মাওলানা রিদওয়ান হাসান

শাপলা গণহত্যার বিচার হলে স্বৈরাচার হয়ে ওঠার আগেই আ’লীগের পতন হতো

যাত্রাবাড়ীতে ছাত্রদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে যে কয়েকজন তরুণের সক্রিয় ভূমিকা ছিল, তাদের অন্যতম যাত্রাবাড়ী বড় মাদরাসার শিক্ষক ও সাধারণ আলেম সমাজের আহ্বায়ক মাওলানা রিদওয়ান হাসান।

বেলায়েত হুসাইন
গত বছর জুলাই মাসে আন্দোলনের কর্মসূচিতে বক্তব্য রাখছেন মাওলানা রিদওয়ান হাসান
গত বছর জুলাই মাসে আন্দোলনের কর্মসূচিতে বক্তব্য রাখছেন মাওলানা রিদওয়ান হাসান |সংগৃহীত

জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম প্রধান স্পট ছিল যাত্রাবাড়ী এলাকা। এখানে সাধারণ ছাত্রজনতার পাশাপাশি প্রচুর সংখ্যক আলেম ওলামা ও মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। এখানটায় ছাত্রদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে যে কয়েকজন তরুণের সক্রিয় ভূমিকা ছিল, তাদের অন্যতম যাত্রাবাড়ী বড় মাদরাসার (জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়া) শিক্ষক ও সাধারণ আলেম সমাজের আহ্বায়ক মাওলানা রিদওয়ান হাসান। তিনি কওমি মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদের আন্দোলনে যুক্ত করতে নানা কৌশল অবলম্বন করেছেন।

অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে সে সব বিষয়ে তিনি কথা বলেছেন নয়া দিগন্ত অনলাইনের সাথে।

তার বক্তব্যে উঠে এসেছে অভ্যুত্থানের পেছনের প্রেক্ষাপট, মজলুম মানুষের প্রতি কওমি আলেমদের আন্তরিকতা, সহমর্মিতা ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় তাদের আত্মত্যাগসহ আরো নানা বিষয়।

নয়া দিগন্ত : জুলাই অভ্যুত্থানে কওমি মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকের অংশগ্রহণ ছিল অত্যন্ত লক্ষ্যণীয়। আপনি কিভাবে এর সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন?

রিদওয়ান হাসান : জুলাই গণঅভ্যুত্থানে মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদের অংশগ্রহণ ছিল অকল্পনীয়। এর পেছনে বোধহয় যে জিনিসটা সবচেয়ে বেশি শক্তি যুগিয়েছে, তা হচ্ছে আমাদের ইন্তিফাদা। আমি বিশ্বাস করি, ২০১৩ সালে যদি শাপলা গণহত্যার বিচার চাওয়া হতো, তাহলে আওয়ামী লীগ স্বৈরাচার হয়ে ওঠার আগেই তার পতন হয়ে যেত। শাপলা চত্বরে তো একইভাবে নিরীহ নিরস্ত্র তাহাজ্জুদরত আলেম-ওলামাদের ওপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছিল।

আন্দোলন দমাতে মানুষকে হত্যা করার ব্যাপারটা আওয়ামী লীগ শিখেছেই মূলত শাপলা গণহত্যার মধ্য দিয়ে। এরপর ২০২১ সালে মোদিবিরোধী আন্দোলনে দ্বিতীয়বারের মতো গণহত্যা, আল্লামা সাঈদীর প্রহসনের রায়কে ঘিরে সপ্তাহব্যাপী দুই শ’ মানুষকে হত্যা।

এগুলো যেমন স্বৈরাচারী শেখ হাসিনাকে আরো দাম্ভিক ডিক্টেটর করে তুলেছিল, তেমনি ফ্যাসিবাদবিরোধী ধারাবাহিক সংগ্রামে এসব দেখে আলেম-ওলামারাও তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠছিল। এ হিসেবে বলতে পারেন, আমি সেই ২০১৩ সাল থেকেই এই অভ্যুত্থানের সাথে সম্পৃক্ত।

নয়া দিগন্ত : জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানে আপনারা কিভাবে সম্পৃক্ত হলেন? যেখানে কোটা কিংবা সরকারি চাকরি-বাকরির সাথে কওমি মাদরাসার কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই।

Ridwan-Hasan-Rally

রিদওয়ান হাসান : আপনি ঠিক বলেছেন, কোটার সাথে কওমি মাদরাসার নাগরিক সুবিধার কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু যে ব্যানারে এই আন্দোলন চলছিল, মানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এই বৈষম্যের সাথে আমাদের সম্পর্ক খুবই পুরোনো। দাড়ি-টুপি মানেই নাগরিক মর্যাদাহীন একটি পিছিয়ে পড়া অনগ্রসর গোষ্ঠী হিসেবে আমাদেরকে যেভাবে দেখা হত, যেন নিজ দেশেই তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক। এসব নানান পুঞ্জীভূত ক্ষোভ থেকে আমাদের কাছে মনে হয়েছে যে, কোটা পদ্ধতি একটি বৈষম্যের উপকরণ। ফলে এই আন্দোলনের প্রতি আমাদের শুরু থেকেই মৌন সমর্থন ছিল। এরপর যখন আবু সাঈদকে কাছ থেকে গুলি করার দৃশ্য আমরা দেখতে পাই এবং আরো ৫ শিক্ষার্থীকে শহীদ করার ঘটনা জানতে পারি, তখন এটি আর কোটা আন্দোলনে সীমাবদ্ধ থাকেনি; বরং এটি একটি নৈতিক আন্দোলনে রূপ নেয়।

কেন এটি একটি নৈতিক আন্দোলন, তার জন্য আমরা প্রথম ১৮ জুলাই তরুণ আলেমদের একটি বিবৃতি প্রকাশ করি। যাত্রাবাড়ী মাদরাসা থেকে ছাত্র আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে ফতোয়া দেয়া হয়, হেফাজত থেকে রাজপথে নামার ঘোষণাও দেয়া হয়। এরপর থেকেই আমি এই আন্দোলনে পুরোপুরি জড়িয়ে যাই।

নয়া দিগন্ত : মাঠপর্যায়ে আপনার প্রত্যক্ষ ভূমিকা ও অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাই! আর আপনার এই অংশগ্রহণকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করেন?

রিদওয়ান হাসান : একজন শিক্ষক হয়ে আমি অন্য সব শিক্ষার্থীদের মতো মাঠপর্যায়ে প্রত্যক্ষ ভূমিকা না রাখলেও ১৯ তারিখ জুমার নামাজের মধ্যেই যখন গায়ের মধ্যে গুলির ছিটা এসে পড়ছিল, টিয়ারশেল এসে নামাজের কাতারকে করে দিচ্ছিল ছিন্নভিন্ন। তখন বিষয়টা অত্যন্ত আহত করেছিল, এ যেন সাক্ষাত ফিলিস্তিন। যেখানে নামাজকেও আন্দোলনের সহায়ক মনে করে দমন করার চেষ্টা চালানো হয়। আমি সেই ১৯ তারিখ প্রথমবারের মতো মাঠপর্যায়ে এ আন্দোলনকে প্রত্যক্ষ করি। তখন তো ইন্টারনেট ছিল না। যেসব শিক্ষার্থী মাঠপর্যায়ে ভূমিকা রাখছিল, তাদের কাছে নিয়মিত খোঁজখবর নেয়া, মাঝেমধ্যে নিজেও এই ভয়াবহতা উপলব্ধি করার জন্য রাজপথে নেমে দেখেছি।

কোটা আন্দোলনের শুরুর দিকে মাদরাসা শিক্ষার্থীরা ছদ্মবেশে নামলেও ১৯ তারিখের পর থেকে কিছুটা ছদ্মবেশ ভেঙে নামতে শুরু করে এবং মাদরাসাগুলোতে সেটা মোমের আগুনের মতো এক মাদরাসা থেকে আরেক মাদরাসায় ছড়িয়ে যেতে শুরু করে। যাত্রাবাড়ীতে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের এই প্রতিরোধ মুহূর্তেই দাবানলের মতো দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ছড়িয়ে যায়। এটা চলে একেবারে জুলাইয়ের শেষ পর্যন্ত। কিন্তু জুলাই কি শেষ হয়েছিল? ক্যালেন্ডারের পাতায় জুলাই শেষ হলেও সেটা যখন নতুন জুলাইয়ের ইতিহাস রচনা করে, তখন থেকেই প্রতিধ্বনিত হয় স্বৈরাচারের পতন। আমরা সাধারণ আলেম সমাজের ব্যানারে এই অভ্যুত্থানে স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখি এবং রাজপথ ধরে রাখার কৌশল হিসেবে আমরা ধর্মীয় আবহে নিজস্ব কর্মসূচি দিই। গাশত ও খুরুজ কর্মসূচি ছিল আমাদের ইতিহাসের আইকনিক অধ্যায়।

নয়া দিগন্ত : আপনি আপনার এই অংশগ্রহণকে কিভাবে মূল্যায়ন করেন?

রিদওয়ান হাসান : মূল্যায়ন তো করবে জাতি। আমি তো শুধু আমার দায়িত্ব পালন করে গেছি। আমি মনে করি, আওয়ামী লীগ সবসময় আলেমদের নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করেছে এবং শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রযন্ত্র দ্বারা দমন-নিপীড়ন আর জুজুর ভয় দেখিয়ে আলেম সমাজের এই নৈতিক ভিত্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে গেছে। এই আন্দোলনেও দেখবেন সম্ভবত ৩০ জুলাই আলেম সমাজের কেন্দ্রীয় ভূমিকায় যারা রয়েছেন, তাদের সাথে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও ধর্মমন্ত্রী দফায় দফায় মিটিং করে তাদের এ নৈতিক পরিসরকে দুর্বল করার চেষ্টা চালানো হয়েছিল। ফলে পরের দিন পত্রিকাগুলোর শিরোনাম হয়, আলেমরা সরকারের পাশেই থাকবেন। এসব দেখে মনে হচ্ছিল আমরা আবারো রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন আর প্রতারণার শিকার হচ্ছি। ফলে আলেম সমাজের এই কেন্দ্রীয় চেইন অব কমান্ডকে এবার ভাঙতে হবে। নয়ত এই জেনজি প্রজন্ম আলেম সমাজকে কেবল কটূক্তি করার জন্য স্মরণ করবে।

নয়া দিগন্ত : অভ্যুত্থানে শুধু কওমি অঙ্গনেই অন্তত ৪২ জন শহীদ হয়েছেন, তাদের এই ত্যাগের বিনিময় কি আপনারা পেয়েছেন এবং তাদের স্মরণে ও সম্মানে কী পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন?

রিদওয়ান হাসান : কওমি পরিমণ্ডল পুরোটা পরিচালিত হয় জনগণের টাকায়, অর্থাৎ দান-সদকা দিয়ে। দেশের কোনো সরকারেই এই জনগোষ্ঠীকে মেইনস্ট্রিম মনে করতে পারেনি।

ফলে আমাদের রক্তের ওপর দিয়ে যারাই সরকারে গেছে, তারাই প্রতারণা করেছে। এই যে এত এত শহীদ হয়েছে, আমরা আল্লাহর কাছে এর প্রতিদান পাবো, এই বিশ্বাস করি বলেই কিছু না নিয়ে ঘরে ফিরে গেছি।

তবে যাদের রক্তের বিনিময়ে আমরা আবারো স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারছি, তারা আমাদের ইতিহাসের বাতিঘর। তাদের আত্মত্যাগ কোনো দলীয় এজেন্ডার মধ্যে পড়ে না। তাদের স্মরণে সবচেয়ে ছোট কাজটি হতে পারে, কওমির পাঠ্যসূচিতে তাদের বীরত্বগাঁথা, তাকওয়া এবং দূরন্ত সাহসিকতার গল্পগুলো তুলে ধরা। সরকার এ উদ্যোগ নিবে কিনা জানি না, এ উদ্যোগ আমাদের নিজেদেরই নিতে হবে।

নয়া দিগন্ত : আন্দোলন চলাকালে হেফাজতে ইসলাম অভ্যুত্থানে নিহতদের ‘শহীদ’ আখ্যা দিয়েছিল। এই ঘোষণা কি আন্দোলনের গতি বাড়াতে কিংবা আন্দোলনে ইতিবাচক কোনো প্রভাব ফেলেছিল কিনা?

রিদওয়ান হাসান : হ্যাঁ, অবশ্যই। এই ঘোষণা একটি আইকনিক টার্ন ছিল। এটি শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাস ফেরাতে একটি মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব তৈরি করেছিল। তবে আমরা সে সময় হেফাজতের থেকে আরো দায়িত্বশীল ভূমিকা আশা করেছিলাম।

নয়া দিগন্ত : রাজনৈতিক কোনো ব্যানারের বাইরে গণঅভ্যুত্থানে কওমি আলেমদের এই যে বৃহৎ অংশগ্রহণ, তাতে দেশের মানুষের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা ও মূল্যায়ন বৃদ্ধি পেয়েছে নাকি অবনতি হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?

রিদওয়ান হাসান : গ্রহণযোগ্যতা তো বহুগুণ বেড়েছে। আগে যারা ভাবতেন, আলেম সমাজ শুধু ওয়াজ-মাহফিল আর মসজিদ-মাদরাসার চার দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তারা এখন বুঝেছেন যে, আলেম সমাজ জাতীয় সংকটে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম। ফলে কওমি অঙ্গনের মধ্যে যে আত্মমর্যাদাবোধ, দায়িত্ববোধ এবং সাংগঠনিক শৃঙ্খলার উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে, তা দীর্ঘমেয়াদে জাতিকে আশাবাদী করবে, ইনশাআল্লাহ।

নয়া দিগন্ত : আন্দোলনের সময় রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন, গ্রেফতার, নির্যাতন ইত্যাদি নিয়ে কী ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে আপনাদের?

রিদওয়ান হাসান : যাত্রাবাড়ী মাদরাসার কয়েকজন শিক্ষার্থী ৪ আগস্ট ছাত্রলীগ কর্তৃক একটি ভবনে আটকা পড়েছিল। সেখান থেকে তাদের থানায় নিয়ে গেলে তাদের মুচলেকা দিয়ে ছাড়িয়ে আনতে হয়েছে আমার।

পুলিশ সে সময় অত্যন্ত আপত্তিকর আচরণ করেছে। হয়ত কলেজ ইউনিভার্সিটির শিক্ষক হলে এমনটি করত না। আরো দুইজন শিক্ষার্থী নিখোঁজ ছিল। পরবর্তীতে আমরা জানতে পেরেছিলাম, থানার ভেতরে তাদের আটকে রাখা হয়েছিল।

তবে সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হলো, নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যা দিয়ে যাচ্ছিল পুলিশ-প্রশাসন এবং গণমাধ্যমগুলো।

নয়া দিগন্ত : আন্দোলনে অংশগ্রহণের পেছনে কওমি ছাত্র-শিক্ষকদের নৈতিক ও আদর্শিক প্রেরণা কী ছিল? তারা কেন এই অভ্যুত্থানের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করলেন?

রিদওয়ান হাসান : আমরা এই অভ্যুত্থানকে নিছক ‘সরকার পরিবর্তন’ হিসেবে দেখিনি। এটি ছিল একটি নৈতিক বিপ্লব। কওমি ছাত্র-শিক্ষকরা রাসুল সা:-এর আদর্শে গড়া সমাজ চায়, যেখানে জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ফরজ। সেই ঈমানি প্রেরণাই আমাদের রাজপথে নামিয়েছিল। আমরা যে কোনো জুলুমের বিরুদ্ধে মজলুমের পক্ষে অবস্থান নিই। আমরা মজলুমের পক্ষে একাত্মতা ঘোষণা করি, কিন্তু এরই মধ্য দিয়ে আমাদের স্বাতন্ত্র্য এবং সাইন ধরে রাখার চেষ্টা করি।

নয়া দিগন্ত : ইন্টারনেট ও মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ থাকার সময়ও মাঠে উপস্থিত জনশক্তির মধ্যে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ কিভাবে বজায় রাখা হয়েছিল?

রিদওয়ান হাসান : প্রতিনিয়ত গুলির শব্দ আর ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ যাত্রাবাড়ীর প্রতিটা চোখ দেখেছে। জুলুমের যাবতীয় শব্দ, গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেডের বিপরীতে নারায়ে তাকবির স্লোগানই ছিল আমাদের অবিচ্ছেদ্য নেটওয়ার্ক। এই স্লোগান মুহূর্তেই জনশক্তিকে এক সুতোয় গেঁথে ফেলত। এ ছাড়াও গাশত ও খুরুজের আদলে চলাফেরার অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের মৌখিক নির্দেশনা ও পরিকল্পনা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সেল তৈরি করে রাজপথ ধরে রাখা হয়েছে।

নয়া দিগন্ত : আন্দোলন কিভাবে একসাথে পরিচালিত হতো? কেন্দ্র থেকে আপনাদের দিকনির্দেশনা দেয়া হতো কিভাবে? আর এই দিকনির্দেশনাগুলো মাঠপর্যায়ের কর্মীদের কাছেই বা কিভাবে পৌঁছে দিতেন?

রিদওয়ান হাসান : যাত্রাবাড়ীতে কেন্দ্রীয় নির্দেশনা মেনে আন্দোলন হয়নি। এখানে সবাই নেমেছিল জুলুম আর গণহত্যার দৃশ্য দেখে। এ কারণে যাত্রাবাড়ীতে এখনো কোনো সমন্বয়ক নেই। মাছ আড়তের কর্মী থেকে শুরু করে শ্রমিক ও রিকশাচালক সবাই ছিল সমন্বয়ক। তবে আমরা কিছু টিম তৈরি করেছিলাম, যাদের দায়িত্ব ছিল, আহতদের উদ্ধার ও চিকিৎসা সহায়তা দেয়া। কেন্দ্রের সাথে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল, সেটা খুব সামান্য। এতটুকুই।

নয়া দিগন্ত : কওমি অঙ্গনের মধ্যে বিভিন্ন মত ও সংগঠন থাকা সত্ত্বেও এই অভ্যুত্থানে ঐক্য দেখা গেছে। এর পেছনে মূল সূত্র কী ছিল?

রিদওয়ান হাসান : এর অন্যতম কারণ হচ্ছে এই আন্দোলন দলীয় কিংবা রাজনৈতিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট আন্দোলন ছিল না। এটা ছিল ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার জন্য স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ। সবাই বুঝেছিল, এখানে মতভেদ নয়; নাগরিক অধিকার, ইনসাফ ও আত্মমর্যাদার প্রশ্ন। আসলে মজলুমের রক্ত গড়িয়ে এক জায়গায় গেলে বিভক্তি টিকে থাকে না।

নয়া দিগন্ত : ভবিষ্যতের বাংলাদেশে ইসলামী নেতৃত্ব ও কওমি আলেমদের ভূমিকা আপনি কিভাবে কল্পনা করেন?

রিদওয়ান হাসান : এটা আমার কল্পনা করতে ভালো লাগে যে, আগামীর বাংলাদেশে আলেম সমাজ হবে গণজাগরণের অগ্রপথিক। কারণ, একজন জনপ্রতিনিধির চেয়েও জনগণের সবচেয়ে কাছের অভিভাবক হচ্ছে আলেম সমাজ। শুধু ধর্মীয় অভিভাবক নয়; সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অভিভাবক। তারা অন্তত সপ্তাহে একদিন মসজিদের মিম্বরে জনসচেতনমূলক বার্তা দেয় এবং জনগণও আলেমদের অভিভাবকত্ব গ্রহণ করে। অথচ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির সেবা নেয়ার জন্য লম্বা শিডিউল নিতে হয়। এক্ষেত্রে কওমি অঙ্গনের নেতৃত্ব শুধু ওয়াজের ময়দানে নয়; বরং শিক্ষা সংস্কার, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং রাষ্ট্র সংস্কারে যেন আলেমদের শক্ত ভূমিকা থাকে, এই স্বপ্ন নিয়ে আমরা কাজ করছি।