সিপিডির ওয়েবিনার

দেশে উৎপাদিত খাদ্যের ৩৪ শতাংশ অপচয় হয়

ফসল নষ্টের আর্থিক মূল্য ২.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার

এছাড়াও, দেশের ২৭ শতাংশ জমি এমন খাদ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়, যা কখনোই খাওয়া হয় না বলে এক গবেষণায় উঠে এসেছে।

বিশেষ সংবাদদাতা
‘শূন্য খাদ্য অপচয়ের পথে : বাংলাদেশে একটি টেকসই খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা গঠন’ শীর্ষক সম্মেলন
‘শূন্য খাদ্য অপচয়ের পথে : বাংলাদেশে একটি টেকসই খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা গঠন’ শীর্ষক সম্মেলন |সংগৃহীত

বাংলাদেশে খাদ্য অপচয় একটি নীরব অথচ গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। দেশে উৎপাদিত খাদ্যের প্রায় ৩৪ শতাংশ নষ্ট বা অপচয় হয়। এর ফলে অর্থনৈতিক, পরিবেশগত এবং সামাজিক ক্ষেত্রে মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি হয়। যেমন, দেশের ২৭ শতাংশ জমি এমন খাদ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়, যা কখনোই খাওয়া হয় না বলে এক গবেষণায় উঠে এসেছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, এর ফলে ১৩ শতাংশ গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত হয়। যার আর্থিক মূল্য দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের বা জিডিপি’র চার শতাংশের সমান। ডব্লিউএফপি বলছে, যে পরিমাণ খাদ্য নষ্ট হয় তার আর্থিক মূল্য ২.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

সোমবার (২৯ সেপ্টেম্বর) সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি), ঢাকায় অবস্থিত রয়েল ডেনিশ দূতাবাস, জাতিসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO), বিশ্বব্যাংক এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) যৌথভাবে ‘শূন্য খাদ্য অপচয়ের পথে : বাংলাদেশে একটি টেকসই খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তোলা’ শীর্ষক একটি সম্মেলনে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়।

এ সম্মেলনে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদাররা একত্রিত হয়ে দেশে খাদ্য অপচয় কমানোর জন্য কার্যকর সমাধান নিয়ে আলোচনা করেন। সম্মেলনে সরকারি কর্মকর্তা, বেসরকারি খাতের উদ্ভাবক, বিশেষজ্ঞ এবং উন্নয়ন অংশীদাররা বাংলাদেশে খাদ্য অপচয় ও অপচয় কমাতে কার্যকর কৌশল নিয়ে আলোচনা করেন।

অন্তর্বর্তী সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আক্তার বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে খাদ্য অপচয় কমানোর ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, ‘আকর্ষণীয় প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও, বাংলাদেশ এখনো অপুষ্টিতে ভুগছে। বিশেষ করে নারীরা এই অপুষ্টির শিকার। অন্যদিকে খাদ্য বন্টন এখনো অসম। তাই, খাদ্যের অপচয় কমানো বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।’

উপদেষ্টা বলেন, কৃষকরা প্রায়শই সীমিত সহায়তার কারণে খাদ্য উৎপাদনে হিমশিম খান। তাদের জন্য পর্যাপ্ত সংরক্ষণ ব্যবস্থা, মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি বা অবকাঠামোগত সহায়তা নেই। যখন তারা তাদের উৎপাদিত পণ্য সংরক্ষণ করেন, তখন তারা পর্যাপ্ত মূল্য সহায়তা পান না। যা অপচয়ের দিকে নিয়ে যায়। উপদেষ্টা খাদ্য অপচয় কমাতে এবং দেশের খাদ্য নিরাপত্তা উন্নত করতে বৃহত্তর সমর্থন ও উন্নত অবকাঠামোর আহ্বান জানান।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ইয়াসিন বলেন, ‘বাংলাদেশ মাটির উর্বরতা, অর্থ, পানি এবং শ্রম হারাচ্ছে। এ কারণে দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের জন্য কম খাদ্য উৎপাদিত হচ্ছে। ফলে এই জনগোষ্ঠী খাদ্য ঝুঁকিতে পড়ছে।’

বাংলাদেশে ডেনমার্ক দূতাবাসের চার্জ ডি’অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ডার্স কার্লসেন বিশ্বব্যাপী খাদ্য অপচয়ের মাত্রা তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, উৎপাদিত মোট খাদ্যের এক-তৃতীয়াংশ নষ্ট বা অপচয় হয়। এই খাদ্য উৎপাদনের জন্য চীন দেশের চেয়েও বড় এলাকা ব্যবহার করা হয়। যা শেষ পর্যন্ত কেউ খায় না। তিনি বলেন, শুধু খাদ্যই অপচয় হয় না। উৎপাদন ও পরিবহনের সময় কৃষিজমি এবং গ্রিনহাউস গ্যাসও নষ্ট হয়। তিনি জরুরি পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।

তিনি বলেন, ‘পদক্ষেপ নেয়ার সেরা সময় আজ। যদি গতকাল না হয়, তাহলে আজই।’

এফএও-এর ডেপুটি প্রতিনিধি দিয়া সানো খাদ্য অপচয়ের বৈশ্বিক ও স্থানীয় প্রভাব ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, বিশ্বে উৎপাদিত খাদ্য বৈশ্বিক জনসংখ্যার ১.৫ গুণেরও বেশি মানুষকে খাওয়ানোর জন্য যথেষ্ট। তবুও অসম বন্টন, দুর্বল অবকাঠামো এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, খাদ্য অপচয়ের কারণে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ও অপুষ্টি রয়ে গেছে। তিনি বলেন, উদ্বৃত্ত থাকা সত্ত্বেও, খাদ্য অপচয়ের কারণে সবচেয়ে অভাবী মানুষের কাছে পর্যাপ্ত খাদ্য পৌঁছায় না।

ডব্লিউএফপি বাংলাদেশের ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর জেসি উড বাংলাদেশে খাদ্য অপচয়ের মাত্রা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে, ফসল তোলার পর আট থেকে ১৫ শতাংশ চাল এবং ২০ থেকে ৪০ শতাংশ ফল ও সবজি নষ্ট হয়। যার আর্থিক মূল্য ২.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তিনি উল্লেখ করেন যে, বাংলাদেশ সবজি, মাছ এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের উৎপাদনে একটি শক্তিশালী দেশ হওয়া সত্ত্বেও, অপর্যাপ্ত সংরক্ষণ ব্যবস্থা এবং কোল্ড চেইনের কারণে দেশটিকে সেই পণ্যগুলোই আমদানি করতে হয়। এটি কৃষক এবং অর্থনীতি উভয়ের জন্যই একটি সুযোগের অপচয়।

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন পরিবেশগত প্রভাবের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘যদি আমরা খাদ্য অপচয় বাড়াই, তাহলে আমরা দুর্লভ পরিবেশগত সম্পদ নিঃশেষ করছি। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম, তাই আমাদের জন্য খাদ্য অপচয় কমানো অপরিহার্য।’