বিশেষ আদেশে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোটের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে সরকার

কাল-পরশু সরকারকে সুপারিশ দিতে পারে ঐকমত্য কমিশন

‘আদেশের ব্যাপারে জামায়াত ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) একমত। এটি তাদের দাবিও। কিন্তু এতে বিএনপির জোড়ালো আপত্তি আছে।’

নিজস্ব প্রতিবেদক
ঐকমত্য কমিশন
ঐকমত্য কমিশন |সংগৃহীত

জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫ বাস্তবায়নে সুপারিশ চূড়ান্ত করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এতে গণভোটের মাধ্যমে সনদের আইনিভিত্তি দেয়ার সুপারিশ করা হয়। আর গণভোটের জন্য সরকার একটি আদেশ জারি করবে। এ আদেশের নাম হবে ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়ন (সংবিধান) আদেশ ২০২৫’। আর এই আদেশের ওপর হবে গণভোট। তবে গণভোট জাতীয় নির্বাচনের দিন একসাথে হবে, নাকি আগে অনুষ্ঠিত হবে, সেটি নির্ধারণ করবে অন্তর্বর্তী সরকার। তবে, সবকিছু ঠিক থাকলে শনিবার (২৫ অক্টোবর) প্রধান উপদেষ্টা ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে সুপারিশ জমা দিবে কমিশন।

কমিশন সূত্রে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে সূত্রটি আরো জানায়, আদেশের ব্যাপারে জামায়াত ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) একমত। এটি তাদের দাবিও। কিন্তু এতে বিএনপির জোড়ালো আপত্তি আছে। দলটি চায় প্রচলিত আইনে প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে গণভোট অনুষ্ঠিত হবে।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বৃহস্পতিবার রাতে বলেন, ‘আমরা বিশেষজ্ঞদের সাথে টানা ৯ ঘণ্টা বৈঠক করেছি। এর আগে নিজেরা বৈঠক করেছি। সবমিলিয়ে একটা খসড়া তৈরি হয়েছে। তবে সুপারিশ জমা দেয়ার আগ পর্যন্ত ত্রুটি বিচ্যুতি নিয়ে আবারো বৈঠক হবে। আমরা ধারাবাহিকভাবে প্রতিনিয়ত বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলে যাচ্ছি। আশা করছি, আগামী রোববারের মধ্যে সরকারের কাছে সুপারিশ জমা দেবো।’

তিনি বলেন, ‘আমরা সবকিছু পর্যালোচনা করে এমন একটি সুপারিশ দিচ্ছি, যেটি অবিলম্বে সরকার বাস্তবায়ন করতে পারে।’

গণভোট জাতীয় নির্বাচনের আগে নাকি একই দিনে অনুষ্ঠিত হবে, এমন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সেটি আমরা বলতে পারছি না। আমরা পূর্ণাঙ্গ সুপারিশ করব। বাস্তবায়ন করবে সরকার।’

কোনো রাজনৈতিক দল সেটি না মানলে কী হবে, এমন প্রসঙ্গে আলী রীয়াজ বলেন, ‘কোনো দল মানবে কি মানবে না, সেই চ্যালেঞ্জ ঐকমত্য কমিশন নেবে না। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা সরকারের ব্যাপার। আমরা কমিশনের পক্ষ থেকে সুপারিশ দেবো।’

বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের নোট অব ডিসেন্ট (আপত্তি) প্রসঙ্গে আলী রীয়াজ বলেন, ‘আমরা সবদিক বিবেচনা করে এমনভাবে একটি সুপারিশ দেবো যার আইনগত ত্রুটি না থাকে এবং যেটি দ্রুত বাস্তবায়ন করতে পারে।’

এদিকে, ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ বাস্তবায়নের উপায় ও পদ্ধতি সম্পর্কিত সুপারিশ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সাথে সভা করেছে কমিশন। জাতীয় সংসদে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় আগের দিনের অসমাপ্ত আলোচনা অব্যাহত রেখে অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। কমিশন আশা করছে, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য সুনির্দিষ্ট ও পূর্ণাঙ্গ সুপারিশ অতি শিগগিরই সরকারের কাছে জমা দেয়া সম্ভব হবে। ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এম এ মতিন, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন মোহাম্মদ ইকরামুল হক, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট ড. শরিফ ভূইয়া, ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিক এবং ব্যারিস্টার তানিম হোসেইন শাওন। কমিশনের সদস্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বিচারপতি মো: এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. মো: আইয়ুব মিয়া ও সফর রাজ হোসেন।

সূত্র জানায়, বিশেষ আদেশে গণভোট বাস্তবায়ন হবে। আদেশের ভিত্তি হবে গণঅভ্যুত্থান। এরপর জনগণের সম্মতির জন্য সংবিধানের মৌলিক বিষয় সংশোধনের বিষয়গুলো গণভোটে যাবে।

সূত্র আরো জানায়, বিশেষজ্ঞরা আগে সাংবিধানিক আদেশ জারি করে গণভোট আয়োজনের পরামর্শ দিয়েছিলেন। যেহেতু সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তনের ক্ষমতা সংসদের নেই, তাই বিশেষজ্ঞরা আগামী সংসদের প্রথম অধিবেশনকে গণভোটের মাধ্যমে কন্সটিটুয়েন্ট (গাঠনিক) ক্ষমতা দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। ওই অধিবেশনের নাম হবে ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’। গণভোটে অনুমোদিত জুলাই সনদ অনুযায়ী ওই অধিবেশন সংবিধানের সংস্কার করবে। এরপর তা সাধারণ সংসদে রূপান্তর হবে।

সূত্র আরো জানায়, জুলাই আদেশ হতে পারে সংবিধানের সমতুল্য। এর নাম হবে ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়ন (সংবিধান) আদেশ ২০২৫।’ আর গণভোটের মাধ্যমেই তা চূড়ান্ত রূপ পাবে। এক্ষেত্রে জুলাই সনদ নয়, গণভোট হবে জুলাই আদেশের ওপর। এই আদেশ পাশ হলে সংস্কার ও জুলাই সনদ বাস্তবায়ন হবে। তবে যেসব বিষয়ে বিভিন্ন দলের নোট অব ডিসেন্ট আছে, সেগুলোও কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুসারে বাস্তবায়ন করতে চায়। এক্ষেত্রে সংসদের উচ্চকক্ষে পিআর (আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব), তত্ত্বাবধায়ক সরকার, একজন ব্যক্তির তিন পদে (নির্বাহী বিভাগের প্রধান, সংসদ নেতা ও দলের প্রধান) না থাকা এবং সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ব্যাপারে কমিশন যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা বাস্তবায়ন করতে চায়। এর সবকিছুই আদেশে থাকবে।

এদিকে, বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে এক অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সংবাদ মাধ্যমে খবর এসেছে জুলাই সনদ বাস্তাবায়নে একটি আদেশ জারি করা হবে। কেউ বলছেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের জনগণের অভিপ্রায় অনুযায়ী প্রধান উপদেষ্টা আদেশ জারি করতে পারেন। কিন্তু সেটা বৈপ্লবিক কথা, ইমোশনাল কথা, রাষ্ট্র কোনো ইমোশনের ওপরে চলে না। রাষ্ট্র আইনকানুন, বিধিবিধান, নিয়মকানুনের মধ্য দিয়ে চলে। কারণ প্রধান উপদেষ্টা সরকার প্রধান এবং সরকার প্রধানের 'আইন জারির কোনো অধিকার বাংলাদেশের সংবিধানে নেই। সরকারের পক্ষে মন্ত্রিসভার অনুমোদনে সেটা সংসদ না থাকলে, রাষ্ট্রপতি সে আইনগুলো পাশ করে থাকেন। ফলে সরকারিভাবে একটা বিষয় সরকার করতে পারে, সেটা হচ্ছে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে, গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে। জুলাই সনদকে খুশি হওয়ার জন্য সেটি যদি আদেশ বলে থাকেন, ঠিক আছে।’

উল্লেখ্য, জুলাই সনদ ইতোমধ্যে চূড়ান্ত হয়েছে। গত ১৭ অক্টোবর বিএনপি, জামায়াতসহ ২৪টি দল সনদে স্বাক্ষর করেছে। দু’ দিন পর স্বাক্ষর করে গণফোরাম। অর্থাৎ ২৫টি দল ইতোমধ্যে স্বাক্ষর করেছে। কিন্তু এনসিপি এখনো সনদে সই করেনি। দলটি বলছে, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের লিখিত কপি এবং গণভোটের প্রশ্নটি চূড়ান্ত করে আগেই জনগণের কাছে প্রকাশ করতে হবে। তবে গণভোটের ব্যাপারে দলগুলো একমত হলেও ভোটের সময় নিয়ে আপত্তি আছে। বিএনপি বলছে, জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একইদিনে ভিন্ন ব্যালটে হবে। জামায়াত ও এনসিপি বলছে আগে গণভোট, পরে জাতীয় নির্বাচন। এ নিয়ে বর্তমানে মাঠে আন্দোলন করছে জামায়াতসহ আট দল। এই সনদ বাস্তবায়নে সুপারিশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।