আইপিজিএডির সংলাপে বক্তারা

পররাষ্ট্রনীতিতে ‘বাংলাদেশ ফার্স্ট’ দৃষ্টিভঙ্গির আহ্বান

আইপিজিএডির সংলাপে বৈদেশিক নীতিতে ‘বাংলাদেশ ফার্স্ট’ দৃষ্টিভঙ্গির পুনরুজ্জীবন এবং দেশের আন্তর্জাতিক অবস্থান পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানানো হয়েছে।

নয়া দিগন্ত অনলাইন
আইপিজিএডির সংলাপ
আইপিজিএডির সংলাপ |সংগৃহীত

ইনস্টিটিউট ফর পলিসি, গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিজিএডি) ‘বাংলাদেশের একটি বিস্তৃত পররাষ্ট্রনীতির দিকে’ শীর্ষক জাতীয় সংলাপ সিরিজের আরেকটি পর্ব আয়োজন করেছে। এতে পররাষ্ট্রনীতিতে ‘বাংলাদেশ ফার্স্ট’ দৃষ্টিভঙ্গির আহ্বান জানানো হয়েছে।

শনিবার (১ নভেম্বর) রাজধানীর দ্য ওয়েস্টিন হোটেলের ব্রোঞ্জ রুমে এ অধিবেশনে অনুষ্ঠিত হয়।

আইপিজিএডির গবেষণা পরিচালক মো: মোস্তফা হোসেনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত এই অধিবেশনে রাজনৈতিক নেতা, সাবেক কূটনীতিক, শিক্ষাবিদ, প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ ও পররাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞরা অংশ নেন।

অধিবেশনে ক্রমবর্ধমান জটিল বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে জাতীয় স্বার্থকে আরো ভালোভাবে তুলে ধরতে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পররাষ্ট্রনীতিকে কিভাবে পুনর্গঠিত করা যেতে পারে তা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আলোচনার লক্ষ্য বাংলাদেশের বৈশ্বিক অবস্থান সম্পর্কে ‘একটি বৃহত্তর জাতীয় আলোচনার সূচনা’র আবহ তৈরি করা।

উদ্বোধনী বক্তব্যে আইপিজিএডির চেয়ারম্যান ড. ইশরাফ হোসেন উল্লেখ করেন, ‘বাংলাদেশ ফার্স্ট’ নীতি ধারণাটির প্রচলন ১৯৭০ দশকের শেষের দিকে এবং ৮০-এর দশকের শুরুর দিকে দেখা যায়।

তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, গত দেড় দশক ধরে এই নীতিটি উপেক্ষিত হয়েছে।

এ সময় তিনি আগামী দিনে গঠিত সরকারকে ভবিষ্যত কূটনীতির ভিত্তি হিসেবে একে পুনরুজ্জীবিত করার আহ্বান জানান।

বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট (বিইআই)-এর সভাপতি রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির এই উদ্যোগের প্রশংসা করে বলেন, পররাষ্ট্রনীতি এমন একটি বিষয় যা প্রায়শই উপেক্ষিত থেকে যায়।

তিনি মনে করেন, ১৯৭১ সালে জাতির প্রতিষ্ঠাকালীন আদর্শ সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত না হলেও ২০২৪ সালের জুলাইয়ের আন্দোলন তাদের অসম্পূর্ণ আকাঙ্ক্ষাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে।

পেশাদারিত্বের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের মতো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে পরিচালনা করা উচিত হবে না।

তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশকে বিশ্বের ১৯২টি দেশ সম্পর্কে আরো গভীরভাবে জানতে হবে এবং এলডিসি-পরবর্তী চ্যালেঞ্জগুলোর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ বলেন, তার দলের পররাষ্ট্রনীতির দৃষ্টিভঙ্গি সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আদর্শকে অনুসরণ করে। তিনি সার্ককে আঞ্চলিক সহযোগিতা ব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

তিনি আরো বলেন, তারেক রহমানের ৩১-দফা ও ভিশন ২০৩০ সমতা ও ন্যায়বিচারের ওপর জোর দিয়েছে, গত ১৫ বছরে যা অনুপস্থিত ছিল।

‘বাংলাদেশ ফার্স্ট’কে মূলনীতি হিসেবে ধরা উচিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সংসদের মতো প্রতিষ্ঠান দুর্বল হলে পররাষ্ট্রনীতিও ব্যর্থ হয়।’

সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী কূটনৈতিক বাস্তববাদের আহ্বান জানান। তিনি নেলসন ম্যান্ডেলার একটি লাইনটি উদ্ধৃত করে বলেন, ‘আপনার শত্রু যে আমারও শত্রু হবে এমন না।’ এ সময় তিনি স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে সতর্ক করেন এবং ভারতীয় গণমাধ্যমের বর্ণনাকে প্রকৃত দ্বিপক্ষীয় সংলাপের পথে বাধা হিসেবে বর্ণনা করেন।

ফাউন্ডেশন ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (এফএসডিএস)-এর চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) ফজলে এলাহী আকবর বলেন, ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বিদ্বেষ নয়’ এই পুরনো নীতিবাক্যটি মহৎ শোনালেও প্রায়ই এটি ‘অত্যধিক কাল্পনিক’ বলে প্রমাণিত হয়। তিনি একটি স্পষ্ট ‘বাংলাদেশ ফার্স্ট’ দৃষ্টিভঙ্গির দিকে যাওয়ার আহ্বান জানান।

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব ডা: তাসনিম জারা বলেন, পররাষ্ট্রনীতিকে অবশ্যই জনগণের জীবনে প্রকৃত পরিবর্তন আনতে হবে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, বাংলাদেশের উচিত তথ্যভিত্তিক অবস্থান গ্রহণ করা এবং এমনকি নিপীড়িত সাংবাদিক ও অন্যান্য দেশের নাগরিকদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করা।

বিএনপির আন্তর্জাতিক-বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার নাসির উদ্দিন আহমেদ অসীম পূর্ববর্তী সরকারের ‘ইলিশ কূটনীতি’র সমালোচনা করে বলেন, এটি ভারসাম্য বা দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য প্রতিফলিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। তিনি একটি বিস্তৃত, জোটনিরপেক্ষ কৌশলের আহ্বান জানান যা সার্ক, বিমসটেক ও আসিয়ানের মাধ্যমে আঞ্চলিক সংযোগ জোরদার করবে। একইসাথে জলবায়ু-বিষয়ক ন্যায়বিচার ও অভিবাসীদের অধিকারের বিষয়ে বাংলাদেশের কণ্ঠস্বরকে আরো জোরদার করবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. আলী আশরাফ সার্ককে পুনরায় সক্রিয় করার এবং পোশাকের বাইরেও বাংলাদেশের রফতানি খাতকে আরো সম্প্রসারিত করার আহ্বান জানান। তিনি ওষুধ, উচ্চমানের টেক্সটাইল ও শান্তিরক্ষা মিশনে নতুন সুযোগের কথা উল্লেক করেন, বিশেষ করে বেসামরিক ভূমিকার মাধ্যমে।

সাবেক হাই কমিশনার এয়ার ভাইস মার্শাল (অবসরপ্রাপ্ত) মাহমুদ হোসেন যুক্তি দিয়ে বলেন, ভারত ও সিঙ্গাপুরের মডেল অনুসরণ করে বিশেষায়িত কূটনীতিকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তিনি উল্লেখ করেন, ‘রাজনীতি অনেক সময় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।’ হেনরি কিসিঞ্জারের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সত্যিকারের কূটনীতিতে প্রতিরক্ষা ও প্রযুক্তি বিবেচনা করা উচিত, বিশেষ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে।

বিআইআইএসএস-এর সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. রাজিয়া সুলতানা অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ভবিষ্যৎমুখী সম্পৃক্ততার ওপর জোর দেন। তিনি এফডিআই প্রবাহ ৬৩ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে বলে উল্লেখ করেন এবং শক্তিশালী অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, ‘সফট পাওয়ার’ ও সাংস্কৃতিক কূটনীতির আহ্বান জানান।

এনসিপির আন্তর্জাতিক সেলের সেক্রেটারি সুলতান মোহাম্মদ জাকারিয়া যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও চীনকে বাংলাদেশের তিনটি প্রধান বহিরাগত চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করেন। তিনি পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছাড়াই কৌশলগত ভারসাম্য বজায় রাখার আহ্বান জানান। তিনি সাইবার নিরাপত্তা ও ‘সবার সাথে কৌশলগত সম্পৃক্ততা, কারো সাথে বিদ্বেষ নয়’ নীতির ওপরও জোর দেন।

ঢাকা ফোরাম ইনিশিয়েটিভের আশফাক জামান, নমনীয়তা এবং স্থিতিস্থাপকতার একটি মডেল হিসেবে ভিয়েতনামের কূটনীতির দিকে ইঙ্গিত করে পরামর্শ দেন যে বাংলাদেশ নিজেকে একটি আধুনিক, মধ্যপন্থী মুসলিম জাতি হিসেবে উপস্থাপন করতে পারে।

ঢাকা ফোরাম ইনিশিয়েটিভের আশফাক জামান বাংলাদেশের একটি নতুন আখ্যানের পক্ষে যুক্তি দেন, যা ‘দরিদ্র ও বন্যাপ্রবণ’ স্টেরিওটাইপ থেকে আলাদা। তিনি নমনীয়তা ও স্থিতিস্থাপকতার মডেল হিসেবে ভিয়েতনামের কূটনীতির দিকে ইঙ্গিত করে পরামর্শ দেন, বাংলাদেশ নিজেকে একটি আধুনিক, মধ্যপন্থী মুসলিম জাতি হিসেবে উপস্থাপন করতে পারে।

নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ এয়ার কমোডর মো: শফিকুল ইসলাম সৌদি-পাকিস্তান ‘ইসলামিক ন্যাটো’ মডেলের কথা উল্লেখ করে আঞ্চলিক প্রতিরক্ষা কাঠামোর ক্রমবর্ধমান রূপের দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করেন। তিনি বলেন, ‘কোনো চিরন্তন বন্ধু বা শত্রু নেই।’

আইপিজিএডির নির্বাহী পরিচালক আলাউদ্দিন মোহাম্মদ বলেন, এই প্ল্যাটফর্মের লক্ষ্য উন্মুক্ত সংলাপের মাধ্যমে আদর্শিক বিভেদ দূর করা।

তিনি আরো বলেন, ‘২০২৪ সালের জুলাই থেকে কেউই একটি বিস্তৃত পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে কথা বলেনি। আমরা এটি পরিবর্তন করতে চাই।’

বিজ্ঞপ্তি