কেআইবিতে ভাঙচুর, বিএনপিপন্থী ৭০ কৃষিবিদের বিরুদ্ধে মামলা

রাজধানীর খামারবাড়ি সড়কে অবস্থিত কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশের (কেআইবি) প্রশাসনিক ভবনে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।

নিজস্ব প্রতিবেদক
কেআইবি
কেআইবি |নয়া দিগন্ত

রাজধানীর খামারবাড়ি সড়কে অবস্থিত কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশের (কেআইবি) প্রশাসনিক ভবনে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।

অভিযোগ উঠেছে, সোমবার বিকেল ৪টার দিকে বিএনপিপন্থী কৃষিবিদদের সংগঠন এগ্রিকালচারিস্ট অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এ্যাব) নেতাকর্মীরা এই হামলা ও ভাঙচুর চালিয়েছে; যাতে অংশ নিয়েছে সংগঠনটির আহ্বায়ক কামরুজ্জামান কায়সার ও সদস্যসচিব শাহাদাত হোসেন বিপ্লবের নেতৃত্বে ৭০-৮০ জন।

কেআইবি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ সময় তারা কেআইবির প্রশাসক লে কর্নেল (অব.) মো: আব্দুর রব খানকে তার দফতরে প্রায় এক ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখেন। তাকে পদত্যাগের জন্য হুমকি দেয়া হয় এবং ভবিষ্যতে যেন কেআইবিতে না আসেন সে সতর্কবার্তাও দেয়া হয়। এ সময় তারা ভবনের নিরাপত্তারক্ষী ও অফিসকর্মীদের জোর করে বের করে দেন। প্রশাসক ও নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ের নামফলক এবং সিসি ক্যামেরা ভাঙচুর করা হয়। একইসাথে নিচতলার সিসি ক্যামেরার কম্পিউটার থেকে হার্ডডিস্ক খুলে নিয়ে যায়।

ঘটনার পর সোমবার রাতে পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। এ ঘটনায় রাতেই তেজগাঁও থানায় মামলা করেছে কেআইবি কর্তৃপক্ষ। মামলায় এ্যাবের আহ্বায়ক কামরুজ্জামান কায়সার, সদস্যসচিব শাহাদাত হোসেন বিপ্লব, কৃষিবিদ সবুর, আশরাফ ও টিপুসহ অজ্ঞাত ৭০ জনকে আসামি করা হয়েছে।

জানা যায়, প্রায় ১৬ বছর পর কেআইবিতে নির্বাচন আয়োজনের উদ্যোগকে ঘিরে গত এক সপ্তাহ ধরে প্রায় ৩৩ হাজার কৃষিবিদদের সংগঠনটিতে উত্তেজনা চলছিল। গত ২৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক লুৎফুর রহমানকে প্রধান করে সাত সদস্যের নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়। কমিশন এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে তফসিল ঘোষণা না করলেও ৩০ নভেম্বরের মধ্যে ভোটার তালিকা চূড়ান্ত করার কথা জানিয়েছে। এই নির্বাচন প্রক্রিয়ার বিরোধিতা করে বিএনপিপন্থী কৃষিবিদদের সংগঠন এ্যাব গত ২০ অক্টোবর খামারবাড়ি এলাকায় বিক্ষোভ ও সমাবেশ করে। তারা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে কেআইবির নির্বাচন না করার দাবি জানায় এবং বর্তমান প্রশাসকের পদত্যাগ দাবি করে।

ওই সমাবেশে এ্যাবের আহ্বায়ক ড. কামরুজ্জামান কায়সার ও সদস্যসচিব শাহাদাত হোসেন বিপ্লব নেতৃত্ব দেন। সমাবেশের পর এ্যাব নেতারা সমাজকল্যাণবিষয়ক উপদেষ্টা হলেন শারমীন এস মুরশিদ এবং সমাজ সেবা অধিদফতরের মহপরিচালক মো: সাইদুর রহমান খানের সাথে দেখা করেন বলে জানা যায়।

সোমবার দুপুরেও এ্যাব নেতারা সমাজসেবা অধিদফতরের মহাপরিচালক মো: সাইদুর রহমান খানের সাথে দেখা করে প্রশাসক অপসারণের দাবি তোলেন। ঠিক এর পরপরই বিকেলে কেআইবিতে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।

কেআইবি কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, এ্যাব নেতাদের ৭০-৮০ জন লোক এসে ব্যাপক আতঙ্ক তৈরি করে। তারা গালিগালাজ করতে থাকে। নিরাপত্তা কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম ভূঁইয়া, এডমিন অফিসার সৈয়দ ইমরুল কায়েসসহ অন্য কর্মীদের বের করে দেন। তারা সিসি ক্যামেরা ভেঙ্গে নিয়ে গেছে। নিচ তলায় সিসি ক্যামেরার কম্পিউটারের সব হার্ড ডিস্ক খুলে নিয়ে গেছে। এক্সেসেস কন্ট্রোল ভেঙ্গে দিয়েছে। প্রশাসক ও নির্বাচন কমিশনের রুমের নাম ফলক ভেঙ্গে দিয়েছে বলে জানান প্রশাসক মো. আব্দুর রব খান।

কেআইবির প্রশাসক বলেন, একদল লোক হঠাৎ এসে ভবনে ভাঙচুর চালায়, আমাকে কেআইবি ছাড়ার হুমকি দেয়। আমাকে সরকার নিয়োগ দিয়েছে। সরকার যতক্ষণ রাখবে, আমি দায়িত্বে থাকব। হুমকি দিয়ে আমাকে সরানো যাবে না।

তিনি বলেন, দীর্ঘ ১৬ বছর ভোটবঞ্চিত থাকা কেআইবিতে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে। ৯ মাসে সংগঠনের আর্থিক অনিয়ম দূর করে স্বচ্ছতা আনার চেষ্টা করেছি। অথচ ৯ মাসে কেউ আমার পদত্যাগ দাবি করেনি। এখন নির্বাচন ঘিরে একটি গ্রুপ বিশৃঙ্খলা তৈরি করছে।

ঘটনার পর পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে হামলাকরীরা সরে যায় বলে জানা যায়। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো: ইবনে মিজান জানান, খবর পেয়ে আমরা কেআইবিতে গিয়েছিলাম। এখানে প্রশাসনিক অফিসে ভাঙচুর চালানো হয়েছে।

তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোবারক হোসেন বলেন, এ ঘটনায় কেআইবি কর্তৃপক্ষ মামলা করেছে। আমরা আসামিদের গ্রেফতারের চেষ্টা করছি। এ ঘটনা যারা ঘটিয়েছে তাদের কাউকে ছাড়া দেয়া হবে না।

সমাজসেবা অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. সাইদুর রহমান খান বলেন, গত ১৭ জানুয়ারির সঙ্ঘর্ষের পর সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা কেআইবি পরিদর্শন করে সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতে প্রশাসক নিয়োগের নির্দেশ দেন। এখন প্রশাসক নির্বাচন কমিশন গঠন করেছেন। একটি পক্ষ এই উদ্যোগকে বাধা দিতে চায়। বিষয়টি উপদেষ্টা-সচিব পর্যায়ে দেখা হচ্ছে।

সমাজকল্যাণবিষয়ক উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ বলেন, কৃষিবিদের প্রাণের সংগঠন কেআইবিতে দীর্ঘদিন দুর্বৃত্তায়ন চলেছে। আমরা শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছি। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে সিনিয়র কৃষিবিদদের সাথে বৈঠক করে নির্বাচন নিয়ে জটিলতা মেটানোর কথা ছিল। এর মধ্যে ভাঙচুরের মতো ঘটনা দুঃখজনক। যারা বিশৃঙ্খলা তৈরি করেছে, তাদের কোনো ছাড় দেয়া হবে না।

হামলা ও ভাঙচুরের বিষয়ে জানতে চাইলে এ্যাব আহ্বায়ক কৃষিবিদ ড. কামরুজ্জামান কায়সার রাতে নয়া দিগন্তকে বলেন, ‘প্রশাসকের মেয়াদ শেষ হয়েছে গত ১৭ তারিখ (অক্টোবর)। আবার তিনি এক্সটেনশন চান। একটু প্রবলেম হয়েছে আরকি।’

ভাঙচুর হয়েছে-এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ভাঙচুর মানে সামান্য উত্তেজনা। উনি অনিয়ম দুর্নীতি করে যাচ্ছেন। তবে থানায় মামলার বিষয়টি তার জানা নেই বলে জানান।

এ্যাব সদস্যসচিব শাহাদাত হোসেন বিপ্লবকে ফোন দিলে অন্যজন রিসিভ করে বলেন, ‘ভাই গুলশান কার্যালয়ে (বিএনপি চেয়ারপারসনের) আছেন।’

উল্লেখ্য, ২০০৯ সালের পর কেআইবিতে বিগত আওয়ামীপন্থীরা কেআইবিতে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে। এরপর নির্বাচনের তফসিল হলেও অনেকটা ভোট ছাড়াই কয়েকটি কমিটি ১৫ বছর পার করেছে। প্রায় ৩৩ হাজার সদস্যের এই সংগঠনকে ঘিরে লুটপাটের অভিযোগও ছিল। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের পতনের পর কেআইবির নিয়ন্ত্রণ নেয় বিএনপিপন্থী কৃষিবিদদের সংগঠন এ্যাব। এরপর থেকেই সংগঠনের অভ্যন্তরে আধিপত্য ও আর্থিক বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছিল। গত ১৭ জানুয়ারি দুই গ্রুপের সঙঘর্ষে কয়েকজন আহত হওয়ার পর সরকার কেআইবিতে প্রশাসক নিয়োগ দেয়। প্রশাসক দায়িত্ব নেয়ার পর প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করেন। সেই প্রক্রিয়া থামাতেই গতকালের এই হামলা চালানো হয়েছে বলে কেআইবি কর্তৃপক্ষের অভিযোগ।