইছে।’ অনেকে পাশের দোকান থেকে মিষ্টি নিয়ে আসেন। আমরা মিষ্টি খাই। শাহবাগের ফুলের দোকানগুলো থেকে একজন আরেকজনকে ফুলের মালা দিচ্ছিল। ওই সময় আমাকেও ফুলের তোড়া দেয়া হয় শাহবাগে। এক মহা আনন্দে সবার সাথে আমিও স্লোগান দিতে থাকি। পরে সেখান থেকে প্রথমে সংসদ ভবন যাই এরপর গণভবনে।
নয়া দিগন্ত : বিল্পবের পর যে বাংলাদেশ দেখতে চেয়েছিলেন তার কতটুকু প্রতিফলন হচ্ছে, আপনার কী মনে হয়?
নুসরাত : দেখেন, একটা নতুন পরিবর্তন হলে তো অনেককিছুরই পটপরিবর্তন ঘটে। সে অনুযায়ী আামদের
আকাঙ্ক্ষার জায়গাটা বিশাল। অনেককিছু ভালো কাজ হচ্ছে। একদিনে তো সবকিছু হয়ে যায় না। জাতির উপর লম্বা সময় চেপে থাকা ফ্যাসিস্ট দূর হয়েছে। আশা করছি, ভালো কিছু হবে। প্রত্যাশা অনেক।
আরেকটা ব্যাপার হলো দেশে এখনো প্রকাশ্যে খুন, চাঁদাবাজি চলছে। ইন্টারিম সরকারেও যারা দায়িত্বে আছেন নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হচ্ছেন বারবার। এদিকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের একটা বছর পার হয়ে গেল অথচ এখনো দৃশ্যমান বিচার হয়নি। আগে এগুলোর বিচার নিশ্চিত করা জরুরি ছিল। আমার আহত ভাই-বোনদের যথাযথ চিকিৎসা ও সহায়তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
নয়া দিগন্ত : আচ্ছা, এখন কেমন বাংলাদেশ দেখতে চান?
নুসরাত : আমি সবার জন্য একটি নিরাপদ বাংলাদেশ চাই। যে দেশে অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুললে বা সত্যকেকে তুলে ধরার চেষ্টা করলে কোনো আসাদুজ্জামান তুহিনকে হত্যা করা হবে না। যে বাংলাদেশ হবে কৃষক-শ্রমিক সবার। বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে থাকবে এমন বাংলাদেশ চাই।