জুলাই গণঅভ্যুত্থানে বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত আইমান উদ্দিন। ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইন্জিনিয়ারিং বিভাগে প্রথম বর্ষের ছাত্র। যে সময়টা ভাবনাহীন, বাধাহীন ঘুরে বেড়ানোর ঠিক সেই সময়ে দেখেছে এক নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন। আর সেই স্বপ্নকে ছুঁয়ে দিতে বন্ধুদের সাথে যোগ দিয়েছিল জুলাই আন্দোলনে।
এমন তারুণ্য দেখলো বুলেটের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আবু সাঈদ। এ কীসের টান? দেশ ও মাতৃভূমির টান? হুম। ঠিক তাই, আইমান এমন দৃশ্য দেখে আর ঘরে থাকতে পারেনি। সেদিনই আবু সাইদ হত্যার বিচারের দাবিতে জুলাই নেমেছিল আইমানের বুকেও।
জুলাইয়ের উত্তাল দিনে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন আইমান। একই বুলেটে আইমানের বুক ছিদ্র করে লাগে তার ফুফু নাছিমা আক্তারের বুকে। নাছিমা শহীদ হয়েছেন লাল জুলাইয়ের রক্ত মেখে।
জুলাই স্মৃতি জানাতে এক সাক্ষাৎকারে নয়া দিগন্ত অনলাইনের মুখোমুখি হয়েছেন আহত আইমান উদ্দিন। বলেছেন রক্তাক্ত জুলাইয়ে গুলিবিদ্ধ হওয়ার গল্প। তার ফুফুকে হারানোর বেদনা ও না বলা অনেক কথা।
নয়া দিগন্ত : জুলাইয়ের এক বছর পার হলো, কেমন লাগছে?
আইমান : দেখেন গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর থেকে তো সবকিছু যেন থমকে ছিল। বেঁচে ফিরবো কিংবা নতুন বাংলাদেশ দেখবো এটা ভাবতে পারিনি। এখন সত্যিই আনন্দ লাগছে। পড়াশোনায় ফিরতে পেরেছি। পড়াশোনা, স্কিল ডেভেলপমেন্ট এগুলোতে ফোকাস দিচ্ছি। কিন্তু জুলাইয়ের কথা ভাবতেই মনটা বিষণ্ন হয়ে ওঠে।

নয়া দিগন্ত : আন্দোলনে কীভাবে যোগ দিলেন?
আইমান : ১৮ তারিখে সাইন্সল্যাবে আন্দোলনে ছিলাম। আবু সাঈদের হত্যার পর আর ঘরে বসে থাকতে পারিনি। মনে হচ্ছিল এভাবে ঘরে বসে থাকলে তো একে একে আমার ভাইদের জীবন শেষ হয়ে যাবে। আবু সাঈদ হত্যার বিচার এবং কোটা সংস্কারের দাবিতেই আন্দোলনে গিয়েছিলাম।
নয়া দিগন্ত : আহত ছাত্র-জনতা নিয়ে আপনার স্মৃতি মনে পড়ে?
আইমান : ১৯ তারিখে গুলিবিদ্ধ হওয়ার আগে পরিস্থিতি ভয়াবহ ছিল। হেলিকপ্টার থেকে সরাসরি গুলি করা হচ্ছিল। পুলিশ গুলি করছে। অনেকে আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ আহত হয়ে রাস্তায় পড়ে আছে। হাসপাতালে আহত যারা তারা একে অপরকে সাহস ও ভরসা দিচ্ছিল।
নয়া দিগন্ত : আপনি কীভাবে আহত হলেন?
আইমান : চারদিকে থমথমে অবস্থা। ১৯ জুলাই বিকেল ৪টা থেকে ৫টার দিকে ছাদে গেলে কিছু বুঝে উঠার আগেই একটা গুলি এসে গায়ে লাগে। শরীরটা হালকা ডানদিকে ঘুরাতেই দেখি আমার ফুফু নাছিমাও মুখে হাত দিয়ে পড়ে গেছে। ততক্ষণে আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিল। আর কিছু বলতে পারি না।
নয়া দিগন্ত : আপনার সামনে কেউ শহীদ হয়েছে?
আইমান : হ্যাঁ। আমার ফুফুই তো আমার পাশে গুলিবিদ্ধ হলেন। আমাকে করা গুলিটাই আমার বুক ছিদ্র হয়ে পিঠ দিয়ে বের হয়ে আমার ফুফুর মুখে, বুকে লেগেছিল। আমি তখন ঠিক টের পাইনি যে একই গুলিতে ফুফু ছাদে লুটিয়ে পড়ছে। মুখ চেপে পড়ে গেছে। পেছনে ফিরে তাকাতেই আমার দুর্বল লাগছিল। আমিও বসে পড়ি।
আমি অনেক কষ্টে কোনোরকম ছাদ থেকে লিফটের কাছাকাছি আসতে পেরেছিলাম। এরপর হাসপাতালে নিয়ে গেছে। পরে জ্ঞান ফিরলেও আমাকে জানানো হয়নি যে আমার ফুফু মারা গেছেন।
আম্মাকে ফুফুর কথা জিজ্ঞেস করলে আমাকে বলেন, ‘তোর ফুফুকে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছি, ওখানে চিকিৎসা করাবে। আসলে আম্মা এমন পরিস্থিতিতে আমাকে বলতে চাননি যে ফুফু মারা গেছে। কারণ আমার অবস্থাও ছিল খুবই শঙ্কাটাপন্ন। পরে সুস্থ হয়ে বাসায় ফেরার পর জানতে পারি নাছিমা ফুফু ওই গুলিতেই শহীদ হয়েছেন। আমি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না, নাছিমা ফুফু মারা গেছেন। এখন খুব কষ্ট লাগে।
নয়া দিগন্ত : ৫ আগস্ট (৩৬ জুলাই) কোথায় ছিলেন?
আইমান : গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর থেকেই ৫ আগস্ট পর্যন্ত আমি ধানমন্ডি পপুলার হাসপাতালে ছিলাম। দুনিয়ায় থাকা না থাকার আশঙ্কা নিয়ে দিন পার হয়েছে। ডাক্তাররাও বলেছিলেন, আল্লাহর রহমত আছে বলেই আমি বেঁচে আছি। আমার বুকে গুলি লাগাতে খুবই ভয়াবহ অবস্থার মধ্য দিয়ে হাসপাতালের বেডে কাতর হয়ে শুয়েছিলাম। বাইরের কোনো খবর জানি না। কিছু করারও উপায় ছিল না। ৫ আগস্টই আমাকে বাসায় আনা হয়।
নয়া দিগন্ত : আপনারা যে আখাঙ্খা নিয়ে আন্দোলন করলেন তার কোনোকিছু প্রতিফলন হচ্ছে, আপনার কী মনে হয়?
আইমান : কিছুটা প্রতিফলন হলেও অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়নি। জুলাইয়ের এক বছর পার হলেও এখনো জুলাই সনদ ঘোষণা করা হয়নি। জুলাই গণহত্যার দৃশ্যমান বিচার হলো না। রাষ্ট্রের সংস্কার বলতে যা হওয়ার কথা ছিল তাও বাস্তবায়ন হয়নি। অনেক কাজ বাকি।
নয়া দিগন্ত : গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশ নিয়ে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি কী?

আইমান : আসলে প্রত্যাশা অনেক। আশা করেছিলাম, নতুন বাংলাদেশে অনেক কিছু পরিবর্তন হবে। বাহিগুলোকে রিফর্ম করা হবে। একটা শক্তিশালী সরকার গঠন করতে যা যা প্রয়োজন তার পদক্ষেপ নেয়া হবে। প্রাপ্তি বলতে বলার মতো উল্লেখযোগ্য কিছু নেই। কাজ হচ্ছে, অনেক কিছু হয়ত পরিবর্তন হবে। তবে জুলাইয়ের পর মতপ্রকাশে এখন কাউকে ভয় পেতে হচ্ছে না। লোকজন স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারছে, অধিকারের কথা বলতে পারছে।
নয়া দিগন্ত : আপনি কেমন বাংলাদেশ দেখতে চান?
আইমান : এখন শুধু বলতে চাই, আমরা যারা জুলাই আন্দোলন করেছি আমাদের মূল দাবিটাই ছিল বৈষম্যহীন বাংলাদেশ পাওয়া। এখন এটার বাস্তবায়ন দেখতে চাই।
আর মানুষ যাতে ন্যায়বিচার পায় এজন্য শক্তিশালী বিচারব্যবস্থা চালু করা। যে বাংলাদেশে কেউ বৈষম্যের শিকার হবে না, ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য, অধিকারের জন্য রাস্তায় আন্দোলন করতে হবে না।
নয়া দিগন্ত : জুলাইয়ের এক বছর পার হলো আপনার অনুভূতি কী?
আইমান : আমি অনেক নিহত ও আহত পরিবারকে দেখি যারা অসহায়ের মতো জীবনযাপন করছে। নানান কষ্টে দিন পার করছে। সকল শহীদ পরিবার ও আহতদের ঠিকঠাক মূল্যায়ন ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের জন্য সরকার ঠিকভাবে কাজ করছে কিনা বুঝে উঠতে পারছি না। সরকার আরো আন্তরিক হবে ভেবেছিলাম। এক বছরে দৃশ্যমান বড় কোনো সংস্কার করতে পারিনি সরকার।
নয়া দিগন্ত : জুলাই পরবর্তী দেশ গড়ায় কী ভূমিকা রাখতে চান?
আইমান : এখন নাগরিক হিসেবে আমার কী কী দায়িত্ব তা জানার চেষ্টা করছি আরো ভালোভাবে। সামনে যাতে দেশের যেকোনো প্রয়োজনে কাজ করতে পারি।
নয়া দিগন্ত : আবারো যদি দেশ ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে বিপ্লবের ডাক আসে আপনি অংশ নেবেন?
আইমান : অবশ্যই অংশ নেবো। দেখেন, এখন আমার কিছু্ই হারানোর নেই। চোখের সামনে ফুফুকে হারিয়েছি। নিজেও গুলিবিদ্ধ হলাম। সুতরাং যে স্বপ্নের বাংলাদেশ দেখতে চেয়েছি তারজন্য প্রয়োজন হলে আবারো জুলাইয়ে দেখা হবে। আহত হয়েও একটি সুন্দর বাংলাদেশ বিনির্মাণে কাজ করে যেতে চাই।