নেক্সাস ডিফেন্স অ্যান্ড জাস্টিস

দেশের স্বার্থে সশস্ত্র বাহিনীকে সংস্কার করা প্রয়োজন

ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ ও চিরস্থায়ী করার লক্ষ্যে সশস্ত্র বাহিনীকে অকার্যকর করার ষড়যন্ত্র করে। সকল সামরিক ও বেসামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ও র‌্যাবসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দলীয় লাঠিয়াল বাহিনীতে পরিণতের চেষ্টা করে।

অনলাইন প্রতিবেদক
‘নেক্সাস ডিফেন্স অ্যান্ড জাস্টিস (এনডিজে) আয়োজিত আলোচনা সভা
‘নেক্সাস ডিফেন্স অ্যান্ড জাস্টিস (এনডিজে) আয়োজিত আলোচনা সভা |নয়া দিগন্ত

‘দেশের স্বার্থে সশস্ত্র বাহিনীকে সংস্কার করা প্রয়োজন’ বলে জানিয়েছেন সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।

শনিবার (২৬ এপ্রিল) সন্ধ্যায় জাতীয় প্রেসক্লাবের আব্দুস সালাম হলে ‘নেক্সাস ডিফেন্স অ্যান্ড জাস্টিস (এনডিজে) আয়োজিত এক আলোচনা সভায় তারা এ কথা বলেন।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে নিরাপত্তা বিশ্লেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এম শাহীদুজ্জামান বলেন, ‘আমরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে ঘৃণা করি। তবে তারা কখনো দেশকে বিক্রি করে দেয়নি, অর্থ ও ক্ষমতার লোভে। আমাদের দেশে সেনাবাহিনীর ভেতর এক প্রকারের করপোরেট বিলাসিতা এসেছে। যা যুদ্ধের ক্ষেত্রে সমস্যা হয়ে পড়বে। অবশ্যই, বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীকে সংস্কারে আনা প্রয়োজন।’

সভাপতির বক্তব্যে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো: হাসান নাসির (অবসরপ্রাপ্ত) বলেন, ‘বিগত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ ও চিরস্থায়ী করার লক্ষ্যে সশস্ত্র বাহিনীকে অকার্যকর করার ষড়যন্ত্র করে। সকল সামরিক ও বেসামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ও র‌্যাবসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দলীয় লাঠিয়াল বাহিনীতে পরিণতের চেষ্টা করে। ফলে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষমতাসীন সরকারের বেআইনি ইচ্ছাপূরণের হাতিয়ারে পরিণত হয়। জাতীয় প্রতিরক্ষা নীতি-২০১৮-এর প্রধান লক্ষ্য দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা হলেও গত ১৬ বছর কম গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য অর্জনে সশস্ত্র বাহিনীকে প্রায়শঃ নিয়োগ ছিল লক্ষণীয়। ফলে ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষার প্রধান ভূমিকা পালনে এই বাহিনীগুলোকে ক্রমাগতভাবে দুর্বল ও অক্ষম হতে বাধ্য করে।’

দৈনিক নয়া দিগন্তের বার্তা সম্পাদক মাসুমুর রহমান খলিলী বলেন, ‘সশস্ত্র বাহিনীকে সংস্কারের কথা হলেও তবে সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়নি। কাঠামোতে দুর্বলতা রেখে সামনের দিকে সশস্ত্র বাহিনীকে এগিয়ে নেয়া যাবে না । বাজেট ক্ষেত্রে সশস্ত্র বাহিনীকে শক্তিশালী করতে টাকা সংগ্রহ করা সম্ভব। নিরাপত্তা বিষয়গুলো অ্যাড্রেস করে কি করা যায়, তা জানা দরকার। প্রতিবেশী দেশ ভারত নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যে স্টেপগুলো নেয় তা তারা মিডিয়াতে প্রকাশ করে, আমরা করি না। আমাদের সেভেন সিস্টার্স দরকার নেই, আমাদের যা আছে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদেরকে নিরাপত্তা, কৌশল ও সংস্কার নিয়ে ভাবতে হবে।’

ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘র‌্যাবের সাথে সেনাবাহিনীকে যুক্ত করে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে কলুষিত করা হয়েছে। মানুষ হত্যা গুম খুনের মধ্য দিয়ে কলুষিত সেনাবাহিনীকে অবশ্যই সংস্কার করা প্রয়োজন। মহান মুক্তিযুদ্ধে এই বাহিনীর অবদান গুরুত্বপূর্ণ। ভারত দেখেছে আমাদের সেনাবাহিনীর যোগ্যতা, তাই থেকে মুজিব সেনাবাহিনীকে দুর্বল করতে রক্ষী বাহিনী গড়ে তুলেছিল। এক এগারো থেকে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা সেনাবাহিনীকে কব্জায় নিয়ে দুর্বল করার চেষ্টা করেছে, আঘাত করেছে। গত ১৫ বছর জেনারেল তারেক সিদ্দিকী সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন।’

শহীদ মেজর মনির সরকারের স্ত্রী সোনিয়া বলেন, ‘আমাদের সশস্ত্র বাহিনীকে রাজনীতি মুক্ত রাখতে হবে। তবে তারা দেশের স্বার্থে কাজ করতে পারবে।’

লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফেরদৌস আজিজ (অবসরপ্রাপ্ত) বলেন, ‘১৬ বছর হাসিনা ল্যাপসেন্সর তৈরি করেছে। সে পালিয়ে গেছে তার দোসরা সব জায়গায় বসে আছে। মাঝে মাঝে দেখি কি, জানি বের হয়। জানি, রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে হয়তো মিল আছে। টাকার বিনিময়ে করছে।’

কর্নেল জাকারিয়া হোসাইন (অবসরপ্রাপ্ত) বলেন, ‘বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান ও প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সাথে সম্পর্কের ভিত্তিতে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, মিয়ানমার ও ভারত থেকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য সামরিক হুমকি সর্বদা বিদ্যমান রয়েছে। মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক জটিল এবং মাঝে মাঝে সামরিক উত্তেজনার ইতিহাস রয়েছে। ২০২২ সালে মিয়ানমারের বিমান বাহিনী বাংলাদেশের সীমান্তের ভেতরে (বান্দরবন) বিমান হামলা চালায়। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের তৎকালীন ফ্যাসিস্ট সরকার সেই সময় কোনো রিয়াক্ট করে নাই। নতজানু ও ভারত নির্ভর সেই ফ্যাসিস্ট সরকারের পক্ষেই তা সম্ভব হয়েছিল। মিয়ানমারের সৈন্য সংখ্যা বাংলাদেশ থেকে কিছুটা বেশি। রাশিয়া ও চীন থেকে আধুনিক যুদ্ধ বিমান ক্রয় করেছে। ভারত ও চীন থেকে একটি করে সাবমেরিন মিয়ানমারের নৌবাহিনীতে সংযোজিত হয়েছে। মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর সক্ষমতা বাংলাদেশ থেকে বেশি হলেও শৃঙ্খলা ও পেশাদারিত্বে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী অনেক উন্নত। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, গত ১৫ বছরের পতিত ফ্যাসিস্ট সরকার সেনাবাহিনীর মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দিয়েছে। সংস্কার করে সেনাবাহিনীকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে, যাতে করে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে জলে-স্থলে-অন্তঃরীক্ষে যেকোনো সামরিক তৎপরতা রুখে দেয়া যায়। ভারত ও বাংলাদেশ সম্পর্ক জটিল ও বহুমাত্রিক। যদিও ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত সহযোগীতা করেছিল কিন্তু কালপরিক্রমায় ভারতের ভূমিকা বন্ধু রাষ্ট্র নয় বরং শত্রু রাষ্ট্রের সাথে যেভাবে ব্যবহার করে তার সবটুকুই ভারত ব্যবহার করেছে। ফারাক্কা বাঁধ, তিস্তা বাঁধ, সীমান্ত হত্যা, ফ্যাসিস্ট সরকারকে লালন-পালন ও আশ্রয়-প্রশ্রয় তার উজ্জ্বল উদাহরণ। ভারত চায়, বাংলাদেশে সব সময় একটি পুতুল সরকার থাকুক, যার মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি করদ রাজ্যে পরিণত হয়। ভারত এ-ও চায়, বাংলাদেশের সেনাবাহিনী ভারতের সেবাদাস সেনাবাহিনী হিসেবে থাকুক। গত ১৫ বছরে বিডিআর হত্যার মাধ্যমে কিছু সেবাদাস অফিসার তৈরি করেছিল ভারত। কিন্তু ৫ আগস্ট ২০২৪-এর কারণে ভারতের সেই সম্ভাবনা ধূলিসাৎ হয়। সুতরাং এ বিষয়টিকে সামনে রেখে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তার যেকোনো স্কেলে সামরিক অভিযানের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। ভারতের সৈন্য সংখ্যা ১৪ লাখের মতো। পরমাণু শক্তিধর, উন্নত মিসাইল প্রযুক্তি, আধুনিক বিমান ও নৌবাহিনী সম্পন্ন ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যেকোনো অভিযান চালাতে ভারতকে একশবার চিন্তা করতে হবে। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর সকল সদস্য কমান্ডো ট্রেনিং প্রাপ্ত; অফিসার ও সৈনিক সবাই। এছাড়া আমাদের রয়েছে চার কোটি তরুণ টগবগে উদ্বেলিত ফোর্স। আমরা এ-ও জানি, বৃহৎ দেশ ভারতের চতুর্দিকে সে শত্রু রাষ্ট্র তৈরি করে রেখেছে। চীন ও পাকিস্তান সীমান্তে ভারতের যে ফোর্স মোতায়েন রয়েছে তা কখনো সে উইড্রো করতে পারবে না। বাংলাদেশের ১০টি অত্যন্ত শক্তিশালী ডিভিশন রয়েছে। তার বিরুদ্ধে মোকাবেলা করতে হলে ভারতের দরকার ৩০টি ডিভিশন যা ভারত কখনোই প্রস্তুত করতে পারবে না। কিন্তু বাস্তবতা সত্ত্বেও আমরা বলতে চাই শত্রুকে কখনো ছোট ভাবতে নাই। ভারতের যেকোনো হুমকি মোকাবেলায় আমাদের সশস্ত্র বাহিনীকে সেভাবে গড়ে তুলতে হবে।’

ইউনাইটেড পিপলস (আপ) নেতা রাফে সালমান রিফাত বলেন, ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সংস্কার করা উচিত। জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার ক্ষেত্রে সিভিলিয়ান অন্তর্ভুক্ত করা দরকার।’

প্রফেসর ড. আব্দুর রব বলেন, ‘গত ১৬ বছর ধরে আমরা ছিলাম বিধবা নাগরিকের মতো, সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের হত্যার মধ্য দিয়ে এমন রূপ আমাদেরকে দিয়েছিল। একদিকে ছিল আয়নাঘর। আমাদেরকে যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে হবে, জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল করতে হবে। উচ্চশিক্ষিত দেশপ্রেমিকদের নিয়ে সেটি গঠন করতে হবে। কারো কাছে যেন নতজানু হয়ে না পড়ে, সিভিলিয়ান মিলিটারি গঠন করতে হবে। আমাদের প্রতিবেশী দেশের সাথে আমরা বন্ধুসুলভ আচরণ চাই, এর বাইরে কিছু নয়। আমরা দেশের এক ইঞ্চি জায়গাও ছাড়ব না, প্রাণ দিয়ে হলেও মুক্ত রাখব।’

কর্নেল মোহাম্মদ শাহনুর রহমান (অবসরপ্রাপ্ত) বলেন, ‘উচ্চতর সামরিক কমান্ডের মাধ্যমে যেকোনো গণতান্ত্রিক সরকার সামরিক বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। তবে, আমাদের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে যে, উচ্চতর কমান্ড সদর, সামরিক সংস্থা কিংবা উচ্চতর পদবির কাঠামোগত ত্রুটি কিংবা পদ্ধতিগত ত্রুটি বিচ্যুতি থাকায় সামরিক বাহিনীকে দিয়ে আইন বহির্ভূত কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। উপরোন্ত, কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ সামরিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তাদের ওপর সরকারিভাবে প্রদত্ত আইনগত দায়িত্ব বহির্ভূত কাজে নিয়োজিত থেকেছে বছরের পর বছর। ফলে, দেশের সার্বভৌমত্বের ওপর হুমকি তৈরি হয়েছে। গত ২০০৯ সালে সংঘটিত তথাকথিত বিডিআর বিদ্রোহের নামে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাদের নির্মমভাবে হত্যা তারই ফল বলে দেশবাসী মনে করে।’

‘সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ড এবং নিয়ন্ত্রণ রক্ষায় ভারসাম্য না থাকায়, রাজনৈতিক সরকার রাষ্ট্রের এই শক্তিকে নিজ নিজ রাজনৈতিক দলীয় স্বার্থ সিদ্ধির জন্য ব্যবহার করেছে। এই সুযোগে, বাহিনীগুলোর কিছু অসৎ কর্মকর্তা রাজনৈতিক গুরুর কাছে প্রিয় হওয়ার জন্য সচেষ্ট থেকেছে। উচ্চতর সামরিক কমান্ড সদর দফতর বলতে আমরা শুধু সশস্ত্র বাহিনী বিভাগকে আলোচনায় এনেছি। এই বিভাগটি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মতো একটি বিভাগ যা সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হিসেবে ঘটিত এবং এর প্রধান একজন তিন তারকা জেনারেল (প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার), যিনি প্রধানমন্ত্রীর নিকট দায়বদ্ধ। বর্তমান ব্যবস্থায় সশস্ত্র বাহিনী বিভাগটি সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর অধীনে সামরিক বিষয়াদি যেমন, অপারেশন, প্রশিক্ষণ, গোয়েন্দা কার্যক্রম, প্রশাসন বিষয়াদি দেখভাল করে থাকে। প্রধানমন্ত্রী একজন প্রতিরক্ষা মন্ত্রীও বটে, ফলে এই দফতরের একটা অতিরিক্ত ক্ষমতা আছে যা অন্য কোনো মন্ত্রণালয় বা বিভাগের নেই। এই বিভাগটির মাধ্যমেই রাজনৈতিকভাবে সামরিক বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।’

তিনি বলেন, ‘যদিও, আলাদাভাবে একটি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় আছে কিন্তু তাদের কার্যকরী ক্ষমতা নেই। তারা শুধু মাত্র পোস্ট অফিস হিসেবে কাজ করে। আমাদের দীর্ঘ দিনের পর্যবেক্ষণ হলো, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বের সঠিক বন্টন দরকার, যাতে কোনো ফাঁকফোঁকর দিয়ে সামরিক বাহিনীকে ভুল পথে পরিচালিত না করতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতা খর্ব করার প্রয়োজন আছে। তাই প্রধানমন্ত্রীকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব হতে অব্যহতি দিয়ে এর দায়িত্ব প্রাপ্ত একজন পূর্ণ মন্ত্রী হতে পারেন নির্বাচিত অবসরপ্রাপ্ত একজন সামরিক কর্মকর্তা, যিনি সরকার কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের জন্য শপথ নেবেন। বহুল সমালোচিত সামরিক উপদেষ্টা পদটি নিয়ে পর্যালোচনা করার প্রয়োজন আছে বলে আমরা মনে করছি। নতুন সংস্কারকৃত ব্যবস্থায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর আদেশ নির্দেশ নিয়ে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ সকল ধরনের দায়িত্ব পালন করতে পারবে। সুতরাং, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নিজ পরিবারের পছন্দের নিয়োগপ্রাপ্ত সামরিক উপদেষ্টা পদটির কোনো প্রয়োজন আছে কি না, তা ভেবে দেখার সময় এসেছে।’

‘উচ্চতর সামরিক সংস্থা বলতে আমরা সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা বুঝিয়েছি। সকল সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার কর্ম পদ্ধতির আমূল সংস্কার প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। এই গোয়েন্দা সংস্থা গুলো সরকারিভাবে দেশের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা হিসেবে শুধু মাত্র সামরিক বিষয়ের জন্যই দায়িত্ব প্রাপ্ত। বহিঃশত্রু থেকে দেশের বিরুধ্যে আক্রমণ মোকাবেলার জন্য সব ধরনের গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ, এবং সঠিক তথ্য প্রদান করে সামরিক বাহিনীকে দেশের শত্রুর বিরুদ্ধে প্রস্তুত রাখতে সাহায্য করাই এই সমস্ত গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান এবং একমাত্র দায়িত্ব। অপরদিকে দেশের অভ্যন্তরের নানাবিধ সমস্যাজনিত তথ্য সংগ্রহ অর্থাৎ আইন শৃঙ্খলাজনিত তথ্য সংগ্রহ করার দায়িত্ব পুলিশের গোয়েন্দা সংস্থার ওপর ন্যস্ত। দুঃখের বিষয়, এই গুরুত্বপূর্ণ সামরিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আসল দায়িত্ব পালন না করতে দিয়ে দেশের ভেতরের রাজনৈতিক কুকর্মে ব্যবহার করেছে। ফলে, সংস্থাগুলো তার সঠিক পরিচয় হারিয়ে ফেলেছে। এদের সংস্কার করতে হবে, যাতে করে ইচ্ছা করলেও কেউ যেন আর নিজ ইচ্ছামত এটাকে ব্যবহার করতে না পারে। একটি গোয়েন্দা সংস্থা প্রধানমন্ত্রীকে সরাসরি রিপোর্ট প্রদান করে। প্রথমেই, এই সংস্থাটিকে পুনঃসংস্কার/পুনঃসংঘঠিত সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের অধীনে ন্যস্ত করতে হবে কি না তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। বর্তমান চার্টার অব ডিউটি পুনর্লিখন করতে হতে পারে। সকল সামরিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অভ্যন্তরীণ কাঠামোর পরিবর্তন খুব একটা প্রয়োজন আছে বলে আমরা মনে করি না। শুধু মাত্র রাজনৈতিক কাজে যে সমস্ত বিভাগ/দফতর/শাখাকে নিয়োজিত করার মাধ্যমে সরকার রাজনৈতিকভাবে এই সংস্থাকে ব্যবহার করে, সেগুলোকে পুনঃবিন্যাস করতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের ধারণা, একটা বিপুল পরিমাণ বাজেটের সাশ্রয় এখানে নিশ্চিতভাবে হবে। স্ল্যাশ মানি বলে যে সরকারি টাকা অন্যায়ভাবে অদৃশ্যের নির্দেশে কুপথে খরচ করা হয়, তা অনেকাংশে কমে যাবে। এর সাথে সাথে জবাবদিহিতা বৃদ্ধি পাবে বলে আমরা মনে করছি।’

কর্নেল মো: জগলুল আহসান (অবসরপ্রাপ্ত) বলেন, ‘রাষ্ট্রের মৌলিক উপাদানগুলোর মধ্যে সার্বভৌমত্ব বা প্রতিরক্ষার বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যে কারণে প্রতিটি আধুনিক রাষ্ট্রেরই প্রতিরক্ষা নীতি থাকে এবং সে নীতি অনুযায়ীই তার সশস্ত্র বাহিনী সংগঠিত হয়। আধুনিক যুগে কোনো রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় যে মৌলিক বিষয়টি খেয়াল রাখতে হয় তা হলো আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো বন্ধু বা সুপ্রতিবেশী নেই সবাই স্বার্থসংশ্লিষ্ট অংশীদার। প্রতিবেশী ও বন্ধু দু’টি আলাদা শব্দ, কখনোই সমার্থক নয়। প্রতিবেশীর সাথে স্বার্থসংশ্লিষ্ট শত্রুতা যেকোনো সময় অবশ্যম্ভাবী। সাধারণভাবে কোনো রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা নীতি ও সশস্ত্র বাহিনীর সংগঠন নিম্নলিখিত নিয়ামকগুলোর ওপর নির্ভরশীল যার অধিকাংশই বিগত ১৬ বছরের ফ্যাসিস্ট শাসনামলে প্রভাবিত ও বিকৃত হয়েছে যার আমূল সংস্কার প্রয়োজন।’

জাতীয় মূল্যবোধ ও রাজনৈতিক দর্শন : বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম জাতিসত্তায় বিশ্বাসী। এই মূল্যবোধ ও দর্শনের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে তুলতে হবে এ দেশের সেনাবাহিনীর চেতনা, মনন ও সংগঠন। বিগত ফ্যাসিস্ট শাসনামলে প্রতিবেশী দেশের অধীন বা আনুগত্যের যে সুপ্ত চেতনা সেনাবাহিনীতে প্রোথিত করা হয়েছে সেনাবাহিনীতে সর্বপ্রথম তার সংস্কার প্রয়োজন। ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান ও গুরুত্ব : অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বের বিবেচনায় ১৮৮০ সালে নেভাল স্ট্রটেজিস্ট এ টি মাহান বলেছেন, ‘Whoever will control the Indian Ocean will control the world in the next century’। যে কারণে ওশানকে ঘিরে ইউএসএ, চায়না, ইন্ডিয়া ও পাকিস্তান সবারই ভিন্ন ভিন্ন লক্ষ্য ও স্বার্থ রয়েছে। অবস্থানগত দিক দিয়ে বাংলাদেশ, ইন্ডিয়ান ওশান ও এশিয়ার মূল ভূখণ্ডের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত হওয়ায় সকল গ্লোবাল ও রিজিওনাল শক্তিগুলোর ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ ও দ্বন্দের স্বীকার হওয়া স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে বিগত ১৬ বছরে কোনো একক দেশ নির্ভরশীল যে ভূ-রাজনৈতিক কৌশল প্রণয়ন করা হয়েছে তার সংস্কার প্রয়োজন।

ভৌগলিক গঠন ও আবহাওয়া: বাংলাদেশ চারদিক থেকে ইন্ডিয়া দ্বারা পরিবেষ্টিত। দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তের কিছু অংশে রয়েছে অস্থিতিশীল মায়ানমার। ভৌগলিকভাবে সমতল হলেও পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল টিলা, জঙ্গল ও পাহাড়ে পরিপূর্ণ। জলবায়ু মৌসুমী এবং পুরো দেশ নদীনালায় পরিপূর্ণ। বৃহৎ রাষ্ট্র পরিবেষ্টিত ক্ষুদ্র রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর প্রতিরক্ষা কৌশল, সশস্ত্র বাহিনীর সংগঠন, অস্ত্র, আর্মামেন্ট, বাজেট সবই প্রাথমিকভাবে বৃহৎ প্রতিবেশীর রণ-কৌশল, সামরিক ক্ষমতাকে বিবেচনায় নিয়েই সংস্কার করতে হবে।

থ্রেটের প্রকৃতি ও শক্তি : আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশী সামরিক শক্তিতে বিশ্বে চতুর্থ ও একটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ। তবে তার সামরিক শক্তির বৃহৎ অংশকে নিয়োজিত থাকতে হয় উত্তর ও পশ্চিম সীমান্ত এবং সেভেন সিস্টার এলাকায়। রোহিঙ্গা ইস্যু ও ইন্সারজেন্সী (বিদ্রোহ) নিয়ে মায়ানমার থ্রেট বিরাজমান থাকলেও মায়ানমার আর্মির প্রশাসনিক সাপোর্ট স্ট্রাকচার অফেন্সিভ সহায়ক নয়। ভৌগলিক, ভূ-রাজনোতিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণের প্রেক্ষিতে ইন্ডিয়াকে প্রাথমিক থ্রেট হিসেবে বিবেচনায় নিয়েই সামরিক বাহিনীর সাংগাঠনিক ও রণ-কৌশলগত সংস্কার প্রয়োজন।

আন্তর্জাতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক : তৃতীয় কোনো শক্তিশালী দেশের সাথে জোট, আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সংস্থা এবং অর্থনৈতিক সামিট ও সংস্থার অন্তর্ভুক্তি পরোক্ষভাবে সেই ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষাকে জোড়দার করে। সে প্রেক্ষিতে সার্ক জোড়দারকরণ, অ্যাসিয়ানের সাথে সহযোগী সম্পর্ক এমনকি ইন্ডিয়ান ওশন ঘিরে থাকা ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইরান, সোমালিয়া, তাঞ্জানিয়া মিলে ইন্ডিয়ান ওশান ঘিরে একটি নতুন জোট গঠন করা যেতে পারে। আবার আমাদের প্রধান প্রতিপক্ষ পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হওয়ায় অন্য কোনো পারমাণবিক দেশের সাথে প্রতিরক্ষা চুক্তি করা অত্যাবশ্যক। অর্থনীতি প্রধান নিয়ামক। ৬.৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে বাংলাদেশ ২০২১ সালে স্বল্পোন্নত দেশের অন্তর্ভুক্ত হলেও দেশের বেশিভাগ সেক্টরই অনুন্নত। প্রতিরক্ষা ও উন্নয়নের জন্য বাজেট নির্ধারণের বিষয়টি এদেশে বিপরীত চাপ সৃষ্টি করে। সম্ভাব্য বৃহৎ রাষ্ট্রের পাশে ক্ষুদ্র রাষ্ট্র হিসেবে উভয়ক্ষেত্রই প্রাধান্য দাবি করে। কাজেই বাজেটে উন্নয়ন ও প্রতিরক্ষা উভয়কেই যথাযথ গুরুত্ব দিতে হবে।

প্রযুক্তিগত দক্ষতা : কোনো দেশের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা, শিল্প ও সামরিক যন্ত্রপাতির বাণিজ্যিক উৎপাদন ক্ষমতা তার সামরিক সংগঠন ও বাজেটকে প্রভাবিত করে। প্রতিরক্ষা অস্ত্র ও সরঞ্জাম উৎপাদনে বাংলাদেশ ততটা উন্নত নয়। যে কারনে বিদেশ হতে সামরিক সরঞ্জাম ক্রয়, মজুদ, প্রতিস্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণে বাজেটের ওপর বাড়তি চাপ পড়া ছাড়াও পরনির্ভরতা থাকে সভাব্য যুদ্ধের সময় যা বিপজ্জনক। যে কারণে আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশী থেকে সামরিক যানবাহন ও সরঞ্জাম ক্রয়ের বিষয়গুলো সংস্কারের প্রয়োজন।