বাংলাদেশের ইতিহাসে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান এক অনন্য দলিল। যেখানে দল-মত নির্বিশেষে মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিল স্বাধিকার ও মুক্তির জন্য। সেই মুক্তির মিছিলে হাজারো মানুষের ভিড়ে কাজ করেছেন রাষ্ট্র সংস্কার ছাত্র আন্দোলনের সভাপতি আহমেদ ইসহাক। যার সাহস, সংকল্প এবং অবিচল দৃঢ়তা আরো শক্তিশালী করে তুলেছিল আন্দোলনকে।
ইসহাকের জন্ম কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার দয়াপুর গ্রামে। আরবি সাহিত্যে স্নাতক করে ২০১৮ সালে শুরু করেন রাজনৈতিক পথচলা। পরে ‘রাষ্ট্র সংস্কার ছাত্র আন্দোলন’-এর প্রতিষ্ঠাতা প্রধান সমন্বয়ক এবং কেন্দ্রীয় সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। রাজনীতির পাশাপাশি বৈষম্য ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বয়ান জারি রাখতে বিচরণ করছেন লেখালেখিতেও।
এছাড়া ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে ১৬টি ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্রঐক্য, ডানপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলোর জোট সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের সমন্বয় পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। জুলাই গণঅভ্যুত্থানেও সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসেবে ভূমিকা রাখেন ইসহাক। জুলাই পরবর্তী সময়ে জাতীয় যুবশক্তি এনসিপির কেন্দ্রীয় সংগঠক হিসেবে কাজ করছেন তিনি।

নয়া রাজনীতির স্বপ্নে হাল ধরা ইসহাক সম্প্রতি নয়া দিগন্ত অনলাইনের সাথে একান্তে মুখোমুখি হয়েছেন। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে মৃত্যুকে কাছ থেকে দেখা, নানান অভিজ্ঞতা ও অজানা গল্প জানালেন বিস্তর আলাপে।
নয়া দিগন্ত : জুলাইয়ের এক বছর পার হলো এখন কীভাবে সময় পার করছেন?
ইসহাক : যেই বাংলাদেশের জন্য আবু সাঈদ, ওয়াসিম, মুগ্ধসহ শত শত সহযোদ্ধাদের জীবন দিতে হয়েছে, হাজার হাজার সহযোদ্ধা আহত হয়েছে। নিজের জীবন বাজি রেখে আন্দোলনে নেমেছি, সেই বাংলাদেশ বিনির্মাণে নিয়োজিত হয়েছি।
জুলাই তো জীবনের অংশ বলা যায়। এখন জুলাইকে জারি রাখতে পুরো সময়টা রাজনীতি ও লেখালেখিতে মনোযোগ দিয়েছি। পাশাপাশি জুলাই অভ্যুত্থানে সক্রিয় তরুণদের সংগঠিত করে রাজনীতিতে আনার চেষ্টা করছি।
আমি বিশ্বাস করি যারা বুলেটের সামনে দাঁড়িয়েছে, ব্যর্থ হলে ফাঁসির জন্য প্রস্তুত ছিল, তারা রাজনীতিতে এলে বাংলাদেশের চিত্র পাল্টে যাবে। ফলে জাতীয় স্বার্থে আমি পুরো সময় রাজনীতিতে মনোনিবেশ করেছি।
নয়া দিগন্ত : জুলাই আন্দোলনে কত তারিখ, সরাসরি কীভাবে যোগ দিলেন?
ইসহাক : জুলাইয়ের ৮ তারিখে মাঠে নামি। যেহেতু রাজনীতি ও এক্টিভিজমে আগে থেকেই সক্রিয় ছিলাম। তাই যেকোনো গণআন্দোলনেই শরীক হতাম। যেকোনো বৈষম্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সবসময় মজলুমের পাশে থাকতাম। জুলাই গণঅভ্যুত্থান সেই মজলুমদের বিজয় এনে দিয়েছে।
নয়া দিগন্ত : কেউ উৎসাহ দিয়েছিল নাকি নিজ তাগিদেই আন্দোলন করেছিলেন?
ইসহাক : আগে থেকেই আন্দোলন-সংগ্রামের সাথে যুক্ত ছিলাম। ফলে নতুন করে উৎসাহ পাওয়ার কিছু নেই। নিজ তাগিদেই যুক্ত হয়েছি। একটি বৈষম্য ও ফ্যাসিস্ট মুক্ত দেশ গড়েতে আন্দোলনে গিয়েছি।

নয়া দিগন্ত : আন্দোলন চলাকালে সারাদেশে যখন নেট বন্ধ করে দেয়া হয় তখন আন্দোলন কীভাবে এগিয়ে নিলেন?
ইসহাক : যতকিছু্ই হোক সশরীরে উপস্থিত থাকার চেষ্টা করেছি। পাশাপাশি ফোন কলে, মেসেজে যোগাযোগ করতে হয়েছে বেশিরভাগ সময়। আন্দোলনের একপর্যায়ে সবাইকে পাওয়া সম্ভব ছিল না। কিছু করারও উপায় নেই। তখন তো আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিয়েছে। ফলে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবেই আন্দোলনের নেতৃত্ব হাতে নিয়েছে। যে যার যার মতো রাস্তায় নেমে এসেছে।
নয়া দিগন্ত : আপনি তো শুরু থেকেই মাঠে ছিলেন তো পুরো আন্দোলনে বিদেশীদের নজর কেমন দেখলেন?
ইসহাক : দেখেন, একটা সময় আন্দোলন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠে। বিশেষ করে আবু সাঈদ শহীদ হওয়ার পর আন্দোলন আরো গতি পায় এবং এই ঘটনা সারা দুনিয়ার দৃষ্টি বাংলাদেশর দিকে নিয়ে এসেছে। তারপর থেকেই ইউকে ও ইউএস হাইকমিশন, আল জাজিরাসহ আমেরিকান ও অন্য দেশের বিভিন্ন সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মীরা নানাভাবে আমার সাথে যোগাযোগ শুরু করে। ৫ আগস্ট পর্যন্ত তাদের সাথে যোগাযোগ ছিল। সাধ্য অনুযাযী চেষ্টা করেছি, আন্দোলনের গতিপথ, ছাত্রদের অবস্থান, সরকারের পরিস্থিতি সঠিকভাবে তুলে ধরতে।
নয়া দিগন্ত : আন্দোলনে আপনি তো অনেকবার আহত হয়েছেন, নানান হুমকি-ধামকিরও শিকার হয়েছেন এ নিয়ে যদি বলতেন।
ইসহাক : হুম। আন্দোলনের যোদ্ধাদের জন্য হুমকি-ধামকি এসব সামান্য ব্যাপার। এসব তোয়াক্কা করলে তো আর আন্দোলন হবে না। জালিমের মসনদ কাঁপিয়ে রাস্তায় নেমেছি। আসলে আন্দোলন মানেই রক্তাক্ত ইতিহাস। পরিবর্তনের ইতিহাস।
আন্দোলনে গিয়ে আহত হয়েছি অনেকবারই। ১৬ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও বহিরাগত সন্ত্রাসীদের আক্রমণে রক্তাক্ত হই। ১৯ জুলাই পুরানা পল্টন টিয়ারগ্যাসে মারাত্মকভাবে আহত হয়েছি। এসবে থেমে যাইনি, এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটেছি। আবারো ৫ আগস্ট শহীদ মিনারের সামনে রাবার বুলেটে আহত হয়েছি।
নয়া দিগন্ত : জুলাইয়ের যে আকাঙ্খা তার প্রতিফলন কতটুকু হচ্ছে, আপনার কী মনে হয়?
ইসহাক : ইতিহাস এমনই। আকাঙ্খার পরিপূর্ণ প্রতিফলন তো সবসময় হয় না। এই আন্দোলনে মোটা দাগে দুইটা আকাঙ্খা ছিল। একটা হলো সরকারের পরিবর্তন আর দুই নম্বর হলো শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন।
প্রথমটা তো হয়েছেই। দ্বিতীয়টা কতটা হয়েছে, সেটা সংস্কার কার্যক্রম, ঐক্যমত্য কমিশনের কর্মযজ্ঞ শেষ হওয়ার পরেই সামারি করা যাবে। তবে সবমিলিয়ে উপরওয়ালার দরবারে হাজার হাজার সিজদা। তিনি এই ফেরাউসিনার দুঃশাসন থেকে আমাদেরকে নাজাত দিয়েছেন।
নয়া দিগন্ত : আন্দোলনে আপনার সামনে কেউ শহীদ হয়েছে এমন উল্লেখযোগ্য ঘটনা থাকলে বলেন।
ইসহাক : আন্দোলনে তো অনেকেই শহীদ হয়েছে। আবার অনেকে গুরুতর আহত হয়েছিলেন। যাদের অনেকেই হয়তো পরবর্তীতে শহীদ হয়েছেন। ১৯ জুলাই পল্টন, কালভার্ট রোডে আমার খুব কাছে দাঁড়ানো এক ভাই গুলিতে শহীদ হন। ওই গুলিটা আমার গায়েও লাগতে পারত। এরকম অনেক স্মৃতি আছে। এগুলো মনে করলে মনটা খারাপ হয়ে উঠে আবার স্পৃহা পাই, নতুন উদ্যমে পথচলার সাহস পাই। সব বর্ণনা করা আসলে কঠিন।
নয়া দিগন্ত : ৫ আগস্টের (৩৬ জুলাই) পরিকল্পনা কী ছিল, ওই দিন কোন এলাকায় ছিলেন?
ইসহাক : খুব সকালে শহীদ মিনারে যাই। শহীদ মিনার ঝাড়ু দিয়ে পরিস্কার করছিলাম। কিছু মিডিয়ায় কথা বলছিলাম। ঠিক ওই সময় পুলিশ অনবরত গুলি করতে করতে শহীদ মিনারের দিকে প্রবেশ করে। আমরা অল্প কিছুজন সেখানে ছিলাম। আমরা হাত তুলে দাঁড়ানোর পরও পুলিশ গুলি বন্ধ করেনি।
সামনে এসেই বেদম লাঠিপেটা করে, রাবার বুলেট ছুঁড়, সাউন্ড গ্রেনেড মারে। আমিসহ বেশ কয়েকজন রাবার বুলেটে রক্তাক্ত হই। বেশ কয়েকজন গ্রেফতার হয়। আমরা কয়েকজন ঢাকা মেডিক্যালের জরুরি বিভাগে আশ্রয় নেই। দুপুর ২টা পর্যন্ত সেখানে আটকে থাকি। পরে ২টার দিকে বিজয় মিছিল নিয়ে শাহবাগে জড়ো হই।
নয়া দিগন্ত : জুলাইয়ে জীবন বাজি রেখে আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়লেন, আহতও হলেন পরে কেউ আপনার খোঁজ নিয়েছে?
ইসহাক : মজার প্রশ্ন করলেন। সবচেয়ে বেশি খোঁজ নিয়েছে আওয়ামীবিরোধী রাজনীতি করার কারণে যারা পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিপীড়নে ভূমিকা রেখেছিল তারা। তারপর কিছু নির্যাতিত মানুষ খোঁজ খবর নিয়েছে। এছাড়া কিছু সুবিধাবাদিও বিভিন্ন বিষয়ে সাহায্যের জন্য যোগাযোগ করেছে।
নয়া দিগন্ত : আপনি কেমন বাংলাদেশ দেখতে চান?
ইসহাক : এটা এক কথায় উত্তর দেয়া যায়। ধরেন একটা ফেরাউন থেকে দেশ মুক্ত হয়েছে। নতুন কোনো নমরুদের হাতে দেশকে দেখতে চাই না।
নয়া দিগন্ত : জুলাইয়ের এক বছর পার হয়েছে, এখন আপনার কী মনে হয়?
ইসহাক : মাথার উপর থেকে একটা জগদ্দল পাথর নেমে গেছে এতটুকু প্রশান্তি তো পাই-ই। মনে হয়, ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি। স্বাধীনতাযুদ্ধসহ স্বাধীনতা পরবর্তীতে প্রত্যেকটা গণআন্দোলনে রাজনীতিবিদরা জনগণের সাথে গাদ্দারি করেছে।
সামনের পথও কঠিন, সচেতনভাবে হাল ধরতে হবে। যদি একটা সুন্দর বাংলাদেশ বিনির্মাণ না করতে পারি, একটা বৈষম্যমুক্ত দেশ উপহার দিতে না পারি তাহলে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে মুখ দেখাতে পারবো না।
নয়া দিগন্ত : আপনি রাজনীতির লোক। জনগণ তো রাজনীতিবীদদের আয়না হিসেবে দেখে সে জায়গা থেকে কীভাবে ভূমিকা রাখছেন?
ইসহাক : দেশের রাজনীতির ধারা পরিবর্তন করতে হবে। নয়া রাজনৈতিক বন্দোবস্ত করা জরুরি। এই নষ্ট রাজনীতি পরিবর্তন করতে হলে আগে নষ্ট রাজনীতিবিদদের কব্জা থেকে রাজনীতিকে মুক্ত করতে হবে। সাংগঠনিকভাবে তরুণদের সংগঠিত করছি, রাষ্ট্র সংস্কার ও নতুন বন্দোবস্তের বিকল্প রাজনৈতিক কণ্ঠ তৈরি করার চেষ্টা করছি।
নয়া দিগন্ত : জুলাইয়ের পরও এখনো নানান শঙ্কা থেকে যায়, যদি দেশ ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আবারো বিপ্লবের ডাক আসে কী করবেন?
ইসহাক : দেখেন, একটা গণঅভ্যুত্থানের পর অনেক পটপরিবর্তন ঘটে যায়। এখনো গণঅভ্যুত্থানের ফল কোনোভাবে ঘরে তুলতে ব্যর্থ হলে অবশ্যই বিপ্লবের ডাক আসবে। মানসিকভাবে আমরা সেটারই প্রস্তুতিই নিচ্ছি। সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে কোনো আপস নেই। আমরা ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়ছি, যেকোনো বিদেশী আধিপত্যবাদি শক্তির বিরুদ্ধে জুলাই ও লড়াই চলমান থাকবে।