মোহাম্মদ ওমর

কিছু মিডিয়া অভ্যুত্থানের গ্রাফিতি সামনে আনলেও শিল্পীকে আড়াল করেছে

শুধু ‘স্বাধীনতার সূর্যোদয়’ই নয়, এরপর বেশকিছু ক্যালিগ্রাফি করে দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেন উসাইদ মুহাম্মদ ও মোহাম্মদ ওমর। নানা বিষয়ে নয়া দিগন্ত অনলাইনের সাথে কথা বলেছেন মোহাম্মদ ওমর।

বেলায়েত হুসাইন
মোহাম্মদ ওমর
মোহাম্মদ ওমর |সংগৃহীত

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশজুড়ে দেয়ালে দেয়ালে ক্যালিগ্রাফি ও গ্রাফিতি করা শুরু হয়। এরমধ্যে ‘স্বাধীনতার সূর্যোদয়’ নামে একটি গ্রাফিতি দেশের সর্বমহলে ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায়। এই গ্রাফিতি ব্যবহৃত হয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনসহ নানানভাবে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় করা এই গ্রাফিতিটির কারিগর ছিলেন দুই মাদরাসাছাত্র।

শুধু ‘স্বাধীনতার সূর্যোদয়’ই নয়, এরপর বেশকিছু ক্যালিগ্রাফি করে দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেন উসাইদ মুহাম্মদ ও মোহাম্মদ ওমর। এত সুন্দর সুন্দর কাজ তারা কিভাবে করলেন এবং এর অনুপ্রেরণাই বা পেলেন কোত্থেকে—এরকম নানা বিষয়ে নয়া দিগন্ত অনলাইনের সাথে কথা বলেছেন মোহাম্মদ ওমর

নয়া দিগন্ত : অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে উসাইদ মুহাম্মদের সাথে আপনার আঁকা ‘স্বাধীনতার সূর্যোদয়’ গ্রাফিতিটি একটি প্রতীক হয়ে ওঠে। আপনি কি বলতে পারেন, এই কাজটির পেছনে আপনাদের মূল ভাবনা কিভাবে এসেছিল?

Mohammad-Omar-03

মোহাম্মদ ওমর : ‘স্বাধীনতার সূর্যোদয়’ গ্রাফিতি মূলত আমাদের ভেতরের যে রক্তক্ষরণ, আমাদের শহীদ ভাইদের রক্তের বিনিময়ে নতুন বাংলাদেশ পাওয়ার পেছনের যেই বেদনা ও পরবর্তীতে তৈরি আকাঙ্খা, ঠিক সেই জায়গা থেকেই এসেছে। স্বৈরাচার সরকার পতনের পর তখনো বিভিন্ন গুজবে চারপাশে নানা রকম ভয়, হতাশা আর প্রশ্নের গর্জন। আমরা বুঝেছিলাম—শুধু স্লোগান নয়, চোখে দেখা একটা চিত্র–একটা প্রতীক দরকার যা মানুষকে আশা দেবে। আমি আর উসাইদ চেয়েছিলাম এমন কিছু আঁকতে, যেটা দেখলে মনে হবে—এই তো, স্বাধীনতার স্বাদ নিয়ে নতুন দিনের সূর্য উঠছে। কেবল স্বাধীনতার দাবিই নয়, আত্মমর্যাদার, ন্যায়বিচারের ও ঈমানী চেতনার সূর্য যেন উদিত হচ্ছে।

নয়া দিগন্ত : ‘স্বাধীনতার সূর্যোদয়’ ভাইরাল হবার পর দেশের প্রথম সারির মিডিয়া এবং প্রতিষ্ঠানগুলো আপনাদের গ্রাফিতি ব্যবহার করেছে। এ নিয়ে আপনার অনুভূতি কী ছিল?

মোহাম্মদ ওমর : এটা আমাদের জন্য এক ধরনের অপ্রত্যাশিত পাওয়া ছিল। আমরা তো মূলত মানুষের অন্তরের কথা রঙে প্রকাশ করেছিলাম। যখন দেখি দেশের বড় বড় মাধ্যম, এমনকি বিদেশী গণমাধ্যমও এটা তুলে ধরছে, তখন আমরা বুঝতে পারি আমাদের উদ্দেশ্যে আমরা সফল হয়েছি আলহামদুলিল্লাহ, মানুষ আমাদের রঙের ভাষা পড়তে পারছে এবং গ্রহণ করছে। এটা আমাদের আত্মবিশ্বাস দিয়েছে, মনে করিয়ে দিয়েছে—চিত্রশিল্পও এক ধরনের ভাষা, এক ধরনের প্রতিবাদ। তবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে শিল্পকে সামনে আনতে গিয়ে শিল্পীকে আড়াল করে ফেলার প্রবণতা আমরা লক্ষ্য করেছি। অনেক মিডিয়া এটা করেছে। এটা মাঝে মাঝে দুঃখ দিয়েছে। বাংলাদেশের আনাচে কানাচে অনেক প্রতিভা লুকিয়ে আছে। ঠিকভাবে কদর করতে পারলে তারা দেশকে অনেক অনেক ভালো কিছু উপহার দিতে পারবে। প্রথম সারির প্রতিষ্ঠানগুলোর সামর্থ আছে বিভিন্ন ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে প্রতিভাগুলোকে উঠিয়ে আনার। প্রথম সারির মিডিয়া ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে সে জায়গায় আরো বেশি কাজ করার জন্য আমার অনুরোধ থাকবে।

নয়া দিগন্ত : জুলাইয়ের গণজাগরণ ও নতুন রাষ্ট্রচেতনায় নানাভাবে আপনিসহ মাদরাসাশিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ অনেকের নজর কেড়েছে। এই গণঅভ্যুত্থানে আলেম ও মাদরাসা শিক্ষার্থীদের ভূমিকাকে আপনি কেমনভাবে দেখেন?

Mohammad-Omar-04

মোহাম্মদ ওমর : এই ভূমিকা ছিল ঐতিহাসিক। দীর্ঘদিন ধরে স্বৈরাচার সরকার মানুষের মাঝে একটা ভুল ধারণা চালু করে রেখেছিল যে আলেম সমাজ বা মাদরাসা শিক্ষার্থীরা হাল জামানার কিছু না বোঝা গোষ্ঠী। কিন্তু জুলাইয়ে দেখা গেল, তারা প্রতিবাদের সম্মুখভাগে, তারা গঠনমূলক চিন্তা, নেতৃত্ব আর নৈতিক চেতনার ধারক। আমি মনে করি, এটা কেবল রাজনৈতিক নয়, সাংস্কৃতিকভাবেও এক অভ্যুত্থান ছিল—যেখানে মাদরাসা ও আলেম সমাজ দেশের প্রতি নিজেদের প্রকৃত অবস্থান আবারো শক্তভাবে প্রমাণ করেছে।

নয়া দিগন্ত : ‘তুফান’ নামে আপনাদের একটি ক্যালিগ্রাফিতে আপনারা ফিলিস্তিনের ধ্বংস, মসজিদুল আকসা ও প্রতিরোধের চিত্র একত্র করেছেন। নতুন বাংলাদেশের সাথে ফিলিস্তিনের এই তুলনা কেন গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছেন?

মোহাম্মদ ওমর : আমরা যখন স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে এসেছিলাম, তখন আমাদের চোখে ভাসছিল ফিলিস্তিনের সেই দৃশ্য—যেখানে ঈমানদার মুসলমানরা মাতৃভূমি আর আকিদার জন্য ইসরাইলের বুলেটের সামনে প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায়। তারা হাসতে হাসতে শহীদ হয়, কিন্তু বাতিলের সামনে মাথা নত করে না। এই আত্মত্যাগ, এই ঈমান আমাদের জন্য ছিল প্রেরণা। আমরা বিশ্বাস করেছি, আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল রেখে জুলুমের বিরুদ্ধে দাঁড়ালে বিজয় আসবেই। আমাদের ‘তুফান’ গ্রাফিতিতে সেই অনুপ্রেরণারই ছবি আঁকা হয়েছে।

যদিও আল্লাহ আমাদের এই জুলুমের বিরুদ্ধে বিজয় দান করেছেন, কিন্তু ফিলিস্তিনের ভাইয়েরা এখনো নির্যাতিত। তাই আমাদের চিত্র শুধু স্মৃতি নয়, সেটা এক ধরনের ডাক—বিশ্বের মুসলমানদের জাগানোর প্রচেষ্টা।

Mohammad-Omar-05

আমি চাই, ভবিষ্যতের বাংলাদেশ যেন এমন একটি দেশ হয়, যেখানে ফিলিস্তিনের মতো আত্মত্যাগ, সাহস আর ঈমান মানুষের হৃদয়ে জাগরূক থাকে। যেন আমরা সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে বিশ্বমঞ্চে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারি—উম্মাহর মর্যাদা নিয়ে।

নয়া দিগন্ত : আপনাদের চিত্রকর্মগুলোর ভেতর এই যে স্বাধীনতা ও প্রতিরোধের বার্তা। আপনি কি মনে করেন, শিল্প এখন দাওয়াতের বা প্রতিবাদের মাধ্যম হয়ে উঠেছে?

মোহাম্মদ ওমর : এক কথায় বললে—হ্যাঁ, শিল্প কখনই নিছক সৌন্দর্য বা বিনোদন নয়। আর জুলাইয়ের বিপ্লবে এটা দাওয়াতের, প্রতিবাদের এবং আত্মনির্মাণের শক্তিশালী মাধ্যম হয়ে উঠেছিলো। মানুষ এখন চোখ দিয়েই উপলব্ধি করতে চায়। তাই আমরা চিত্রের মাধ্যমে চিন্তা দেই, তাওহীদের আহ্বান জানাই, প্রতিবাদ করি অন্যায়ের। এই যুগে ক্যানভাসও এক প্রকার আহ্বান।

নয়া দিগন্ত : আপনাদের কাজের সাথে জড়িত হয়েছে অনেক মানুষ, সামাজিক সংগঠন—এমনকি সাধারণ নারীরাও এক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছেন। এই যে স্বতঃফূর্ত সামাজিক অংশগ্রহণ, এ সম্পর্কে আপনি কী বলবেন?

Mohammad-Omar-06

মোহাম্মদ ওমর : এটা ছিল সবচেয়ে অনুপ্রেরণাদায়ক দিক। আমাদের অনেক চিত্রে রঙ দিয়েছে বোরকা পরা আপুরা, দেয়াল খুঁজে দিয়েছে স্কুল কলেজ পড়ুয়া ভাইয়েরা, রঙ তুলি এগিয়ে দিয়েছে রিকশাওয়ালারা। এই যে সবার অংশগ্রহণ, এটা প্রমাণ করে দিয়েছে—শিল্প যদি মানুষের কথা বলে, মানুষও তার সাথেই দাঁড়ায়।

নয়া দিগন্ত : মাদরাসায় পড়েও এই আঁকাআঁকি কোত্থেকে কিভাবে শিখলেন? আর এটাকে কি পেশা হিসেবে বেছে নেবেন এবং কেন?

মোহাম্মদ ওমর : আসলে শুরুর দিকে ছিল কাগজে আঁকাআঁকি। আমি ছোটবেলা থেকেই খুব ভালো ড্রইং করতাম। এরপর মাদরাসায় পড়ার সুবাদে আরবি লেখার প্রতি ভালবাসা। ক্যালেন্ডারের পাতায় ক্যালিগ্রাফি দেখা—সেখান থেকেই ধীরে ধীরে শেখা। বড় হয়ে বুঝলাম, ইসলামী ক্যালিগ্রাফি আর গ্রাফিতি দিয়ে যেমন সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়, তেমন বার্তাও দেয়া যায়। তাই এটাকে শুধু শখ নয়, বরং একটি ‘দাওয়াহ-ভিত্তিক পেশা’ হিসেবেই নিতে চাই। যেন আমার রঙ একদিন আমার দ্বীনের সাক্ষ্য দেয়।

নয়া দিগন্ত : ভবিষ্যতে আপনি কেমন বাংলাদেশ দেখতে চান? বিশেষ করে দাওয়াত, শিল্প, চিন্তা ও গণমানসের দিক দিয়ে আপনার স্বপ্ন কেমন?

মোহাম্মদ ওমর : আমি এমন বাংলাদেশ চাই, যেখানে দাওয়াত থাকবে প্রতিটি ক্ষেত্রের ভেতর—শিল্পে, মিডিয়ায়, শিক্ষা ও রাজনীতিতে। যেখানে চিন্তার স্বাধীনতা থাকবে, কিন্তু ঈমানের শিকড় ছিঁড়ে নয়; বরং তা মজবুত করেই। আমি চাই এমন এক গণমানস, যারা প্রতিটি কাজ করবে মাতৃভূমির কল্যাণে। জণগণের কল্যাণে। আর এই প্রকৃত কল্যাণ আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নের দ্বারাই সম্ভব। এবং আমি সেই স্বপ্নই দেখি।

Mohammad-Omar-02

নয়া দিগন্ত : সবশেষে, যারা গ্রাফিতি ও ক্যালিগ্রাফির মাধ্যমে ইসলামী আদর্শ প্রচার করতে চান, তাদের জন্য আপনার কী পরামর্শ ও বার্তা?

মোহাম্মদ ওমর : আমার একটাই কথা—এই পথটা সুন্দর, কিন্তু সহজ নয়। তুমি যদি এক হাতে কলম-তুলি, আরেক হাতে কালেমা ধরতে পারো—তবে এগিয়ে যাও। শেখো, পড়ো, রঙ দিয়ে আদর্শের গল্প তৈরি করো । মনে রেখো, আমরা শুধু শিল্পী না—জাতির প্রয়োজনে আমরা শাহাদাতের বার্তাবাহক।